সম্পূর্ণ প্যারালাইজ়ড রোগীকেও হাঁটানো সম্ভব! পথ দেখাচ্ছে বিজ্ঞান

প্যারালাইসিস বা পক্ষাঘাত শরীরকে অসাড়  করে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে। একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগী ও তাঁর পরিবারই বোঝেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেবল শরীর নয়, জীবন থামিয়ে দেয় এই সমস্যা  প্যারালাইসিসের কারণগুলির মধ্যে অন্যতম স্ট্রোক, শিরদাঁড়ায় আঘাত, নার্ভের অসুখ প্রভৃতি। নড়াচড়ার বা হাঁটাচলার ক্ষমতা, শারিরীক অনুভূতি, ইন্দ্রিয়ের কাজ, স্বাভাবিক অভিব্যক্তি সবই প্রায় হারায় শরীরের যে অংশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয় - সেই অংশে।

সাধারণত প্যারালাইসিস বা পক্ষাঘাত হওয়া অংশও তার আশেপাশের নার্ভকোশগুলির মৃত্যু (সেল ডেথ) হয়। প্যারালাইসিস সারিয়ে তোলা এখনও দুঃসাধ্য একটি বিষয়। তবে যদি নার্ভকোশগুলির যদি খুব অল্প সংখ্যায় মৃত্যু হয়, সে ক্ষত্রে প্যারালাইসিস প্রায় পুরোপুরো সারিয়ে তোলা যায়।

কিন্তু সম্পূর্ণ ভাবে যদি নষ্ট হয় নার্ভ কোশ,যদি সম্পূর্ণ ভাবে লোপ পায় হাঁটাচলার ক্ষমতা, ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি তাহলে? এবার সেই অসাধ্যকেই বাস্তবে পরিণত করলো প্রযুক্তি। স্পাইনাল কর্ডের ভয়াবহ আঘাতের পর, চলাফেরার ক্ষমতা সম্পূর্ণ হারিয়েও কেবল ইমপ্ল্যান্টের সাহায্যে পায় হাঁটতে পারলেন তিন ব্যক্তি। শুধু তাই নয় সাধারণ কাজ, সাঁতার কাটা, ট্রেডমিলে দৌড়নো সব কাজই করতে পারছেন তাঁরা শরীরে ইমপ্ল্যান্ট ইলেক্ট্রোডটি বসানোর পরে।

সুইস ফেডেরাল ইনস্টিট্যুট অফ টেকনোলজির নিউরোসায়েন্টিস্ট গ্রেগরি কার্টাইন সেই অসাধ্যসাধন করে দেখিয়েছেন ইমপ্ল্যান্ট ইলেক্ট্রোডটি অবিষ্কারের মাধ্যমে। তাঁর সাড়া জাগানো এই গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে নেচার মেডিসিন নামের সায়েন্টিফিক জার্নালে। গবেষকদের বক্তব্য প্রাথমিক ভাবে এই ইমপ্ল্যান্ট ইলেক্ট্রোডকে বানানো হয়েছে এমনভাবেই, যাতে এই ইমপ্ল্যান্ট ইলেক্ট্রোডটি কেন্দ্রিয় স্নায়ুতন্ত্র থেকে আসা সিগন্যাল বা বার্তাকে অনুকরণ করে শরীরের নিম্নাংশের প্যারালাইসিসে ভোগা রুগীদের হাঁটাচলা এবং ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। তার আগে কেন্দ্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের নার্ভগুলিতে বৈদ্যুতিক সঞ্চার ঘটিয়ে তাদের উদ্দীপিত করবে এই ইলেকট্রোড।

কী ভাবে ফিরে পেলেন তাঁরা সেই ক্ষমতা? কী ভাবেই বা কাজ করে সেই ইমপ্ল্যান্ট ইলেক্ট্রোডটি? তা জানার আগে সংক্ষেপে জানতে হবে প্যারালাইসিস বা পক্ষাঘাত ঠিক কেন হয়। প্যারালাইসিস হলে নার্ভের কার্যক্ষমতা লোপ পায়। শিরদাঁড়ার আঘাত বা স্পাইনাল কর্ড ইনজ্যুরির ক্ষেত্রেও শরীর আংশিক বা সম্পূর্ণ অসাড় হয়ে যায়। শিরদাঁড়ার উপরের অংশ আঘাতপ্রাপ্ত হলে শরীরে সম্পূর্ণ অসাড়তা দেখা যায় - ডাক্তারির ভাষায় একে বলে টেট্রাপ্লেজিয়া বা কোয়াড্রিপ্লেজিয়া। অন্যদিকে, আঘাত যদি শিরদাঁড়ার নিম্নভাগে লাগে, সে ক্ষেত্রে শরীরের নিম্নাংশ ও দুই পা অসাড় হয় - ডাক্তারির ভাষায় একে বলে প্যারাপ্লেজিয়া।

শরীরকে চালানোর জন্যে আমাদের কেন্দ্রিয় স্নায়ুতন্ত্র  শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গে বার্তা পাঠায়, যে বার্তা আসে নার্ভের মাধ্যমে। কেন্দ্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের আবার দুটি অংশ - মস্তিষ্ক এবং শিরদাঁড়া বা স্পাইনাল কর্ড। কেন্দ্রিয় স্নায়ুতন্ত্র থেকেই নার্ভগুলি এসে ছড়িয়ে পড়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে।

মজার বিষয় হল আমাদের নার্ভকোশগুলি বার্তা পাঠায় ইলেক্ট্রিক পরিবহনের মাধ্যমে। হ্যাঁ, অবশ্যই আপনার, আমার বাড়িতে যে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়, আমাদের শরীরের ইলেক্ট্রিক সরবরাহের তেজের সামনে তা অনেকগুণ বেশী। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র থেকে আসা বৈদ্যুতিক বার্তা নার্ভ কোশ গ্রহণ করে, আবার শরীরের অন্য অংশে পাঠিয়ে দেয়। যে অংশে পাঠায় সেই অংশে অনুভূতি সঞ্চারিত হয়, বা নড়াচড়া করে ওঠে একটি অঙ্গ।

প্যারালাইসিস বা পক্ষাক্ষাত হলে যখন স্নায়ুকোশগুলির মৃত্যু হয়, তখন শরীরের প্যারালাইজ়ড অংশে কেন্দ্রিয় স্নায়ুতন্ত্র থেকে বার্তা পাঠানোর কেউ থাকে না। ফলে প্যারালাইজ় অংশে না থাকে নড়াচড়ার ক্ষমতা, না থাকে অনুভূতি।

ইলেক্ট্রোডগুলি ক্ষতিগ্রস্থ নিউরোনগুলিকে উদ্দীপিত করবে। করবে। আর উদ্দীপিত নিউরোন থেকে ছড়িয়ে পড়া বৈদ্যুতিক বার্তা পৌঁছে যাবে শরীরের নিম্নাংশে। এবং হাঁটাচলা বা শরীরের ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করবে। ফলে প্যারালাইজ়ড অংশও আবার অনুভূতি পাবে এবং কাজ করবে আগের মতই।

আরও পডুন-রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে সরব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ঠিক কী ঘটেছিল ৬ বছর আগে

অস্ত্রোপচারের সাহায্যে এই ইমপ্ল্যান্ট ইলেকট্রোডটি বসানো হয়েছে শরীরের সেই সব স্থানেই যেখানে স্পাইনাল কর্ড থেকে বেরিয়ে আসা মোটর নিউরোনগুলির প্রান্ত ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়েছে। মোটর নিউরোন আমাদের হাঁটাচলা, নড়াচড়া, এবং ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে। ইলেক্ট্রোডগুলি স্পাইনাল কর্ডের এই ক্ষতিগ্রস্থ নিউরোনগুলিকে উদ্দীপিত করবে। 

ইলেক্ট্রোডগুলি বসানোর আগে পরীক্ষা করা হয়েছে কোনো ব্যক্তির জন্যে কতটা ইলেক্ট্রিক্যাল কারেন্ট আদর্শ। আরও মজার বিষয় হল, অস্ত্রোপচারের পরে প্রত্যেক ব্যক্তি রিমোটের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে ইলেক্ট্রিকের মাত্রা। হাঁটবার সময় বা পা নাড়ানোর সময় কতটা ইলেক্ট্রিকের উদ্দীপনা দরকার রিমোটের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন তাঁরা নিজেরাই।

আপাতত এই ইলেট্রোডটি অস্ত্রোপচার করে বসানোর জন্যে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমতি দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা এফডিএ। আপাতত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই  ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালটি সীমাবদ্ধ থাকলেও, ভবিষ্যতে আশার আলো দেখাচ্ছে নতুন এই গবেষণা।

More Articles