আলোহীন, বর্ণহীন জীবন কীভাবে কাটে? অন্ধের বিশ্বে পৌঁছে দেয় এই জাদুঘর

See World Through Blind Perspective: একটা অন্ধকার ঘরে আমাদের চারজনকে নিয়ে যাওয়া হলো। এমন অন্ধকার আমি আর কখনও দেখিনি।

"জন্মান্ধ মেয়েকে আমি জ্যোৎস্নার ধারণা দেব বলে
এখনাে রাত্রির এই মরুভূমি জাগিয়ে রেখেছি।"

যে একবার দেখেছে, শতবার দেখেছে, তাকেও কি নিরাকার জ্যোৎস্নার ধারণা দেওয়া সহজ? কী বলা যায়- সে স্নিগ্ধ শুভ্র? শিরশিরে, ছমছমে? কোজাগরী? তার রঙ কী? রূপ কেমন, শব্দ কী? তার গন্ধই বা কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? জ্যোৎস্নার মাঝে দাঁড়িয়ে ভালো লাগে না মন্দ? পাহাড়ে জ্যোৎস্না আর সমুদ্রের বুকে পূর্ণচন্দ্রালোক, এক না ভিন্ন? সহস্র বৈশিষ্ট্য জুড়েও কি জ্যোৎস্নার ধারণা নিয়ে দশ নম্বরের সংক্ষিপ্ত রচনা অথবা বিস্তারিত বিশ্লেষণ সম্ভব?

স্বভাবত যা চোখে দেখে অভ্যেস, দৃষ্টি ছাড়া তার অভিজ্ঞতা সম্ভব? চোখের দেখায় বিশ্বাস করতে করতে দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ তার অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলি প্রায় ভুলতে বসেছে। অপরদিকে, এই দৃষ্টিমুখর পৃথিবীতে জন্মান্ধ বা আংশিক দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষজন কীভাবে দিন কাটান, তার ধারণা আমাদের দেবে কে? আজ ছাতা নিয়ে বেরোতে হবে কিনা, গলির মোড়ে রাস্তা কেটে গোটা অক্ষরে 'সাবধান' লেখা থাকলে কার লাভ, কত নম্বর বাস এল, নিত্যদিনের এমন সব কাজ এবং আরও নানা জরুরি কিছু আমরা প্রায় যান্ত্রিক নৈপুণ্যে করে থাকি, দু'বার ভাবতেও হয় না কারণ আমাদের জগৎটা গড়ে উঠেছে দৃষ্টিসম্পন্ন সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রয়োজনে। অনেক বিমানবন্দরে নতুন নিয়ম করে মাইকে ঘোষণা বন্ধ হয়েছে। জরুরি সব তথ্য বিশাল স্ক্রিনে দেখানো হবে৷ এই পরিবর্তনে এতদিন বেশ খুশিই ছিলাম। লম্বা লে-ওভারে নিশ্চিন্তে কাজ করা যায়, চাইলে ছোট করে একটা ঘুম! কিন্তু সবাই কি এই তথ্যসঞ্চারে অন্তর্ভুক্ত? যারা স্ক্রিনগুলি দেখতে পাচ্ছে না? তারা ধরতে পারবে তো নির্দিষ্ট সময়ের বিমান?

তর্কের খাতিরে বলা যেতে পারে, দৃশ্যত তথ্যের আড়ালে থাকা মানুষ অন্যের সাহায্য নেবে। অর্থাৎ, অন্যের দৃষ্টিশক্তির উপর নির্ভরশীল কিছু মানুষ অনিশ্চয়তায় জীবন কাটাবে। প্রতি মুহূর্তে সে বুঝতে পারবে সমাজটা অন্য নিয়মে গড়া, যেখানে তাদের ঠাঁই নেই, একা চলাফেরায় নানা অসুবিধা, যেগুলির কথা আর কেউ গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে না, বরং সমাধান হিসেবে অন্য আরেক নির্ভরশীলতার উপদ্রব চাপিয়ে দিয়ে মনে করিয়ে দিচ্ছে তোমার ক্ষমতা সীমিত। অন্য অনেক বিষয়ের মতো এই দেখা না-দেখার বাইনারি বৈষম্য তৈরি করে। কিন্তু এই ক্রমবর্ধমান বিভেদ ঘুচিয়ে সমবেত সমাজগঠনের প্রচেষ্টা বিরল।

আরও পড়ুন- অন্ধত্বর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অবসাদ, কেমন আছেন ভারতের দৃষ্টিহীন মানুষরা?

বিজ্ঞানের জগতে এ বিষয়ে প্রচুর কাজ হয়। ধরা যাক, লাল রঙ যদি কোনওদিন দেখতে না পাই, 'লাল গোলাপ' শব্দবন্ধ শুনলে আমার কেমন অভিজ্ঞতা হবে? নিউরোকগনিটিভ পরীক্ষা নিরীক্ষায় লাল রঙের অনুষঙ্গে এক ধরনের শব্দ, নীল রঙের পরিবর্তে অন্য ধরনের শব্দ- এ ভাবে নানা রঙের বদলে নানা শব্দ শুনিয়ে দৃষ্টিহীনদের মস্তিষ্কে রঙের শেডকার্ডকে শব্দের অভিধান দিয়ে প্রতিস্থাপন করে দেখানো গেছে, কোনও এক ইন্দ্রিয় থেকে বাধা এলে কীভাবে অন্য ইন্দ্রিয় তার জায়গায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে মস্তিষ্কে অভিজ্ঞতার প্রসার ঘটায়। ঠিক যেভাবে দৃষ্টিশক্তি হারানোর পর রে চার্লস স্পর্শের মাধ্যমে ব্রেইল নোটেশন ব্যবহার করে পিয়ানোয় সুর তুলতেন। এক্ষেত্রে, দৃষ্টির বদলে স্পর্শ দিয়ে স্বরলিপি অনুবাদ হচ্ছে। অন্য কেউ একই নোটেশন চোখে দেখে রে চার্লসের গান বাজাতে পারবে। বধির মানুষের কাছে শ্রবণযোগ্য অভিজ্ঞতা কীভাবে দৃষ্টি বা স্পর্শের মাধ্যমে সহজলভ্য করা যায় তা নিয়েও গবেষণা চলে। মুশকিল হলো, এইসব কাজ এবং কাজের ফলাফল সচরাচর বিজ্ঞানের পরিসরের বাইরে বেরোয় না। নতুন কিছু জানা গেল, তা নিয়ে আর কতদূর এগোনো যায়, এবং নানাবিধ মূল্যায়নের পরেও বৃহত্তর সমাজে তার প্রয়োগ যে এ পৃথিবীকে সকলের জন্য আরও একটু বাসযোগ্য করে তুলতে পারে, সে নিয়ে আমাদের ভাবনার ঘাটতি আজও রয়েছে। অথচ এই ধরনের তথ্য এবং তার প্রয়োগের উপকারিতা জনসমাজে সহজলভ্য হলে তার ফল যে সুদূরপ্রসারী, তা নিজের অভিজ্ঞতায় জেনেছি।

আজ নিঃশব্দ বিমানবন্দরে বসে একটু খারাপ লাগছে। দেখছি আমার ফ্লাইটের সময় কেবল পিছিয়ে যাচ্ছে। নতুন সময়, কোন গেট থেকে ছাড়বে সব হালহকিকত কেবল দেখতে পাচ্ছি। শুনতে পাচ্ছি না। চোখে যদি দেখতে না পেতাম আমায় এসব কে বলে দিত? ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিচ্ছি আশেপাশে এমন কেউ আছে কিনা, যার সাহায্য প্রয়োজন৷ তাদের খবর দেওয়ার কী ব্যবস্থা রয়েছে এসব নিয়ে চিন্তা করছি। এমন সংবেদনশীলতার হঠাৎ অবির্ভাবের আসল কারণ সম্প্রতি এক অভিনব জাদুঘর ভ্রমণ।

হল্যান্ডের ছোট্ট শহর, নাইমেঘেন। ধনী দেশের ধনী শহর, নামী ইউনিভার্সিটি, নামকরা লোকজন কাজ করে। এখানে মানুষের চিন্তাভাবনা উদার, বিচিত্র, বহুমুখী। পুরনো শহর চত্বরে এক জাদুঘরে এরা আঁধারে আলো খোঁজার ব্যবস্থা করেছে। জাদুঘরের কর্মচারীরা কেউ সম্পূর্ণ, কেউ আংশিকভাবে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। ঢুকতেই জানিয়ে দেওয়া হয়, গাইডকে যে কোনওরকম প্রশ্ন করা যেতে পারে। দৃষ্টিশক্তিকে কতভাবে প্রতিস্থাপিত করে তাঁরা দৈনন্দিন কাটান সে গল্প ভাগ করে নিতে তাঁরা সদাই উৎসুক। করিডরে ব্রেইল লেখাপড়া শেখার সুবিধা রয়েছে, ব্যস্ততার ফাঁকে ব্রেইল শেখার টুকটাক টিপস দিয়ে দিচ্ছেন গাইডরা। এমনকী, প্রিয়জনকে ব্রেইলে চিঠি পাঠানোর ব্যবস্থাও রয়েছে। পাশের টেবিলে রাখা নানা রকম বোর্ডগেম। সন্ধ্যায় বাড়িতে বন্ধুদের সঙ্গে বোর্ডগেম খেলার প্রচলন এসব দেশে। সাধারণত খেলাগুলিতে ঘুঁটির রঙ বা আকারের খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। কীভাবে স্পর্শ আর শব্দ ব্যবহার করে দৃষ্টিহীনদের মনোরঞ্জনের উপযোগী বোর্ডগেম বানানো হয়েছে, ঘুরে দেখা হলো। চোখ বন্ধ করে খানিক খেলাও হলো। এরপর, আসল জাদুঘর ভ্রমণ৷

আমাদের একটা করে সাদা লাঠি দেওয়া হলো, যার নীচে স্টিলের ছোট গোলোক বসানো। মাটিতে ঘষে ঘষে বুঝে নিতে হয় জমির উঁচু চিচু, রাস্তা কোথায় ছোট হলো, কোথায় বাঁক নিল, কোথায় চারমাথার মোড় ইত্যাদি। বোঝানোর জন্য রাস্তাঘাটে লাইন কেটে চিহ্ন করা থাকে। এতদিন কেবল দেখেছি, তাৎপর্য বুঝিনি। হয়তো তেমন পাত্তা না দিয়ে এই দিকনির্দেশক চিহ্নের উপর দাঁড়িয়ে পথ রোধ করে আড্ডা দিয়েছি। ভেবে দেখিনি, কত পথচারি রাস্তার বুকে খোদাই করা এবড়োখেবড়ো এই চিহ্নগুলি লাঠিতে ছুঁয়ে বুঝে নিচ্ছে ডানদিক বাঁদিক। মাঝপথে বাধা পড়লে তাঁর ম্যাপ সম্পূর্ণ গুলিয়ে গিয়ে নতুন করে শুরু করতে হয়। ভাবিনি তো! আমাকে এর আগে ভাবতে শেখানোও হয়নি তো!

আরও পড়ুন- ট্রামের ভেতর জাদুঘর! অসম্ভব সম্ভব হয় কলকাতায়

একটা অন্ধকার ঘরে আমাদের চারজনকে নিয়ে যাওয়া হলো। এমন অন্ধকার আমি আর কখনও দেখিনি। ঘন অন্ধকার বোঝাতে তিমি মাছের পেটের ভেতর ঢুকে পড়ার উপমা পড়েছিলাম, এ যেন সেরকম। আমাদের গাইড, নাম জন উইলিয়াম, আলাপ পর্ব শুরু করেছেন, এর মধ্যেই আমাদের একজন ছটফট করে ঘর ছেড়ে চলে গেছেন। কিছুতেই ধাতস্থ হতে পারছেন না এত অন্ধকারে। তাঁর অস্বস্তি হচ্ছে, কথা বলতে পারছেন না, শুনতে পারছেন না, বুঝতেও পারছেন না। আতঙ্কিত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। বাকি রইলাম তিনজন। একে অপরের গায়ে হাত ঠেকিয়ে দূরত্ব বুঝে নিচ্ছি। জন উইলিয়াম সহজভাবে বলছেন, এবার ডানদিকে ঘুরে 'দেখুন' বসার জায়গা। ওর মুখে 'দেখা' শব্দ শুনে আশ্চর্য লাগছে, আমাদের মুখের ভাষাও কেমন দৃষ্টিনির্ভর! মনে পড়ল, বধিরদের শরীরী ভাষায় 'শোনা' শব্দের জায়গায় তারা চোখের চারিদিকে আঙুল গোল করে মুদ্রায় 'কানে শোনা' বোঝায়।

জন উইলিয়ামের নির্দেশ শুনে স্বাভাবিক নিয়মে ডানদিক-বাঁদিক করতে পারছি না! কী আশ্চর্য! জন উইলিয়াম কোনদিকে তাকিয়ে, আমি দেখতে পাচ্ছি না। অতএব তিনি ডানদিক বলতে কোনদিকে যেতে বলছেন আমি কী করে বুঝব? আমার অভিধানে দিক নির্দেশকারী সমস্ত শব্দ একে একে ভেঙে পড়ছে, অর্থহীন তাদের অস্তিত্ব। টের পাচ্ছি, আমার নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে যাচ্ছে, আমিও কি এবার প্যানিক করছি?

জন উইলিয়াম একটা চেয়ারে বসতে বললেন। ওঁর কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে চেয়ার খুঁজে বসলাম। জানতে চাইলেন, আমার চোখ খোলা না বোঁজা। খোলা তো, যতটা সম্ভব বড় করে খুলে রেখেছি চোখ, যেন যত বেশি বিস্ফারিত ততখানি সম্ভাবনা ক্ষীণতম আলোকরশ্মি খুঁজে পাওয়ার। তাও খুব অস্বস্তি হচ্ছে। জন উইলিয়াম শুনে বললেন, এইখানেই ভুল করছি! চোখ খোলা মানে আমার মস্তিষ্ক ভাবছে এইবার চোখে আলো পড়ে কিছু স্নায়ুকোষ উত্তেজিত করে দেখার অনুভূতি হওয়ার কথা। কিন্তু হচ্ছে না। মস্তিষ্ক অপেক্ষা করছে, কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে তার প্রত্যাশা মিলছে না দেখে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। একইসঙ্গে, প্রবল ভয় পাচ্ছে। প্যানিক করছে। চোখ বুঁজে থাকতে বললেন জন উইলিয়াম। ভাবছি, একে অন্ধকার তায় চোখ বন্ধ, ইয়ার্কি নাকি! অথচ, কী হাস্যকর এমন ভাবনা! কী বা দেখতে পারি এমন নিকষ চরাচরে!?

চোখ বন্ধ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পেলাম হৃৎপিণ্ডের চলন স্বাভাবিক হলো, ভয় কমে এল, মস্তিষ্ক জানে, চোখ বুঁজলে 'দেখা' যায়না, তাই সেও খানিক নিশ্চিন্ত। রে চার্লস জীবনের প্রথম সাতটি বছর দেখতে পেতেন, পরবর্তীকালে চোখ বন্ধ করে বাজনায় বসতেন। সে কি তার মস্তিষ্ককে শান্ত করার কৌশলই?

লাঠি ছুঁয়ে ঘরের মাপজোক বুঝে পা ফেলছি। জাদুঘরে মজার ব্যবস্থা, তারা ঘরটিকে সাজিয়েছে যেন প্যারিস ভ্রমণে বেরিয়েছি। দেওয়ালের গায়ে আমার হাত রেখে জন উইলিয়াম বলল, ছুঁয়ে দেখো, কী লেখা আছে। পড়লাম, কোনদিকে যেতে হবে তার নির্দেশ লেখা। লাঠি বলছে দুটো সিঁড়ি উঠে কাঠের সাঁকো। সাঁকো পেরিয়ে বোর্ডের সামনে এনে জন উইলিয়াম বলছে দেখো তো চিনতে পার কি না, প্যারিসের কোন পাড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছ। হাত বুলিয়ে বুঝি আইফেল টাওয়ার। এখানে 'দেখা' মানে ছুঁয়ে বা শুনে বোঝা, এ কথা আমার কাছে পরিষ্কার। কিছুটা স্বচ্ছন্দ বোধ করছি। এরপর নৌকোভ্রমণ কখনও জোয়ার, জল কখনও শান্ত। জন উইলিয়াম বলছে, দেখতে পাচ্ছ, ওই দূরে সিগাল। শুনতে পাচ্ছি দূর থেকে ভেসে আসছে সিগালের ডাক। কাছে এল, আবার পিছন দিকে দূরে মিলিয়ে গেল। চলমান দৃশ্য আমার কাছে সাউন্ডস্কেপের ওঠাপড়া। ল্যুভ-এ ঢুকলাম। জানলাম, বছরের একদিন দৃষ্টিহীনদের জন্য ল্যুভের সমস্ত ছবি বা ভাস্কর্য ছুঁয়ে দেখার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু, বছরে মাত্র একদিন? লক্ষ লক্ষ দৃষ্টিহীন মানুষের ল্যুভ যাওয়ার সম্ভাবনা মাত্র একদিন। বাকিদের জন্য সারাবছর!

এবার আমরা ঢুকলাম পছন্দসই জামাকাপড় বাছতে। নানা ডিজাইনের জামা জুতো ব্যাগের বুটিক। ছুঁয়ে ছুঁয়ে আকার বা স্টাইল বোঝা গেলেও রঙ বুঝব কী করে? জন উইলিয়াম জানতে চাইল, অন্ধজনের পোশাকের রঙে কী বা আসে যায়? গুরুত্ব আছে বইকি! রঙ আমি দেখতে পাই না, কিন্তু রঙের শব্দের নিরিখে প্রিয় অপ্রিয় বাছতেই পারি। ধরা যাক 'লাল' শুনতে আমার ভালো লাগে না, বরং 'সাদা' শব্দটি আমার প্রিয়। আমি সাদা জামা পরতে চাই। শোকের বাড়িতে যাওয়ার আগে আমাকে বেছে নিতে হবে কালো পোশাক। শুনেছি, নীল রঙ পরলে মানুষের ব্যক্তিত্বে প্রশান্তি ফুটে ওঠে, আমি চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাব নীল স্যুট পরে। কিন্তু কে বেছে দেবে আমার জামার রঙ? হল্যান্ডে একটি অ্যাপের মাধ্যমে সাহায্য নেওয়ার উপায় করা হয়েছে। ভিডিওকলের মাধ্যমে দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষরা বেছে দেবে পছন্দসই রঙের পোশাক। কেবল পোশাক নয়, নিয়মিত সঠিক ওষুধ বেছে দেওয়ারও একই ব্যবস্থা রয়েছে। যে কোনও ইচ্ছুক নাগরিক এই কাজটি করতে পারেন। সাহায্য করার ইচ্ছাটুকু থাকাই যথেষ্ট। এই ধরনের সুবিধাগুলি ভিন্ন অভিজ্ঞতার জগতের মধ্যে সেতু স্থাপন করে একে অপরকে বোঝার পরিসর অনেকখানি বাড়িয়ে দিতে পারে।

আরও পড়ুন- কেন এত জনপ্রিয় ফরাসি চুম্বন?

রঙ নিয়ে কথা চলছে, জন উইলিয়াম বলে সে গাঢ় রঙের পোশাক পছন্দ করে কারণ পেশায় সে একজন চিত্রকর। শুনে থমকে যাই, কৌতূহলবশত দেখতে চাই ওর আঁকা। আমার দ্বিধা বুঝে জানায়, ওর দু'চোখে ১৫-২০ শতাংশ দৃষ্টি। এক একটা ছবি আঁকতে অনেকদিন সময় লাগে। মূলত পোর্ট্রেট পছন্দ, দেখাল, দেড় মিটার দূরত্ব থেকে আঁকা নিজস্বী। এরপর তিন মিটার, চার মিটার দূরত্ব থেকে আঁকা অন্যদের মুখচ্ছবি। মডেল যত দূরে যাচ্ছে জন উইলিয়ামের রেখা অস্পষ্ট হচ্ছে, ঝাপসা হয়ে মিশে যাচ্ছে রঙের সীমা। তৈরি হচ্ছে এক অভিনব চেতনা যেন ছবির বিষয় সামনে বসে থাকা মডেল বা তার পারিপার্শ্বিক নয়। ছবির বিষয় আক্ষরিক অর্থেই জন উইলিয়ামের দর্শন।

ট্যুর শেষে বসে আছি জাদুঘরের অপেক্ষা কক্ষে। ব্রেইল টাইপরাইটারে চিঠি লিখলাম মা-বাবাকে। ভাবছি দেওয়ালের ওপারে জন-উইলিয়াম সব কেমন স্পষ্ট 'দেখতে' পাচ্ছিল - ক' পা এগোলে দেওয়ালে ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা, ভিনাসের ভাস্কর্যে কতগুলি ভাঁজ। ১ পয়সার কয়েন থেকে ৫ পয়সার আলাদা করার গঠন বৈশিষ্ট্য। আমি কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। শোনার বা স্পর্শের অপেক্ষায় আমার পৃথিবী ধীর লয়ে চলেছে, কখনও স্থবির। অনেকটা অনিশ্চিত। প্রবল ভয়ের। জাদুঘরের বাইরে জন উইলিয়াম আর ওর সহকর্মীদের যেমন রোজ হয়। দেওয়ালের এপার-ওপারে ঘটে যাওয়া সাময়িক ভূমিকা বদলে আমার সামনে খুলে গেল নতুন এক জগৎ। নতুনভাবে জগৎ দেখার ভিন্ন ক্ষমতা। শরীরী ভাষা শেখার সময়ে যেভাবে শিখেছিলাম অন্যরকম এক বাঁচার উপায়। এমন অভিজ্ঞতার পর অবাক হয়ে ভাবি নিজের বেশিভাগ ইন্দ্রিয়গুলি কাজে না লাগিয়ে কেমন অর্ধেক বেঁচে আছি যেন। পুরোটা শিখতে চাইলে নিজেকেই সম্পূর্ণরূপে আবিষ্কার করার দিকে একটু এগিয়ে যাওয়া যাবে। অপরদিকে, অন্যের ভূমিকায় কিছুক্ষণ বাঁচতে চাইলে জীবনের নানান ফাঁকফোঁকরগুলি বুঝে নিতে সুবিধা হবে। অন্যের অসুবিধা নিজের মনে হবে। বিকল্পভাবে সক্ষম মানুষদের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে উঠবে মন। সকলের সুবিধা অসুবিধা স্পষ্ট হলে তাদের সমাধান এক জায়গায় করে সমবেতভাবে সমাজ গড়া যাবে, যেখানে কেউ নিজেকে অযাচিত মনে করবে না। শরীরী অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বাধাবিপত্তি অনুভব না করলে সহানুভূতিশীল হয়তো হওয়া যায়, সংবেদনশীল বা সহমর্মী হওয়া যায় না। আর, চির-বৈষম্যের এ সমাজে সহমর্মিতা ছাড়া সাম্য স্বপ্নাতীত।

 

More Articles