বইমেলায় অনন্য রায় বললেন, 'আপনাকে একটু একটু নকল করি'

বইমেলায় প্রথম দেখেছিলাম কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-কে। মেলায় তখন এখনকার মতো ভিড় হত না। এখন যেমন গায়ে গায়ে লোক চলতে থাকে, তখন ছিল না তেমন। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। পাজামা আর পাঞ্জাবি পরনে। কাঁধে একটি ঝোলা। কবি-কে ঘিরে আমারই মতো তেইশ-চব্বিশ বছরের কিছু ছেলের দঙ্গল। কোনও কোনও লোক এগিয়ে গিয়ে কিছু বলছে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’কে। তিনি তাঁর কাঁধের ঝোলা থেকে একটি শীর্ণকায় নরম মলাটের পুস্তিকা এগিয়ে দিচ্ছেন সেই ব্যক্তিদের দিকে। ক্রেতা দাম দিচ্ছেন, একটু হাসি বিনিময়ের পর সদ্য কেনা পুস্তিকাটির পাতা উল্টে দেখতে দেখতে আবার হাঁটতে শুরু করছেন সেই ব্যক্তি। অর্থাৎ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজেই বইমেলার মাঠে দাঁড়িয়ে নিজের বই বিক্রি করছেন। সে-কাজে তাঁর কোনও সংকোচ নেই।

আমারও লোভ হল। এগিয়ে গেলাম। বললাম, ‘নতুন কী বই বেরিয়েছে এবার?’ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ঝোলার ভেতর হাত ঢুকিয়ে তিনটি ছোট পুস্তিকা দেখালেন আমায়। তিনটিই কিনে নিলাম। নামগুলি এখনও মনে আছে: ‘ন্যাংটো ছেলে আকাশ দেখছে’, ‘নীলকমল লালকমল’, ‘দিবস রজনীর কবিতা’। তারপর প্রণাম করলাম, উনি বললেন, ‘থাক থাক থাক, থাক। কী নাম তোমার?’ বললাম। ‘লেখো?’ উত্তর দিলাম, ‘তেমন কিছু নয়। একটু-একটু চেষ্টা করি।’ চারপাশে আমারই বয়সি যেসব ছেলেরা দাঁড়িয়েছিল, তাদের একজন তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল, '‘দেশ'-এ তোমার কবিতা বেরিয়েছে না?’ মাথা হেলিয়ে দিলাম। ছেলেটি বলল, ‘তাহলে বীরেনদার কাছে এসেছ কেন?’ উনি বললেন, ‘থাক, থাক। কী হয়েছে এসেছে তো? কী ক্ষতি?’ একটু হাসলেন, মানুষটি সুদর্শন নয়, কিন্তু হাসিটি স্নিগ্ধ। আমি মাথা নিচু করে তাঁর সামনে থেকে সরে এলাম।

অবশ্য বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শীর্ণকায় বইগুলি এই প্রথম কিনছি না — কলেজ স্ট্রিটের ‘পাতিরাম’ থেকে তাঁর সব বই-ই বেরনোমাত্রই কিনে নিই। মেলার মাঠে ওঁকে আগেও দেখেছি, আজ কেমন একটা ঝোঁক চাপল সামনে যাওয়ার।

এরপরেও ওঁকে দেখেছি — মেলায়। সেই ছেলেদের জটলাটিও থাকত ওঁকে কেন্দ্র করে। আর কোনওদিন মেলায় ওঁর সামনে যাইনি। আমি সমস্ত মেলাটাই হেঁটে ঘুরতাম। তবে বই কিনতাম কম। কিনতাম লিটল ম্যাগাজিন। বই কেনার জন্য কলেজ স্ট্রিট তো আছেই, সেখানে কুড়ি পার্সেন্ট ছাড় পাওয়া যায় ‘কথা ও কাহিনী’ এবং ‘দে’জ পাবলিশিং’-এ ঢুকলে।

কাকদ্বীপ থেকে বইমেলায় আসতেন ছয়ের দশকের কবি শামসুল হক। এঁকে অনেকে বাংলাদেশের কবি, ঔপন্যাসিক, নাটককার সৈয়দ শামসুল হক ভাবত। শামসুল হক কাকদ্বীপ থেকে সঙ্গে অনেক নতুন লিখিয়ে ছেলেদের নিয়ে আসতেন। মেলার শেষ দিনটিতে আমি তাঁর টেবিলের সামনে যেতাম। শামসুল হক বলতেন, ‘আজ মেলা শেষ— আজ সব বই, সব পত্রিকা আমরা ফিফটি পার্সেন্ট ডিসকাউন্টে দিচ্ছি।’ যা পারতাম, কিনে নিতাম। দুটো ঝোলা ভরে যেত বইমেলা থেকে বেরনোর সময়। লিটল ম্যাগাজিনের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়ে যেত। যেমন, অনন্য রায়। বইমেলার শেষ দিনে এসেছেন। হাতে একটা বই। নিজেরই লেখা। নাম: ‘আমিষ রুপকথা’। আমার নাম শুনে বললেন, ‘ও, আপনিই জয়? আমি আপনাকে একটু একটু নকল করার চেষ্টা করি।’

আমি স্তম্ভিত, মিষ্টি হেসে কথাটি বলেছেন অনন্য। কিন্তু, তাঁর কবিতার সঙ্গে তো আমার পরিচয় আছে। এই ‘আমিষ রুপকথা’ বইও আমার পড়া। কই? আমার লেখার সঙ্গে একবিন্দু মিল নেই তো সেই বইয়ের! তাহলে? অনন্য একটি টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এই বইটি একটু রাখবেন কি?' তখন অনন্য রায় যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছেন, কবি হিসেবে তিনি প্রথম থেকেই নিজের স্বরে কথা বলেন। টেবিলে যে-ছেলেটি বসেছিল সে দাঁড়িয়ে উঠল। বলল, ‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই রাখব। তবে এক কপি মাত্র? এক্ষুনি তো বিক্রি হয়ে যাবে। আরও কপি তো দরকার।’ অনন্য বললেন, ‘বইটি বিক্রির জন্য দিলাম না, ডিসপ্লের জন্য দিলাম, মেলা শেষ হলে আবার ফেরত নিয়ে নেব।’ ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ ফিল্মে অনন্য তখন অভিনয় করেছেন এক নকশালপন্থী যুবকের ভূমিকায়। সম্ভবত, অন্যতম সহকারী পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছিলেন তিনি। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় এ-বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য দিতে পারবেন, যা আমি জানি না। কারণ তিনি অনন্য রায়ের বন্ধু ছিলেন তো বটেই, উপরন্তু ‘ঋত্বিকতন্ত্র’ নামে পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের বিষয়ে একটি গ্রন্থও রচনা করেছেন।

একটু পরে সেখানে ছয়ের দশকের কবি মানিক চক্রবর্তী এলেন। অনন্য-র সঙ্গে আলাপ হল। শুনলাম, অনন্য তাঁকে বলছেন, ‘আমার নাম অনন্য রায়। আমি আপনার কবিতা একটু একটু নকল করার চেষ্টা করি।’ বলা বাহুল্য, অনন্য রায়ের ‘আমিষ রুপকথা’ একটি বিচিত্র বৈশিষ্ট‍্যময় দীর্ঘ কবিতার গ্রন্থ। অতুলনীয় সে-কাব্যের সঙ্গে মানিক চক্রবর্তীর ছোট ছোট লেখার কোনও সাদৃশ্যই নেই। মানিক চক্রবর্তী, যাকে বলে অ্যান্টি-পোয়েট্রি, সেই জাতীয় কবিতা রচনার ধারায় নিজের লেখাকে নিয়ে গিয়ে পরিচিতি অর্জন করেছেন। আমি বুঝলাম, অনন্য রায়ের ওই কথাটি সৌজন্য প্রকাশের একটি স্মার্ট নিদর্শন।

মেলা শেষ হল। অনন্য সামনের টেবিল থেকে নিজের বইটি তুলে নিলেন। টেবিলে উপবিষ্ট ছেলেটির কাছে কলম চাইলেন। কলম নিয়ে আমাকে আমূল বিস্মিত করে ‘আমিষ রুপকথা’ বইটি আমাকেই উপহার দিলেন। আমি তখন অনন্যকে কিছুতেই বলে উঠতে পারলাম না, এই বই আমি কিনেছি আগেই।

মেলায় গেলে ভাস্কর চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা হত। দেবদূতের মতো চেহারা। কপালে একটি কাটা দাগ। চশমা পরা হাসিটি এমন, যেন সারা মেলা আলো হয়ে যায়। বললেন, ‘এসেছেন? একটু দাঁড়ান তবে। আমি এক্ষুনি আসছি।’ আমি দেখলাম, ভাস্কর ‘প্রমা’ প্রকাশনীর স্টলে ঢুকে গেলেন। বেরিয়েও এলেন একটু পরে। হাতে লালচে প্রচ্ছদের একটি বোর্ড-বাঁধাই বই। পকেট থেকে কলম তুলে নিয়ে লিখলেন কিছু। তারপর বইটি এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। বললেন, ‘এবার মেলায় বেরলো।’ বইটির নাম: ‘রাস্তায় আবার’। ভেতরে অসামান্য হস্তাক্ষরে লেখা: ‘জয় প্রীতিভাজনেষু।’

জয় গোস্বামীর আগের লেখাটি পড়ুন-মৃত্যুর মুখোমুখি কি কবিতা হাতে দাঁড়ানো যায়? জয় গোস্বামী

সে-সময়, এখন থেকে তিরিশ বছর আগে, ভাস্কর চক্রবর্তী ছিলেন এমন একজন কবি, আমি প্রথম থেকেই সতর্ক থেকেছি, যাতে আমার লেখা তাঁর দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে পড়ে। ’৭১ সালে ভাস্করের প্রথম বই — ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’ প্রকাশের পর থেকেই প্রায় সমস্ত তরুণ কবিতা-লেখকদের মধ্যে ভাস্কর নিজের কবিতার প্রভাব নিয়ে উপস্থিত হতে থাকেন। এতই অপ্রতিরোধ্য ছিল তাঁর লেখা— কিছুতেই আটকানো যেত না তাঁর প্রভাবকে। অত বড় কবি, অথচ দেখো, কেমন সহজে নতুন লিখতে আসা এক মফসসলবাসী নবীন কবিতা-লেখককে নিজেরই বই অনায়াসে উপহার দিলেন! এবং এ-কথাও বললেন, ‘দেখবেন তো, বইটা কিছু হয়েছে কি না।’

আমি এখন বইমেলা যাই না, কারণ যাওয়ার উৎসাহ নির্বাপিত হয়েছে। ভিড়ে দমচাপা লাগে; মানুষ-মানুষ-মানুষ, এত মানুষ নিতে পারি না আর। কিন্তু আশা হয় এ-কথা ভেবে যে, এত জন মানুষ তো আসছেন বইকে ভালবেসেই! আমার বয়স হয়ে গেছে। মেলায় কোথাও কোনও স্টলে যদি বসে থাকতে পারতাম, হয়তো যেতাম। কিন্তু ঘুরে ঘুরে মেলা দেখার শক্তি আর অবশিষ্ট নেই এখন। এই তো, আমার মেয়ে, বুকুন, গত সন্ধ্যায় বইমেলা থেকে প্রচুর বই কিনে বাড়ি ঢুকল। কী আনন্দ যে হল! বুদ্ধদেব বসুর বিষয়ে প্রকাশিত ‘বৈদগ্ধ্য’ পত্রিকার একটি সংখ্যা যেমন আছে সেখানে, আছে সৈয়দ মুজতবা আলী-র কবেকার পড়া ‘দেশে বিদেশে’ বইটি— তেমনই আছে ‘গণিকাসম্বাদ’ নামক গবেষণামূলক প্রবন্ধের বই। বুকুন এনেছে অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চারখানি কাব্যগ্রন্থ। এই কবির কোনও কবিতা আমি আগে পড়িনি। পড়তে গিয়ে দেখলাম, অব্যর্থ কবিত্বের চিহ্ন রয়েছে সেসব লেখায়।

এখন বুকুনরাই বইমেলায় যাবে। আমার জন্য নতুনদের বই কিনে আনবে। নতুন নতুন তরুণ-তরুণীর চলমান প্রাণচাঞ্চল্যে বইমেলা হয়ে উঠবে উৎসব প্রাঙ্গণ, হয়ে উঠবে চিরজীবী।

More Articles