পরোয়া করেননি সরকারের রক্তচক্ষু! এনডিটিভি আদানির দখলে যাওয়ার পর কী করবেন রবীশ কুমার?
শাসকের বিরোধী মুখ হিসেবেই যাদের পরিচিতি ছিল তাদের সমর্পণে প্রশ্ন উঠেছিল, এবার কী করবেন রবীশ কুমার?
"ভারতের নিউজ চ্যানেলগুলি অক্লান্তভাবে দেশের গণতন্ত্রকে খুন করেছে, যার ফলে মানুষ এখন এমন সব নিউজ চ্যানেলেরই কভারেজ শোনে, যা ভারতরাষ্ট্রকে কোনও প্রশ্ন করে বিচলিত করে না।" একটি অনুষ্ঠানে এভাবেই ভারতের 'গোদি মিডিয়া'-কে নিয়ে বলেছিলেন নিজেরই ভাষায় 'পৃথিবীর প্রথম এবং বিখ্যাত জিরো টিআরপি সঞ্চালক’ সাংবাদিক রবীশ কুমার। দীর্ঘদিন ধরেই এনডিটিভির একাধিক অনুষ্ঠানে কংগ্রেস সরকার থেকে মোদি সরকারের নীতির বিরোধিতা করে এসেছেন রবীশ। টিআরপি-র বিচারে ‘প্রাইমটাইম উইথ রবীশ’ অথবা ‘রবীশ কা রিপোর্ট’-এর জনপ্রিয়তা বরাবরই বেশি। কিন্তু ২৩ অগাস্ট একটি বিজ্ঞপ্তিতে আদানি গ্রুপ জানায়, এনডিটিভি-র ২৯.১৮ শতাংশ শেয়ার কিনে নিয়েছে আদানি গোষ্ঠী। আরও একটা অংশ তারা কিনতে চায়, যদি এনডিটিভি রাজি হয়। বাকি অংশ কিনে নিলে সম্পাদকীয় নিয়ন্ত্রণও আর থাকবে না এনডিটিভি-র হাতে। যে মোদি সরকারের বিভিন্ন নীতির বিরোধিতা করে এসেছে এনডিটিভি, শাসকের বিরোধী মুখ হিসেবেই যাদের পরিচিতি ছিল তাদের এহেন সমর্পণে প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি রবীশ কুমার পদত্যাগ করবেন এনডিটিভি থেকে?
সমস্ত জল্পনায় ইতি টেনে ট্যুইট করে রবীশ কুমার লিখেছেন, "প্রধানমন্ত্রী মোদি আমাকে সাক্ষাৎকার দেবেন কিংবা অক্ষয়কুমার আমার জন্য গেটের বাইরে আমের ঝুড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবেন, এসব যতখানি গুজব, এনডিটিভি থেকে আমি পদত্যাগ করছি, সেটাও একই ধরনের গুজব।"
রবীশ কুমারের জীবনে বিতর্ক এই প্রথম নয়। এর আগেও নিজের মাথা না-নোয়ানো সাংবাদিকতার জন্য একাধিকবার ঝুঁকির মুখে পড়েছেন তিনি। তাঁর সাংবাদিকতা সবসময়ই প্রান্তিক সত্যর উন্মোচন। নিজের দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে সত্যকেই টিভিতে, প্রকাশ্যে তুলে এনেছেন তিনি। সোশ্যাল মিডিয়ার গুজব থেকে শুরু করে বিজেপির আইটি সেলের প্রোপাগান্ডা- রবীশের প্রাইমটাইমে সবকিছুকেই তিনি যুক্তির আলোয় সাধারণ মানুষের কাছে ভুল প্রমাণ করে এসেছেন। মানুষ যখন খবরের প্রতি মুখ ফিরিয়েছে, তখন রবীশ কুমার লিখছেন, "হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি-র সমস্ত খবরই ভুয়া খবর। মানুষ এইসব খবর যাচাই না করে বিশ্বাস করছে।"
কেন্দ্রে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রতিনিয়ত মৃত্যুর হুমকি পান রবীশ। এই প্রসঙ্গে রবীশ কুমার লিখছেন, "আপনি যদি প্রশ্ন করেন, সেটা কখনও কখনও আপনার জীবনের জন্য ঝুঁকির হতে পারে। কিন্তু আমি যদি প্রশ্ন করা ছেড়ে দেই তাহলে আমি কোনওদিনই সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে পারব না।"
প্রান্তিক ভারতের কথা বলতে গিয়ে রবীশ কুমার বিশ্বাস করেন ভাষার রাজনীতিতে। এনডিটিভি-র যে ক'টি শো রবীশ কুমার করেন, বা যেখানে রবীশ বক্তব্য রাখেন, তাঁর হিন্দি যেন ভারতের প্রান্তের মানুষের মুখের ভাষা হয়ে ওঠে। মাজাঘষা ভাষায় যে ওই অদেখা-অচেনা ভারতের কাছে পৌঁছনো যাবে না, তা বিলক্ষণ বিশ্বাস করেন রামন ম্যাগসেইসেই-জয়ী সাংবাদিক রবীশ। অন্য টেলিভিশন চ্যানেলগুলি যখন ‘গলাবাজি’-র সাংবাদিকতার পথে হাঁটতে শুরু করেছে, তখনও রবীশ তাঁর প্রাইমটাইম সঞ্চালনা করেন, মানুষের কাছে সহজ ভাষায় সত্য খবর পৌঁছে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়ে এক কথকের ভঙ্গিতে। নিজে সাংবাদিক হয়েও ভারতের সংবাদমাধ্যমের ওপর তেমন আস্থা বা বিশ্বাস নেই তাঁর। লেখেন, "সাংবাদিক হিসেবে যে আদর্শ আমরা শিখেছি, আজ আর তার কণামাত্রও অবশিষ্ট নেই। এখন কেবল যা হয়, সবই ধর্ম ও হিন্দু-মুসলিম নিয়ে। এখন সঞ্চালকরা সবাই ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়াতে ব্যস্ত। আর কেন মানুষ খবর দেখবে!"
২০১৯-এ যখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ঘোষণা করছেন, সেসময়ও নিজের অনুষ্ঠান ‘প্রাইমটাইম উইথ রবীশ'-এ মোদি সরকার ও ‘হিন্দু মিডিয়া'-র প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে একা মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন রবীশ। সরাসরি সাংবাদিকদের উদাসীনতাকে প্রশ্ন করে বলেছেন, "প্রত্যেক এক ব্যক্তিকেই কখনও না কখনও দিক বাছতে হয়। এটাই সময়। এখন যদি মানুষ দিক ঠিক করতে না পারে এই পরে আর দ্বিতীয় সুযোগ মিলবে না।" মোদি-শাহর নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন, "সরকার কি জানেনা দেশে পুরুষের থেকে ও মহিলাদের স্বাক্ষরতার হার কম? এই সিদ্ধান্ত নেওয়া মানে তো জেনেশুনে প্রান্তিক মহিলাদের কে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিল সরকার।"
নিজের এই অবিচল নির্ভীক সাংবাদিকতার স্বীকৃতিও পেয়েছেন। ২০১৩ ও ২০১৭ সালে তাঁর সাংবাদিক হিসেবে অবদানের জন্য পেয়েছেন রামনাথ গোয়েঙ্কা এক্সেলেন্স ইন জার্নালিজম অ্যাওয়ার্ড। ২০১৯ সালে পেয়েছেন সাংবাদিকতার অন্য আরেক সম্মান রামন ম্যাগসেইসেই অ্যাওয়ার্ড। ভারতে যেখানে সংবাদমাধ্যমের গলায় বকলস বেঁধে দিয়েছে মোদি সরকার, তখন রবীশ কুমারের ব্যাতিক্রমী স্বর সাংবাদিকতার কর্তব্য প্রমাণে নিরলস কাজ করে চলেছে।