সিনেমায় মাসল পাওয়ার আর রুচি হাত ধরাধরি করে চলতে পারে না: ইন্দ্রাশিস আচার্য
Indrasis Acharya Interview: বাংলায় ছবি করতে গেলে সৃজনশীলতাটা আর প্রধান শর্ত নয়? শুধু ব্যবসা বুঝে বিনোদন গুঁজে দিলেই লাভ? কী বলছেন 'নীহারিকা'-র পরিচালক ইন্দ্রাশিস আচার্য্য?
রণদীপ: ইন্দ্রাশিসদা, ‘ইনস্ক্রিপ্ট’-এ আপনাকে স্বাগত জানাই। ‘নীহারিকা’ মুক্তি পাওয়ার প্রায় একবছর পর ওটিটি-তে এল। এখন ছবিটি আরও বেশি মানুষ দেখছেন, ছবিটি আরও বেশি আলোচিত হচ্ছে। মুক্তি পাওয়ার একবছর পর আবার ছবিটি আলোচনা-সমালোচনার তরঙ্গ তুলতে পেরেছে— কেমন লাগছে?
ইন্দ্রাশিস: অবশ্যই ভালো লাগছে। আমাদের মতো পরিচালক, যাদের বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে ছবি বানাতে হয়, তাদের ছবি যখন প্রথম হলে রিলিজ করে তখন ভীষণ ভালো লাগে। ছবি হলে আসছে, বহু লোক দেখবেন— এর থেকে আনন্দদায়ক আর কিছু হয় কি? এখন দেড়বছর পর অ্যামাজন প্রাইমের মতো ওটিটি-তে ছবিটি এসেছে, সেখানে আরও বেশি মানুষ দেখছেন, ভবিষ্যতেও দেখবেন। আরও বেশি মানুষের কাছে ছবিটি পৌঁছে দেওয়াই আমাদের দলের লক্ষ্য ছিল, সেই লক্ষ্যটা অল্প-অল্প করে, ধাপে-ধাপে পূরণ করতে পারছি। এটা তো আনন্দের ব্যাপারই।
রণদীপ: নীহারিকা দর্শকের কাছে পৌঁছনোর আগে কীভাবে ধরা দিয়েছিল স্রষ্টার কাছে?
ইন্দ্রাশিস: ‘নীহারিকা’-র মূল টেক্সটটি আমি পড়েছিলাম ২০১৩-১৪ নাগাদ, তখন আমি ছবি করার কথা ভাবিনি। আমার মনে হয়েছিল, ফিল্মের জন্য বিষয়টা উপযুক্ত নয়। তারপর অন্য একটা ভাবনা মাথায় এল। দীপার গল্পকে সঞ্জীববাবু গড়ে তুলেছিলেন মধুপুর-গিরিডি অঞ্চলে, কাজেই এই গল্প নিয়ে ছবি করলে ল্যান্ডস্কেপের একটা গুরুত্ব থাকে। তখন ভাবলাম, আমি যদি ল্যান্ডস্কেপকে আলম্ব করে একটা বিষণ্ণতা তৈরি করি, কেমন হয়? বিষণ্ণতা একদিকে থাকল, ছবিটার গল্প আরেকদিকে থাকল— ক্রমে তাদের পথ এসে মিশে গেল কোনও একটা জায়গায়।
এই ভাবনা মাথায় নিয়ে আমি আর আমার পুরো টিম উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অফবিট জায়গায় ঘুরেছিলাম। সেই সময়ে আমার প্রধান সহকারী পরিচালক সৌমেন মণ্ডল শিমুলতলার কয়েকটি ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে ছবি আমাকে পাঠায়— তৎক্ষণাৎ আমি সিদ্ধান্ত নিই, ছবিটা এখানেই করব। দীপার জন্য এর থেকে ভালো জায়গা আর কী হবে? বাড়ি থেকে হেঁটে কলেজে যাওয়া যায়, সে-পথে একটা ছোট নদী পড়ে; মালভূমি অঞ্চল, সেখানে দীপার বাড়ি— এই দৃশ্যগুলো আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম। অতএব, আমি মনস্থির করি যে এই ছবিটা আমাকে করতেই হবে। ছবিটা করতে না-পারার জন্য একটু অস্বস্তি ছিল, কিন্তু শিমুলতলার ছবিগুলো দেখার পর মনে হলো চরিত্রগুলোকে এখানে ঘোরাফেরা করতে দেখতে পাচ্ছি। ‘প্যাস্টেল এন্টারটেনমেন্ট’ যখন এই ছবিটার প্রথম অংশটা প্রোডিউস করল, আমরা ছবিটা কিছুটা শ্যুট করলাম; তখন মনে হলো ছবির জগৎটা গড়ে তুলতে পারছি। তারপর আর কাজটা ফেলে রাখা সমীচীন নয়; প্রচুর প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ছবিটা বানিয়ে ফেলা গেল।
রণদীপ: আপনি যখন একটা গল্প পড়েন, তখন কোন পয়েন্টে বা কোন বিষয়টি পেলে মনে হয় এই গল্প থেকে ছবি বানাতেই হবে?
ইন্দ্রাশিস: দেখো, গল্প পড়ে খুব একটা সিনেমার কথা ভাবি না কারণ আজ অবধি যে ছ’টা ছবির শ্যুটিং করেছি, তার পাঁচটার গল্প এবং চিত্রনাট্য আমার লেখা। হিন্দি একটা আছে, সেটা বেরোয়নি। তা, এই ছবিগুলোর মধ্যে একমাত্র ‘নীহারিকা’ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভয়’ উপন্যাস থেকে বানানো। ‘ভয়’ থেকে কেন ছবি করলাম তা তো বললামই।
দ্বিতীয়ত, আমি আগে ভোরেশাস রিডার ছিলাম। ২০১৩-১৪ অবধি প্রচুর বই পড়তাম। কেউ নোবেল বা বড় কোনও পুরস্কার পেলে তার বই-টই কিনে পড়ে ফেলতাম। সিনেমা দেখাও সেভাবেই— ২০০৮-০৯ অবধি একটা দেশের বড়-বড় পরিচালকের ছবি কালানুক্রমিকভাবে দেখতাম; তাদের ছবির রাজনৈতিক-সামাজিক, সাঙ্গীতিক পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করতাম। যাই হোক, সে অন্য প্রসঙ্গ। গল্প পড়তে পড়তে বা সিনেমা দেখতে দেখতে আমার পছন্দের বিষয়গুলো আমি আহরণ করে নিই আর আমার চেনা জগৎটা অল্প-অল্প করে প্রসারিত হয়। আমার ছবি তো খুব ঘটনাবহুল নয়, বরং একেকটি ঘটনার অভিঘাত বা ফলাফল খুব জোরালো হয়ে ওঠে। সেই অভিঘাতটা ফুটিয়ে তুলতে আমি যা পড়েছি, যা দেখেছি তার কিছু-কিছু উপাদান ব্যবহার করি। আবার একই সঙ্গে ছবির টোনটা খুব মিনিমালিস্টিক রাখা লক্ষ্য থাকে।
আমি ছবিতে মিউজিক খুব কম রাখি। তবে আমি কিন্তু ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকালের খুব ভক্ত, সেই ইলেভেন-টুয়েলভ থেকে শুনি। ইন্ডিয়ান ক্লাসিকালও শুনেছি কিন্তু ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল একটু বেশি। যখন কোনও সুর শুনি ফাঁকা সময়ে— যেমন গাড়ি চালানোর সময়— তখন অনেক পড়া গল্পই একটু অন্যভাবে ধরা দেয়। ওই সুরের সঙ্গে মিশে গিয়ে তার প্রভাবটা খুব জোরালোভাবে পড়ে। এরকম কয়েকটা উপন্যাস আমাকে খুবই ভাবায়।
আর এর পাশাপাশি আমার নিজের কিছু ভাবনা রয়েছে। সেগুলো নিয়ে ভাবতে বসে মনে হয়, সিনেমাটিক উপাদান আরেকটু বাড়ালে এ-থেকে একটা ছবি হতে পারে। ‘ভয়’ উপন্যাসে যেমন নিসর্গের ভূমিকা এতটা ছিল না, আমি ‘নীহারিকা’-য় সেই স্তরটা যোগ করলাম। অতএব কিছু কিছু ঘটনা, সুর, উপাদান আমি সব জায়গা থেকে জোগাড় করি; সেটা একজায়গায় এসে মিশলে একটা সিনেমা তৈরি হয়। এটা আমার ব্যক্তিগত স্টাইল।
রণদীপ: মানে অন্য কারও সৃষ্টিতে যখন আপনি নিজের জগতের অনুরণন পান, সেটা আপনাকে খুব আকর্ষণ করে?
ইন্দ্রাশিস: একেবারেই। বিশেষত, যে জগৎ আমি চিনি না, সেই জগৎ আমাকে খুব টানে। একটা উদাহরণ দিই। একবার একটা খবর দেখেছিলাম, একটা মেয়েকে মালদা থেকে শ্রীলঙ্কায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ওই যাত্রা থেকেই কিন্তু একটা ছবি হতে পারে। এই ছবিটা করার ইচ্ছে আছেও, তবে এই ভাবনাগুলো তো ‘ইচ্ছে’ হয়েই থেকে যায়। তাই বলছিলাম, শুধু নিজের জীবন নয়, বরং যে জীবন আমি দেখিনি, চিনি না, সেই জগৎ নিয়েও কাজ করতে ইচ্ছে করে। ‘গাজনের ধুলোবালি’-তে আমি একদম অপরিচিত একটা জগৎ নিয়ে কাজ করেছি। আজ অবধি যা ছবি বানিয়েছি তার থেকে ‘গাজনের ধুলোবালি’ একদম আলাদা— ভীষণ ফাস্ট-পেসড, প্রচণ্ড নৃশংস একটা ছবি। নিঃসন্দেহে ছবিটা আমার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে থাকবে। দেখি, কবে মুক্তি পায়।
আরও পড়ুন- টলি কেলেঙ্কারি: সিনেমাপাড়ায় থ্রেট কালচারই শেষ কথা?
রণদীপ: এর আগের ছবিগুলির গল্প আপনার নিজের লেখা; এই প্রথম আপনি অন্য কারও গল্প নিয়ে কাজ করলেন। তার উপর, সেই মানুষটি কিংবদন্তি সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। ওঁর মতো মানুষের টেক্সট নিয়ে যখন কাজ করছেন, ভেতরে-ভেতরে একটু বেশি সাবধানতা কাজ করেছে কি?
ইন্দ্রাশিস: বিষয়বস্তু এতটাই সেন্সিটিভ, সেটা নিয়ে সত্যি বলতে একটু চাপ ছিল। ইনসেস্ট নিয়ে তো আমাদের এখানে খুব বেশি লেখালেখি হয়নি; সেখানে তিনি বোধহয় ছিয়াশি সালে এমন দুঃসাহসী লেখা লিখে ফেলেছিলেন। কিন্তু এ-ও জানতাম, সঞ্জীববাবু এমন একজন মানুষ, তিনি কিছু মনে করবেন না। ছবিটা বানানোর আগে, বানানোর সময়ে ওঁর সঙ্গে বহুবার কথা হয়েছে; ছবিটার ট্রেলারও ওঁর খুব পছন্দ হয়েছিল।
আমরা এমনিতে খুব নিরাপদ জায়গায় থাকতে চাই— চাকরিতে হোক, জীবনে হোক; যেখানেই সামান্য ঝুঁকি আছে, সেখানে আমরা যেতে চাই না। কাজেই এরকম একটা সমাজে এমন ছক-ভাঙা একটা গল্প নিয়ে কাজ করার চিন্তা ছিল। ছবিটা মুখ থুবড়ে পড়বে কিনা, মিসইন্টারপ্রেটেড হবে কিনা, সেটা নিয়ে তো চিন্তা ছিলই। নেতিবাচক কথাও যে হয়নি বলব না, হয়েছে। তবে একজন ভদ্রলোক সাতবার ছবিটা দেখেছেন, তা-ও তাঁর আশ মেটেনি— এমন দর্শকও পেয়েছি। এটাই আমাদের পাওয়া আর কী!
রণদীপ: সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছবি মুক্তির পর কথা হয়েছে? তিনি দেখেছেন ছবিটি?
ইন্দ্রাশিস: না, তিনি তো খুব অসুস্থ, জানি না প্রাইমে ছবিটি আসার পর দেখেছেন কিনা। আমি অপূর্ববাবুকে ফোন করে বলব, ছবিটা অন্তত বাড়িতে যদি ওঁকে দেখানো যায়। আমি চেয়েছিলাম ওঁকে দেখাতে, সিনেমা হলেও নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু অসুস্থ বলে আর হয়ে ওঠেনি ব্যাপারটা।
রণদীপ: আপনার আগের দু'টি ছবি যদি দেখি, তাহলে সেখানে তারকা বলতে যাঁদের বোঝায়, তাঁদের দেখতে পাব। এই ছবিতে সেই অর্থে তারকাদের উপস্থিতি নেই। অনুরাধা মুখার্জি, অনিন্দ্য সেনগুপ্ত, রাজেশ্বরী পাল, রোহিণী চ্যাটার্জি— সকলেই নতুন মুখ। শিলাজিৎ আর মল্লিকা মজুমদারও অনেকদিন পর অভিনয় করলেন। এই স্টারবর্জিত কাস্টিং কি বাজেটের কথা ভেবে, নাকি আপনার মনে হয়েছিল এঁরাই এক্কেবারে আদর্শ?
ইন্দ্রাশিস: ছবিটার গোড়া থেকেই অনুরাধা মুখ্য চরিত্রে ছিল। শিলাজিৎ যে চরিত্রটি করেছেন, সেটায় দু-একজনকে ভাবছিলাম বটে; তাঁরা সরে আসায় শিলাজিৎ চরিত্রটা করেন। পরে আমার মনে হয়েছিল শিলাজিৎ এই চরিত্রে আদর্শ হবেন। অনিয়মিত ফান্ডের উপর ভিত্তি করে আমরা ছবিটা বানিয়েছি; এই গোটা প্রক্রিয়ায় শিলাজিৎ আমাদের নানাভাবে সহায়তা করেছেন। এই সহায়তার ভীষণ প্রয়োজন ছিল। তাছাড়া, শিলাজিৎ চমৎকার অভিনয়ও করেছেন তা তো বলাই বাহুল্য। এ-বাদে আর কোনও স্টারের কথা ভাবিনি, ছবিটা তো খুব পার্সোনাল ছবি তো! ‘বিলু রাক্ষস’ যেমন ব্যক্তিগত, ‘নীহারিকা’-ও তা-ই। ব্যবসা, শিল্পীর গ্রহণযোগ্যতা, খ্যাতি— এসব মাথায় রেখে বানাইনি।
রণদীপ: আপনার ছবি খুব পার্সোনাল একটা জায়গা থেকে আসে বললেন।
ইন্দ্রাশিস: হ্যাঁ।
রণদীপ: সেই ব্যক্তিগত আধারটি ছবিতে স্পষ্ট। একটা অনুচ্চকিত, সূক্ষ্ম, মিনিমালিস্টিক টোন থাকে সমস্ত ছবি জুড়ে। এই সূক্ষ্মতা, পরিমিতি কি আপনার কাছে খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধরা দেয়, নাকি ছবি বানানোর সময়ে খুব সচেতনভাবে মাথায় রাখেন যে ছবিটা এই ধাঁচেই বানাতে হবে?
ইন্দ্রাশিস: (একটু ভেবে) বানাতে গেলে তো ছবির ছন্দ মাথায় রাখতে হয়। প্রথম দৃশ্যে যে অনুচ্চকিত ছন্দ তৈরি হচ্ছে, তা শেষতক বজায় রাখতে না পারলে ছবিটার মান ক্ষুণ্ণ হবে। আমি একটা বিষয় মাথায় রাখি; ছবিটা যতক্ষণ বাস্তবের জমিতে থাকছে, ততক্ষণ যেন কোনওরকম উচ্চকিত টোন তৈরি না হয়। এই বিষয়টা আমার কাছে খুব সহজ, আলাদা করে মনে রাখতে হয় না। এই স্বতঃস্ফূর্ততার জন্যই বোধহয় ছবি জুড়ে ছন্দটা বজায় থাকে। যখন ছবিটা বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে কোনও ভাবজগতে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে বা কল্পলোকের দ্বারস্থ হচ্ছে, তখন এই মিনিমালিজমের কিছুটা পরিহার করি, তাতে বাস্তব এবং কল্পনার সীমারেখাটা ফুটে ওঠে। যেমন ‘বিলু রাক্ষস’-এ রানুদি যখন বিলু-র স্বপ্নে গয়না পরে হাজির হচ্ছে, তখন সে বিলুর জীবনের তিনটি নারীর প্রতিকল্প হয়ে উঠছে: মা, স্ত্রী আর খোদ রানুদি। সে পরেছে বিলুর মায়ের গয়না, স্ত্রীর জন্য বিলুকে বিয়ে করা সম্ভব হচ্ছে না আর রানুদিকেও বিলুর পছন্দ— এই তিনটে ঘটনা ওই একটা জায়গায় মিশে যায়। তা, এই তিন নারীর প্রতি যে ভালোবাসা, যে আবেদন; তা কোনও মানুষ ঠিক বাস্তবানুগভাবে প্রকাশ করে না। এরকম কোনও দৃশ্য রচিত হলে আমি একটু রিয়্যালিটি ছেড়ে বেরোতে পারি, একটু উচ্চকিত ট্রিটমেন্ট আনতে পারি। ‘পার্সেল’-এও কয়েকটা জায়গায় তা-ই করেছিলাম।
আরও পড়ুন- অ্যানিমাল: এমন জান্তব সিনেমা কি শুধুই বিনোদন? কাদের জন্য?
রণদীপ: পার্সেলের কথা উঠল বলে একটা প্রশ্ন করি। আপনি বহুবার বলেছেন, আপনার ছবি ‘কজ’ বা কারণ নয়; একটা ঘটনার ‘এফেক্ট’ বা পরিণতি নিয়ে ভাবে। ‘পার্সেল’- এ যেমন পার্সেল কে পাঠাচ্ছে তা নিয়ে ছবিটা ভাবিতই নয়, বরং বেনামী পার্সেল আসার পরে একটা পরিবার কীভাবে উদ্বিগ্ন, শঙ্কিত, সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠছে— ছবিটা তা নিয়ে ভাবছে। কিন্তু বহু মানুষ একটু ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন কারণ ছবিতে পার্সেল কে পাঠাচ্ছে তা জানা যায় না। একটা কংক্রিট উত্তর পাওয়ার আকাক্ষা পূর্ণ হয়নি বলে অনেকেই ছবিটি পছন্দ করেননি। ব্যথিত হয়েছিলেন?
ইন্দ্রাশিস: সিনেমা ব্যাপারটা দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভীষণভাবে নির্ভর করে। তুমি একই ছবি যদি আলাদা-আলাদা পরিচালকের নাম করে লোককে দেখাও, লোকের প্রতিক্রিয়া আলাদা-আলাদা হবে। মৃণাল সেন ‘একদিন প্রতিদিন’-এর শেষটায় সব প্রশ্নের উত্তর দেন না। ‘আকালের সন্ধানে’-তে দুর্গার শেষতক কী হল জানা যায় না। এখন কিন্তু লোকে এই প্রশ্নগুলো তোলে না; তখন সমালোচনা করেছিল কিনা জানি না। পৃথিবী জুড়ে বহু এরকম বিখ্যাত ছবি আছে, যাতে সমস্ত প্রশ্ন মীমাংসিত হয় না। বিশ্ববরেণ্য পরিচালক হলে লোকে মেনে নেয়, কিন্তু আমার মতো মানুষ হলে ‘তুমি কোথাকার কে’ — এই লাইনে কথা হয়। সমসাময়িক বাংলায় এমন ছবি হচ্ছে, সেটা কেউ ভাবতে পারে না। বাংলায় ছবি দেখার সংস্কৃতি ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে আসছে— এটা অনিবার্য এক সত্যি।
রণদীপ: আপনার কথা থেকে কি এরকম ভাবা যায় যে, একই কাজ যদি বাংলা ছাড়া অন্য ভাষায় হয়, তাহলে মানুষ সেটা মুক্তমনে মেনে নেয়; আর বাঙালি পরিচালকরা দর্শকের অতটা ঔদার্য পান না? মানে একজন বাঙালি পরিচালককে অনেকগুলো স্টিরিওটাইপের বোঝা কাঁধে নিয়ে ছবি বানাতে হয়?
ইন্দ্রাশিস: আমাদের মতো পরিচালকরা একেবারেই দর্শকের ঔদার্য পান না। কেরলে আমার ছবির তিনটে শো-য়ে হল উপচে পড়েছিল। কেন? শুধু ভালো ছবি বলে প্রচারিত হয়েছিল বলে। সেখানে আমি অত্যন্ত মার্জিত আর শিক্ষিত দর্শকদের দেখা পেয়েছি। সেখানকার সমালোচনাও ভীষণভাবে গঠনমূলক। এখানে তো ‘কিছু না বুঝলে আর্ট ফিল্ম বানাও’ — এই ধরনের ব্যঙ্গাত্মক কথা শুনতে পাই। এখানকার ট্রোলিং, সমবেতভাবে একজনকে অপমান করার সংস্কৃতিটা খুব দুঃখজনক। মানুষকে টেনে নামানোর মধ্যে এই যে একটা পাশবিক আনন্দ আছে, তা থেকে খোদ রবীন্দ্রনাথ ছাড় পাননি, আমি তো কোন ছার! তবে এখন এই প্রবণতাটা অত্যন্ত নিম্নরুচির একটা চর্চায় পর্যবসিত হয়েছে। একটা জিনিস বোঝো, সমালোচনায় কিন্তু আমার আপত্তি নেই। কেউ আমার ছবির সমালোচনা করলে আমি ব্যক্তিগত স্তরে কথা বলার চেষ্টা করি, ভিন্ন দৃষ্টিকোণ বোঝার চেষ্টা করি, কয়েকটা সমালোচনায় একমতও হই, কয়েকটার প্রতিযুক্তি দিই— এটা তো অত্যন্ত স্বাভাবিক ও সুস্থ পরিসর। কিন্তু কটু কথা, একজনকে ধরে অপমান করে কিছুটা মজা পাওয়া— এতে আমার একটু অসুবিধে আছে। কারও কাজ পছন্দ না হলে আমি যুক্তি দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করব; শুধু রাগ উগরে দেওয়া তো আমার অভিপ্রায় হতে পারে না!
রণদীপ: একধরনের ছবিকে ‘আর্ট ফিল্ম’ বলে সরিয়ে রেখে তাকে নানাভাবে উন্নাসিক, ‘আঁতেল’ বলে দেগে দেওয়া কি একরকমের অগভীরতার বহিঃপ্রকাশ মনে করেন? যে কোনও সিরিয়াস বীক্ষা, মেধাচর্চার প্রতি একরকমের অবজ্ঞা?
ইন্দ্রাশিস: একেবারেই। প্রথমত, ‘আর্ট ফিল্ম’ শব্দবন্ধে আমার আপত্তি আছে। আমি ‘আর্ট ফিল্ম’ বানানোর চেষ্টা করি না। আমি আমার মতো করে ছবি বানাই। আমার মনে হয় বাস্তবের সময়ের সঙ্গে সিনেমার সময়কে মিলিয়ে দেওয়া গেলে ভালো হয়। আমি সিনেমা এভাবেই বানাব। এরকম সিদ্ধান্তের বা ক্রাফটের জন্য আমাদের মতো পরিচালকদের গায়ে নানারকম তকমা লেগে গেছে।
আসলে এখানে একটা কমফোর্ট জোন তৈরি হয়ে গেছে। কতগুলো উপকরণ চিহ্নিত হয়ে আছে, সেগুলো একটা ছবিতে ব্যবহার করলেই কিছু ঝটিতি মুনাফা বাঁধা। এই ধরনের নির্মাতারা কিন্তু শিল্পের থেকে ব্যবসা নিয়ে বেশি ভাবে, আগে ব্যবসায়িক রূপরেখা তৈরি করে সেইমতো ছবির ভাবনাকে গড়েপিটে নেয়। আমি তো ভাবনার স্তরেই ওরকম ব্যবসায়িক সমঝোতা করতে পারব না। ছবিটা লেখা হলে, তৈরি হলে, তারপর প্রযোজকের টাকা ফেরত দেওয়ার চিন্তা করা উচিত। কিন্তু ব্যবসা করা বা প্রচারে আসাই একটা ছবির উদ্দেশ্য হলে তো মুশকিল! দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের এখানে তা-ই হয়, ফলত একটা খেয়োখেয়ির জায়গা তৈরি হয়েছে। ইন্ডাস্ট্রির পরিসর ছোট, তারই মধ্যে যদি এরকম অবস্থা হয়, তাহলে পারস্পরিক সম্মানের জায়গাটা নষ্ট হয়। হচ্ছেও তা-ই।
রণদীপ: এই আবহটা আপনাকে ক্লান্ত করে?
ইন্দ্রাশিস: ভীষণভাবে ক্লান্ত করে। সসম্মানে কাজ করাটা খুব কঠিন হয়ে পড়ছে।
রণদীপ: আপনার ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রদের মধ্যেও একটা ক্লান্তি ধরা পড়ে। সেই ক্লান্তির উৎস হয়তো আলাদা, কিন্তু আপনার ছবির চরিত্রদের মধ্যে একটা সাধারণ যোগসূত্র হচ্ছে এই শ্রান্ত হয়ে যাওয়া। আপনার ক্লান্তি কি চরিত্রদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়?
ইন্দ্রাশিস: হ্যাঁ! ওই যে প্রথমেই বললাম, আমার চরিত্ররা আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই জন্ম নেয়। শুধু যে জিনিসটা আমি জানি না, যেখানে আমার অজ্ঞানতা— সেই শূন্যস্থানগুলোর ভরাট করতে আমি সাহিত্য, সিনেমার সাহায্য নিই। কাজেই আমার চরিত্রদের মধ্যে আমার ক্লান্তি তো সঞ্চারিত হয়ই (হাসি)।
রণদীপ: একজন যদি কেবলই শিল্পের কাছে সৎ থেকে সৎভাবে চর্চা করতে চান, সিরিয়াসলি কাজ করতে চান; তাঁকেও কি আপনার ছবির চরিত্রদের মতোই শেষতক একা হয়ে যেতে হবে?
ইন্দ্রাশিস: (ম্লান হেসে) আজকের পরিস্থিতিতে তো সেটাই ভবিতব্য মনে হচ্ছে। তুমি যদি প্রকৃতপ্রস্তাবে শিক্ষিত, মার্জিত হও, তোমাকে এই সমাজে একা হয়ে যেতে হবে। পরিত্রাণের কোনও পথ নেই।
এই যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এসেছে, মানুষ আরও একলা হবে। এখন ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ সংস্কৃতি শুরু হয়েছে, অফিস যাওয়ারও প্রয়োজন পড়ছে না। পাঁচবছর কাজ করার পরেও কেউ ম্যানেজারকে চেনে না, কারও প্রতি কারও কোনও সহানুভূতি নেই— এরকম পরিস্থিতি কিন্তু আর বিরল নয়। নিজের লোকের জন্য একজন যতটা চিন্তিত হন, একজন অপরিচিতের জন্যও ততটা উদ্বিগ্ন হন কি? নিজের কাজ সামলে একজনের আর লোকের সঙ্গে দেখা করার, কথা বলার ফুরসৎ কোথায়? সিনেমা-নির্মাতাদের ক্ষেত্রে তো সেটা আরও সত্যি! এই যে আমি ছবি বানাই, আমাকে সারাক্ষণ প্রযোজকের সঙ্গে দেখা করা, অন্যান্য কাজ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকতে হয়; নিজের পরিবারের লোকের সঙ্গেও আর ভালো করে আড্ডা হয় না কতদিন! ডাক্তারি-কর্পোরেট জীবন— সমস্ত ক্ষেত্রেই এই পরিস্থিতিটা সত্য।
রণদীপ: আপনার ছবিতে যেমন মানুষের একা হয়ে যাওয়ার বিষণ্ণতা ধরা পড়ছে, তেমনই বিপ্রতীপে একটা যৌথযাপনের চিত্রও আছে; সেই যৌথতা শেষতক ভেঙে পড়াও আছে— মূলত তা ফুটে উঠছে যৌথ পরিবারের মধ্যে দিয়ে। আজকের সমাজে যৌথতার ভেঙে পড়া কতটা ক্ষতিকর বলে মনে করেন?
ইন্দ্রাশিস: এটা আমি ঠিক বস্তুনিষ্ঠভাবে বলতে পারব না; এটা ব্যক্তির উপর নির্ভর করে। অনেকে যৌথ পরিবারে ভালো ছিলেন বা আছেন, অনেকে সঙ্গত কারণেই যৌথ পরিবার ছেড়ে দেন। প্রাইভেসিতে কেউ হস্তক্ষেপ করলে বা স্পেসের সমস্যা হলে তো যৌথ পরিবার ছাড়ার কথা ভাবতেই হবে। কখনও-কখনও এসব অসুবিধের সঙ্গে রোজগারের বৈষম্যজনিত সমস্যাও জুড়ে যায়। কেউ কম রোজগার করলে বাকিদের বেশি উপার্জন করে সেটাকে পুষিয়ে দিতে হয়, তাঁরাই বা সেটা আর মেনে নেবেন কেন! এরকম বহু খুচরো ঝামেলা উপস্থিত হয়। একসঙ্গে থাকতে পারলে তো ভালোই, কিন্তু থাকতে পারাটা অনেকগুলো শর্তের উপর নির্ভর করছে।
তবে কলকাতার যে পুরনো বাড়িগুলোয় অনেকে মিলেমিশে থাকতেন, সেই বাড়ির প্রতি আমার বেশ মায়া আছে, কিছু নস্টালজিয়াও আছে। সেগুলো আমি ছবিতে ধরে রাখার চেষ্টা করি। আবার ওই বাড়িতেই নানারকম অশান্তি হতে পারে, সেগুলো কি আর আমরা দেখতে পাই বা দেখতে চাই? দেখার তো অনেকগুলো দিক আছে, আমার যা ভালো লাগে আমি সেটাই দেখি। সেটা যেন কাউকে আঘাত না দেয়, এটাই ভাবনা থাকে।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশ নিজের জায়গা ধরে রাখতে পেরেছে; পশ্চিমবঙ্গ পারেনি : কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়
রণদীপ: অতীতগামিতা আপনার ছবির একটা বৈশিষ্ট্য। ‘নীহারিকা’-ই যদি বলি, গোটা ছবিটি দর্শক দেখে দীপার চোখ দিয়ে, তার স্মৃতিচারণের মাধ্যমে ছবিটি এগোয়। আপনার সব ছবিতেই অতীত একটা বড় ভূমিকা পালন করে, বর্তমানের সঙ্গে তার টানাপড়েন চলে। কখনও অতীতের ঠিকানা আঁকড়ে মানুষ বাঁচতে চায়, কখনও রহস্যের বীজ লুকিয়ে থাকে অতীতে। সিনেমা মাধ্যমটি কি আপনার কাছে অনেক কিছুর পাশাপাশি অতীতের আধারও, স্মৃতি ধরে রাখার মাধ্যম?
ইন্দ্রাশিস: হ্যাঁ। কিন্তু আমি নস্ট্যালজিয়াকে রোম্যান্টিসাইজ করি না। আমি মনে করি আমাদের জীবনে কুড়ি থেকে বাইশটা বছরই একটা মানুষ নিজের মতো করে, স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে পারেন; তারপর শারীরিক, সময়জনিত, অর্থনৈতিক বিভিন্ন বাধাবিপত্তি চলে আসে। সেই স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার সময়কালে যদি আমি কয়েকটা স্মরণীয় মুহূর্ত তৈরি করতে পারি, সেগুলো আমার কাছে অমূল্য রত্ন হয়ে থাকে। সেই মুহূর্তগুলোকে ছবির মাধ্যমে ছুঁয়ে ফেলতে চাই, ছবি করার কারণ এই একটাই; যে মুহূর্ত আমি আর কোনওদিন ফিরে পাব না, চরিত্রের মাধ্যমে, ইমেজের মাধ্যমে সেই মুহূর্তগুলো আরেকবার তৈরি করে ফেলতে চাই।
রণদীপ: আমার মনে হয়, মানুষ একা থাকলে বা নিজের সঙ্গে সময় কাটালেই অতীতের দিকে তাকায়। আপনি ছবি বানিয়ে আপনার কথাগুলো বলতে পারছেন, সকলের পক্ষে তো ভাব প্রকাশ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এই বিষণ্ণতা, স্মৃতিচারণ, অসহিষ্ণুতা কি একাকিত্বেরই দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি মনে করেন?
ইন্দ্রাশিস: একটা কারণ যদি একাকিত্ব হয়ে থাকে, আরেকটা হচ্ছে সুরক্ষার অভাব। নিজের এবং নিকটজনের সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ব্যাপারটা এখন এতটাই দুরূহ এবং জটিল, অন্য কারও কথা ভাবার সময় আর নেই। আমি একটা কথা বলি; বয়স হচ্ছে বলে নয়, এমনিই বলছি। আমরা আমাদের ছোটবেলায় যে শিক্ষিত, রুচিশীল, মেধাবী মানুষকে চারপাশে দেখেছি, সেই শ্রেণিটা এখন প্রায় বিরল হয়ে গেছে। এমন মানুষ একেবারে নেই তা নয়; কিন্তু তাঁরা পিছিয়ে এসেছেন।
এখন সময়টা বড় খারাপ। ভালো জিনিসের কদর আমাদের দেশে ক্রমশ কমে আসছে; রাজ্যে তো বটেই। আমি একা নই, আমার থেকে হাজারগুণে ভালো বহু মানুষ একই কথা বলছেন। তরল, চটুল জিনিসই স্বীকৃত হচ্ছে, এমতাবস্থায় কারই বা আর এগিয়ে এসে এসবে জড়াতে ভালো লাগে! দর্শককে যদি অগভীর জিনিস দেখিয়ে টিআরপি বাড়ানোই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে কী করে ভালো শিল্প হবে বলো তো? কেউ ভালো কাজ করলে সেটা মানুষকে দেখানোর জন্যই বা কেন এত কাঠখড় পোড়াতে হবে? এখানে এমন রাজনীতি শুরু হয়েছে, ভালো কাজ করে সম্মানটুকুও পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠেছে, বক্স-অফিস বা অন্যান্য তো ছেড়েই দিলাম।
পিউপা থেকে নীহারিকা| ইন্দ্রাশিস আচার্যর সিনেমাযাত্রা
— inscript.me (@inscript_dot_me) November 6, 2024
বিস্তারিত সম্পূর্ণ পর্ব কমেন্টে#bengalipodcast #podcast #cinema #niharika #pupa #indrashisacharya #independentfilmmaker #bengalifilm pic.twitter.com/LdNbl0q66I
তবে একেবারে নৈরাশ্যবাদী হচ্ছি না। অনেকেই ভালো কাজ করছেন নিজেদের মতো করে, তাঁরা করবেনও। সিনেমাও খুঁজে নেবে তার কাঙ্খিত দর্শক। আমিই তো কোনওরকম পৃষ্ঠপোষণ, সাহায্য ছাড়া ছ’টা ছবির শ্যুটিং করে ফেললাম, তার মধ্যে চারটে ছবি মুক্তি পেয়েছে। ভালো-খারাপের ঊর্ধ্বে উঠে এটাই এই পরিস্থিতিতে আমার সাফল্য: আমি চারটে ছবি রিলিজ করাতে পেরেছি; সেটা কিন্তু খুব বেশি মানুষ এখানে করতে পারেননি। আমার ছবিতে জনপ্রিয় হওয়ার উপকরণ নেই; দর্শকের কথা ভেবে ছবি বানাই, তা-ও নয়— তা সত্ত্বেও আমার চারটে ছবি মুক্তি পেয়েছে, চারটে ছবিই ওটিটি-তেও আছে।
রণদীপ: আপনার ছবি এতগুলো আন্তর্জাতিক, জাতীয় স্বীকৃতি পেয়েছে। তা সত্ত্বেও আপনার ছবির হল পেতে সমস্যা হয়, আপনার কথাবার্তা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে ছবি বানানোটা ক্লান্তিকর হয়ে পড়ছে। শুধুই নিজেদের মতো ছবি বানিয়ে কি একজন আর জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন না, তাঁকে কি একটা সমান্তরাল উপার্জনের বন্দোবস্ত করতেই হবে?
ইন্দ্রাশিস: এটা নির্ভর করছে ব্যক্তির ওপরেই— সে কীভাবে জীবন কাটাতে চায়, তার পারিবারিক সামর্থ্য কীরকম, সে কতজনের সাহায্য পাচ্ছে, এসব। আমি আমার কথাটা বলতে পারি। আমার একটা কর্পোরেট চাকরি ছিল, ছবি বানাতে গিয়ে কিছু অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় আমাকে সেই চাকরিতে ফিরে আসতে হয়েছে। অনেকে আবার শুধু ছবি বানিয়েই কষ্ট করে টিকে আছেন। তাঁরা কখনও সাফল্য পাচ্ছেন, কখনও হতাশ হচ্ছেন। প্রত্যেকেরই লড়াইটা আলাদা আলাদা, দিন শেষে নিজের লড়াই নিজেকেই লড়তে হবে। আমি তো ভালো রোজগার ছেড়ে ছবি করতে এসেছিলাম, ভেবেছিলাম নিজের এবং অন্যান্য স্বাধীন ফিল্মমেকারদের জন্য যদি কিছু করে উঠতে পারি, খুব ভালো হবে। কার্যক্ষেত্রে বহু স্বাধীন ফিল্মমেকারই আমাকে নানাভাবে সমস্যায় ফেলতে চেয়েছেন— কেউ কেউ সামনে প্রশংসা করে ছবির রেটিং কম দিয়ে আসছেন, কেউ আবার পিছনে নানারকম কুকথা রটাচ্ছেন। এত হিপোক্রেসি! আমি যে শুধু সিনেমা-সম্পর্কিত বিষয়গুলোতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি তা নয়, এই দ্বিচারিতা, অসম্মানও আমাকে হতাশ, ক্লান্ত করে তুলেছে। সব মিলিয়েই পরিস্থিতি আমার জন্য ছবি বানানোর পক্ষে খুব একটা অনুকূল নয়।
রণদীপ: ছবি বানানোর ক্ষেত্রে আপনি যে প্রতিবন্ধকতাগুলির সম্মুখীন হয়েছেন, সেই ব্যাপারে গিল্ডের কোনও সহায়তা পাননি? গিল্ডের থাকা, তাদের প্রোটোকল; ভূমিকা, তারা কতদূর সৃজনশীল কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে— এই মর্মে নানাবিধ কথাবার্তা আমরা বিভিন্ন ঘটনার সূত্র ধরে বিগত কয়েকমাসে শুনছি। আপনার সঙ্গে গিল্ডের ইন্টার্যাকশন কীরকম?
ইন্দ্রাশিস: গিল্ডের কিছু নীতিতে তো আমারও অসুবিধে হয়েছে। একেই ফান্ডের সমস্যা, তার ওপর গিল্ডের নিয়ম মেনে অনেকগুলো মানুষকে আমাদের নিতে হয়েছে; আমাদের সীমিত সাধ্যের মধ্যেই তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। প্রযোজকের উপর চাপ পড়েছে। কাজেই আমি গিল্ডের এই নীতিগুলোর সাংঘাতিকরকম বিরোধী।
কিন্তু এই বিরোধিতা সত্ত্বেও আমি নিয়ম মেনে কাজ করেছি। গিল্ডের সঙ্গে আমার সেই অর্থে কোনওদিন সেরকম কোনও সংঘাতও হয়নি। শুধু ২০১৪ সালে আমার একটা শর্ট ফিল্মের শ্যুটিং বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল কারণ আমি ক্যামেরায় বাইরের একজনকে নিয়েছিলাম। তখন অবশ্য এসব নিয়ম-টিয়মের কথা জানতামও না। কিন্তু গিল্ডের সঙ্গে ‘বিরোধ’ বলতে যা বোঝায়, তা কোনওদিন হয়নি।
রণদীপ: বাংলায় ছবি করতে গেলে সৃজনশীলতাটা আর প্রধান শর্ত নয় বলছেন?
ইন্দ্রাশিস: অনেক পরিচালক হয়তো এই কথায় আপত্তি করবেন কিন্তু আমি তোমার কথায় কিছুটা একমত। কারণটা বলি। যাঁরা এই বাস্তুতন্ত্রে সড়গড় হয়ে গেছেন, তাঁরা সৃজনশীলতাকে প্রাধান্য দিতে পারছেন। কারও যদি পরের ছবি পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে, তাঁরা মন দিয়ে কাজ করতে পারেন। আমার ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি। ছবি বানানোর সময় আমি সৃজনশীলতায় জোর দিই বটে, কিন্তু ছবি পাওয়ার পথটা আমার ক্ষেত্রে এতটা সুগম নয়। আমি কাউকে অসম্মান না করলেও আমাকে দুর্ব্যবহার সইতে হয়েছে। কেউ-কেউ আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ‘ছবি করব’ বলে চুপ করে গেছেন, কোনও আপডেট দেননি। এরকম বহু মানুষের সঙ্গে মোলাকাত হয়েছে। কাজেই, আমার তো বিবিধ অসুবিধে হয়েছে, হচ্ছেও। যাঁরা এই সিস্টেমে একটা স্থিতিশীল জায়গায় চলে গেছেন, তাঁরা সৃজনশীল কাজ করছেন এবং করে যাবেনও; টিকে থাকার জন্য হয়তো ব্যবসার কথাটা তাঁদের মাথায় রাখতে হচ্ছে— এইমাত্র।
রণদীপ: এই বাস্তুতন্ত্রে মানিয়ে নেওয়ার শর্তগুলো কী?
ইন্দ্রাশিস: (হেসে) কী জানি! জানলে তো আমিও একটা জায়গায় চলে যেতাম এতদিনে।
রণদীপ: বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে ক্ষমতা কি দিন শেষে কতিপয় প্রভাবশালী মানুষের হাতেই কুক্ষিগত হয়ে আছে বলে মনে করেন?
ইন্দ্রাশিস: তা আছে। লবিবাজি চলে, কিছু নেক্সাসও আছে। যাঁরা ছবির সাকসেস পার্টিতে যান, তাঁরাই সেই ছবিগুলোর রিভিউ লেখেন— এটা তো একটা ‘কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট’! অথচ এসব অদ্ভুত ব্যাপার এখানে হয়। কিন্তু আমার এগুলো নিয়ে অভিযোগ নেই, আমি তো আর এই পরিস্থিতি পাল্টাতে পারব না। এটা মেনে নিয়েই ছবি বানাই (হাসি)।
রণদীপ: তামিল, তেলুগু, মালয়ালম, মারাঠি, গুজরাতি, অসমিয়া ছবি যেভাবে ভারতের চলচ্চিত্র-মানচিত্রে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, বাংলা ততটা পারছে না। বাংলাদেশের ছবি আদৃত হলেও পশ্চিমবঙ্গের ছবি দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারছে না-ই বলা চলে। এমন অবস্থায় বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?
ইন্দ্রাশিস: এখানে কিন্তু প্রচুর মানুষ আছেন যাঁরা ভালো ছবি বানাচ্ছেন, বানানোর ক্ষমতা রাখেন— তাঁদের আরেকটু জাঁদরেল হয়ে উঠতে হবে। বর্তমান ব্যবস্থাকে ভেঙে, চুরমার করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা যদি হতে পারে, বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ বেশ উজ্জ্বল হবে। গুণগত মানের দিক থেকে কিন্তু ভারতে এখনও বাংলা ছবি এক থেকে তিনের মধ্যেই থাকবে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, ভালো কাজ করা মানুষগুলোকে চেপে দেওয়া হবে, ক্ষমতায় বসে থাকা মানুষগুলো সহজে সরবে না। বিপ্লব আর বিনোদন যেমন খুব কাছাকাছি থাকতে পারে না, মাসল-পাওয়ার আর রুচিও হাত ধরাধরি করে চলতে পারে না। নতুন ঝাঁককে উঠে আসতে হবে, তারা নিজেদের মতো করে সমস্ত নিয়ম ভেঙে ছবি করুক। বিনোদন থাকুক না, তাদের ছবিতেও ভরপুর বিনোদন থাকুক! কিন্তু দিন শেষে ‘শুধু বিনোদনই দেখতে হবে’, এমন নিদান দেওয়ার পরিস্থিতি যেন না তৈরি হয়। বক্স অফিস তো থাকবেই, কিন্তু সেটা মাথায় রেখেই আন্তর্জাতিক মানের ছবিও বানাতে হবে— যা কালোত্তীর্ণ হতে পারে। ভালো ছবিরও দানবীয় প্রচার লাগবে, সেগুলো একপাশে পড়ে থাকলে উন্নতি হবে না। সমস্ত ছবি যদি একইভাবে প্রচারিত হয়, তাহলে আপনাআপনিই ‘সার্ভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট’-এর পরিস্থিতি তৈরি হবে, শ্রেষ্ঠতম শিল্পগুলো থেকে যাবে। এখন কিন্তু সার্ভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট-এর পরিসর এখানে নেই, এখন গুণগত মানের থেকে বড় নির্ধারক হচ্ছে ক্ষমতা, ব্যাকিং— এগুলো। এটা বদলাতে হবে। এই বিষয়গুলো যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বাংলা ছবির উন্নতি সম্ভব; না হলে খুব একটা আশা দেখছি না।
আরও পড়ুন- অনুরাগ ‘ঘটিয়া’ না বললে যেন জানাই হত না
রণদীপ: দানবীয় প্রচারের জন্যও তো প্রয়োজন পুঁজি, তার জন্য তো ছবিটাকে বক্স অফিসেও সফল হতে হবে। ব্যাপারটা একটা প্যারাডক্স নয় কি...
ইন্দ্রাশিস: (থামিয়ে) না, প্যারাডক্স নয়। আমাদের এখানে সাফল্যের মানদণ্ডটা তো সমান নয়। সব ছবিকে সমান শো দিলে তো আমি বিচার করতে পারব কোন ছবি কতটা সফল। একটা ছবি পাঁচশো শো পেল, আরেকটা ছবি কুড়িটা; কেমন করে দুটো ছবির তুল্যমূল্য বিচার করা হবে?
এরই সঙ্গে বলি, প্রচারটাও একজন ফিল্মমেকারকে শিখতে হবে। ‘আমি ব্যবসা বুঝি না’ ‘আমি কমার্স বুঝি না’ এই মনোভাব নিয়ে চললে হবে না। তুমি একজনের টাকায় ছবি বানিয়ে এই কথাগুলো বললে তো সেটা ভয়ঙ্কর বাজে কথা বলা হলো! অনেকে নিজেই প্রচার করে, বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম ব্যবহার করে নিজেদের জায়গাটা নিজেরা তৈরি করে নিয়েছেন, হ্যাটস অফ টু দেম! এই জোরটা থাকতে হবে, এই দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার সাহস থাকতে হবে। এইভাবে লোকের কাছে পৌঁছে যাওয়ার জেদটা ভীষণ দরকার। ছবি লোকের কাছে পৌঁছনোর পর তাঁদের কেমন লাগল, সেটা পরের কথা। কিন্তু ছবিটাকে তো অন্তত তাঁদের কাছে পৌঁছেতে হবে, সেটা তো ন্যূনতম শর্ত! সাতদিন একটানা সাতশোটা লোক দেখলে ধীরে ধীরে দর্শকসংখ্যা বাড়বে, কিন্তু একটা ছবির ক্ষেত্রে তা হয়ই বা কোথায়!
এখানে দর্শকের কথাও বলব। কোনও হলে দশজন, কোনও হলে কুড়িজন, কোনও হলে তিনজন করে ছবি দেখেন, কারণ তাঁরা দর্শক হিসেবে নিজেদের কমফোর্ট জোন থেকে বেরোতে চান না। তাঁরা ওই মাথায় কতকগুলো খোপ বানিয়ে বসে আছেন: এটা ‘আর্ট ফিল্ম’, ওটা ‘আঁতেল ছবি’ এরকম। এগুলোর কোনওটাই তো ছবির মানদণ্ড হতে পারে না! তাঁরা সেইসব ছবিই দেখতে আসেন, যা তাঁদের একটু সুখ দেবে, স্বস্তি দেবে। প্রচারের ঝলকানিতে প্রভাবিত হয়ে ছবি দেখতে আসেন।
প্রযোজকদেরও একটু এগিয়ে এসে ঝুঁকি নেওয়া দরকার। আগে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, অজয় কর— এঁদের সঙ্গে কত প্রযোজকও জুড়ে ছিলেন। এখন প্রযোজকরাই বা ঝুঁকি নেন কোথায়!
রণদীপ: আমরা সাক্ষাৎকারের একদম শেষ পর্বে চলে এসেছি। শেষ প্রশ্ন। ইন্দ্রাশিস আচার্য্য কী চান, দর্শক তাঁকে কীভাবে মনে রাখুক?
ইন্দ্রাশিস: (একটু ভেবে) দর্শক আমাকে একজন সংবেদনশীল, সৎ ফিল্মমেকার হিসেবেই মনে রাখুক। আমি সেই চেষ্টাই করি, কতটা পারলাম তা তাঁরাই বিচার করুন না হয়। আমার ছবিগুলো থাক, ভবিষ্যতে আরেকটু বড় জায়গায় পৌঁছক, আরেকটু মানুষের সান্নিধ্য পাক— এটুকুই চাওয়া।
রণদীপ: ‘ইনস্ক্রিপ্ট’-কে এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ জানবেন ইন্দ্রাশিসদা। আপনার ভবিষ্যতের জন্য অনেক, অনেক শুভেচ্ছা রইল।
ইন্দ্রাশিস: শুভেচ্ছা তোমাদেরও। কথা বলে খুব ভালো লাগল। ভালো থেকো।