লাল গালিচার কথা || বাঙালি পরিচালকের চোখে কান
Nehmich Cannes Festival: ফ্যাশন এবং সিনেমার হাত ধরাধরি করে চলাটা কান চলচ্চিত্র উৎসবের একটা ঐতিহ্য। এখন পৃথিবী জুড়ে ফ্যাশন বদলেছে।
শান্ত সমুদ্র। মাথার উপর উপচে পড়া নীল আকাশ। সেখানে চক্কর কাটছে একটা-দুটো সিগাল। নিচে পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় সেই গালিচা, যেখান দিয়ে হেঁটে গিয়েছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সব সুন্দরীরা। হেঁটেছেন ফেলিনি, পোলানস্কি বা টোরান্টিনোর মতো পরিচালক। দিনটা ২৩ মে। তার পরের দিন অর্থাৎ ২৪ তারিখ দুপুরে বুনুয়েল থিয়েটারে আমার ছবি 'নেহমিচ' ছবির প্রিমিয়ার। ভিড়ভাট্টা পছন্দ নয় কোনওদিনই। পার্টি, হইহুল্লোড় এড়িয়ে চলি যতটা সম্ভব। আন্তর্জাতিকে কান চলচ্চিত্র উৎসবে যে বিভাগে মনোনীত হয়েছিল আমার ছবিটি, সেই 'লা সিনেফ' বিভাগের ছাদে বসে রয়েছি চুপ করে। হাতে এক কাপ কফি। ভারী অদ্ভুত এই জায়গাটা। পাশে শান্ত ভূমধ্যসাগর। নীচে তাকাতেই চোখে পড়ল শূন্য রেড কার্পেট। কোনও বড় ছবির প্রিমিয়ার শেষ হয়ে গিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। কেউ নেই, একা কার্পেটে হাঁটছেন চলচ্চিত্র উৎসবের এক প্রতিনিধি। মাথার উপর ঘাই মারছে বিরাট এক সিগাল। এর আগে আমি কখনও সিগাল দেখিনি। বইয়ে পড়েছি, সিনেমাতেও দেখেছি, তবে স্বচক্ষে এই প্রথম। ওর ডাক নিয়ে আমার আগ্রহ বহুদিনের। অবশেষে কান-এ এসে শুনলাম সেই ডাক।
কান-এর মতো বিশ্ববিখ্যাত ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে নিজের ছবি মনোনীত হওয়া অবশ্যই আনন্দের ব্যপার, গর্বেরও। সিনেমার ভাষাকে জানব, বুঝব, সেই জায়গা থেকেই পুণের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া (FTII)-তে পড়তে আসা। সেখান থেকে আমি তৃতীয় ভারতীয়, যার ছবি কান চলচ্চিত্র উৎসবে মনোনীত হয়েছে। ভারতের হিসেবে অবশ্য আমি পঞ্চম, যাঁর ছবি কান-এর 'সিনে ফন্ডাসিও' বিভাগে মনোনীত হল। এখন অবশ্য এই বিভাগটির নাম 'লা সিনেফ'। যেখানে বিভিন্ন দেশের ফিল্মস্কুল থেকে ডিপ্লোমাপ্রাপ্তদের ছবি দেখানো হয়। একসময় এই বিভাগটির জুরি ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক আব্বাস কিওরাস্তামি। তার পর থেকেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বিভাগটি।
আরও পড়ুন: সবাই জানেন ‘আজগুবি’ সিনেমা! তাও কেন ভারতবর্ষে চিরকাল জিতে যান শাহরুখ খান?
২৪মে দুপুর আড়াইটে নাগাদ এল সেই বহু প্রতীক্ষিত ক্ষণ। আমার ছবি প্রদর্শিত হল কান-এর বুনুয়েল থিয়েটারে। পরিচালক হিসেবে বুঝতে পারলাম, দর্শকেরা পছন্দ করেছেন ছবিটিকে। সাড়ে পাঁচ মিনিটের স্ট্যান্ডিং ওভেশনও জুটে গেল। স্বাভাবিক ভাবেই, ছবিনির্মাতা হিসেবে এ প্রাপ্তি তো বটেই। তবে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি কান-এ যেটা, তা হল ছবি প্রদর্শনের মান। পিকচার প্রজেকশন বলুন আর সাউন্ড, সব কিছুই অত্যন্ত উঁচু দরের এখামে। যা পরিচালক হিসেবে আলাদা একটা সন্তুষ্টি এনে দেয় ভিতরে। ছবির চিত্রগ্রাহক রচিত পাণ্ডে, সাউন্ড ডিজাইনার উৎসব ঘোষ, এরা সকলেই আমার ব্যাচমেট। ফিল্মস্কুলে একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি আমরা। সকলের মুখেই সেই সন্তুষ্টির ছাপ দেখলাম ছবির প্রিমিয়ারের পরে।
তবে সত্যি বলতে কান-এ এসে অভূতপূর্ব লাগার মতো কোনও অভিজ্ঞতা আমার হয়নি। আসলে ফিল্মস্কুলে ঢোকার বহু আগে থেকেই আমি এই চলচ্চিত্র উৎসবের ভক্ত। বহু পছন্দের পরিচালক ও তাঁদের ছবির সঙ্গেই আমার হাত ধরে পরিচয় করে দিয়েছে কান-এ। ইদানীং ইউটিউবের দৌলতে সেই উৎসবের ছোঁয়াচ মেলে আরও ভালো ভাবে। আর সেখানেই আমি কান-কে অনেক ভালো ভাবে জেনেছি, চিনেছি। কোনটা কোন সেকশন, মেইন প্রতিযোগিতাটা কী, এ সমস্তটাই আমার জানা। কান-এ এসে তাই মনে হল, এ যেন আমার ভীষণ চেনা। পুণেতে থাকতে মাঝেমধ্যেই মুম্বই যেতে হত। ওই শহরটাকে আমার খুব অচেনা লাগত বরাবর । কান-এর চলচ্চিত্র উৎসবে এসে কিন্তু তেমনটা মনে হল না। বুঝলাম, আমি কান-এ না এলেও, কান আমার মধ্যে ছিলই বরাবর।
'লা সিনেফ' সেকশনের যাঁরা আর্টিস্টিক ডিরেক্টর বা তাঁদের সহকারী যাঁরা, তাঁদের উষ্ণতা আমায় ছুঁয়ে গিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা প্রতিটা ছবির ব্যপারে তাঁরা এত যত্নশীল, প্রতিটি ছবির ক্যাটালগিং থেকে তার সিনপসিস বা প্রজেকশনের আগে ছবিটি সম্পর্কে বলা, সব কিছুই পরিচালক হিসেবে আমাকে মুগ্ধ করেছে। সম্মানিত করেছে।
ইদানীং একটি বিতর্ক কানে আসছে প্রায়শই, যে কান আর কান-এ নেই। যে উৎসব আসলে বিশ্বসিনেমার উদযাপন হিসেবে নাম করা, সেখানে বড় বেশি ফ্যাশনের চাকচিক্য। বড় দেশি-বিদেশি মডেল-অভিনেত্রীদের সাজগোজ, ফ্যাশনের দোষে দুষ্ট হয়ে গিয়েছে। অনেকেই মনে করেন এই যে রেড কার্পেটের বাঁদিকে গুণমুগ্ধ ভক্তদের ভিড়, অটোগ্রাফ নেওয়া বা ছবি তোলার উন্মাদনা, তা সিনেমা উদযাপনের তথাকথিত ধারণার সঙ্গে মেলেনা একেবারেই। যতদিন যাচ্ছে, ফ্যাশন শোয়ের রূপ নিচ্ছে কান, এমন অভিযোগও করেছেন অনেকে। তবে আমার মনে হয়, এই জায়গাটা বরাবরই এমন ছিল। আসলে এখন দেখার, জানার সুযোগ অনেক বেশি বেড়েছে সোশ্যাল মিডিয়া বা অন্যান্য মাধ্যমের দৌলতে। বছর দশেক আগেও কান চলচ্চিত্র উৎসবের এত ছবি, ভিডিও বা খবরাখবর সরাসরি আমাদের কাছে পৌঁছত না। কখন কী কী ইভেন্ট হচ্ছে, তা ভিস্যুয়ালি দেখতে পেতাম না আমরা। ফলে আলতো একটা ধারণা গড়ে উঠত আমাদের মনের ভিতর।
এক্ষেত্রে আরেকটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, ইউরোপে, বিশেষত ফ্রান্সে ফ্যাশন ব্যাপারটাকে কখনওই নিম্নরুচির বলে মনে করা হয় না। তাছাড়া শিল্পের প্রতি তাদের রুচি খুব দ্রুত পরিবর্তনশীল। কোনও এক জায়গায় শিল্পকে থামিয়ে রাখতে একেবারেই রাজি নয় তারা। আর এই আর্ট বা শিল্পেরই একটি অংশ হিসেবেই দেখা হয় ফ্যাশনকে। আর আমার মনে হয়, এই ফ্যাশন এবং সিনেমার হাত ধরাধরি করে চলাটা কান চলচ্চিত্র উৎসবের একটা ঐতিহ্য। এখন পৃথিবী জুড়ে ফ্যাশন বদলেছে। পাল্টে গিয়েছে ফ্যাশনের বহিঃপ্রকাশও। তবে তাতে কান চলচ্চিত্র উৎসবের গুরুত্ব কোথাও কমেছে বলে আমার মনে হয় না। কান এখনও চলচ্চিত্র উৎসব হিসেবে সব থেকে বড়, এবং বিখ্যাত। এখনও পর্যন্ত কান চলচ্চিত্র উৎসবে গেলে একটা সিনেমা যে মান্যতা, যে পরিচিতি পায়, তা অন্য কোনও চলচ্চিত্র উৎসব থেকে পাওয়া কঠিন বলেই আমার মত। আমার আগের ছবি 'কালসুবাই' আঠাশটি ফেস্টিভ্যাল ঘোরে। জার্মানির ওবেরহাওসনের একটি অ্যাওয়ার্ডও পায় ছবিটি। International Documentary Film Festival Amsterdam (idfa)-তে বেস্ট ডকুমেন্টরি সেকশনে দেখানো হয়েছিল 'কালসুবাই'। তবে কান-এ ছবি মনোনীত হওয়ার পরে যে সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছতে পেরেছি, তা মনে হয় না আঠাশটি ফেস্টিভ্যাল ঘুরে সম্ভব হয়েছে। বিশ্ব সিনেমায় কান চলচ্চিত্র উৎসবের কর্তৃত্ব যে আজও সমান তালে বজায় রয়েছে, তা অস্বীকার করার জায়গা নেই। বাঙালি হিসেবে এই উৎসবে ঠাঁই পাওয়া সম্মানের তো বটেই।
আমার জন্ম এবং বড় হওয়া কলকাতাতেই। সেখানেই পড়াশোনা। কলেজ শেষ করে আমি এবং আমার বন্ধু পৃথ্বীজয় মিলে ইউটার্ন নামে একটি প্রোডাকশন সংস্থা খুলে ফেলি। পৃথ্বীজয় এই ছবির সহ-চিত্রনাট্যকারও বটে। সেসময় পাহাড় আমাদের অমোঘ টানে টানছে। পাহাড়ি মানুষের জীবন, তাঁদের ভাষা, তাঁদের সংগ্রাম, তাঁদের জীবনকে দেখার চোখ আমাদের দারুণ প্রভাবিত করেছিল। সেই পাহাড়ের ভাষাতেই তৈরি হয়েছিল দুটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি, 'কুইরো' ও 'খোজি'। পৃথ্বীজয় কিন্তু ফিল্ম স্কুলের নয়। বরং ওঁর একটা কর্পোরেট ব্যাকগ্রাউন্ড রয়েছে। তবে আমার মনে হয়েছিল, সিনেমার ভাষাকে বুঝতে একটা প্রথাগত শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। সেখান থেকেই পুণের ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ভর্তি হওয়া। সৌভাগ্যবশত সেখানে আমার অল ওভার ব়্যাঙ্ক ছিল প্রথম। আমার ফিল্মস্কুলের জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে ছাপ ফেলেছে করোনা অতিমারি ও লকডাউন পর্ব। আমার পাশ করার কথা ছিল ২০২০ সালে। কিন্তু কোভিডের দৌলতে সময় লেগে গেল আরও দু'বছর।
করোনার সময়টা আমাদের প্রত্যেককেই কোনও না কোনও ভাবে ভাবিয়েছে। একদিকে প্রতিদিনের এই মৃত্যুমিছিল, হঠাৎ করে জনজীবন থমকে যাওয়া। এই এত এত ঋণাত্মকের মধ্যেও অদ্ভুত এক জীবনের জয়গান ছিল প্রকৃতির মধ্যে। ট্র্যাফিক, দূষণহীন পৃথিবী, তারায় ভরা নীল আকাশ। এই বৈপিরীত্য আমাকে ভাবিয়েছে। তার ছাপ পড়েছে ছবিতেও। 'খোজি' বা 'কুইরো' ছবি দু'টি আমরা তৈরি করেছিলাম নেপালি ভাষায়। আমার বরাবর মনে হয়েছে, ভারতের যে এই এতরকম ভাষা, এত রকম সংস্কৃতি তা আমাদের ছবিতে সেভাবে উঠে আসে না কখনও। আমাদের দেশ, আমাদের রাজ্যের মধ্যেই রয়েছে এমন এক পৃথিবী, যেখানে মানুষ কথা বলেন অন্যভাষায়, তাঁদের সংস্কৃতি, তাঁদের ভাষাকে ছোঁয়ার তাগিদ আমাদের নেই। 'খোজি' ছবিটি নেপালে তৈরি হলেও তার প্রেক্ষাপট কিন্তু উত্তরবঙ্গের কার্শিয়াং। নেপালিরা যে এই বাংলাতেই থাকেন, তা বহু সময়েই আমরা ভুলে যাই। এই যে একই স্কেচের মধ্যে এত রকম ভাষা, এত রকম জীবনযাপন, তা সিনেমায় অধরা থেকে যায়।
'নেহেমিচ' ছবিটি তৈরি হয়েছে মরাঠি-তে। এ গল্পের পটভূমি গাদচিরোলি নামে মহারাষ্ট্রের একটি গ্রাম। তাদের গাওকার প্রথা নিয়ে তৈরি ছবি 'নেহেমিচ'। ফিল্ম স্কুল থেকে তৈরি আমাদের আরেকটি ছবি 'কালসুবাই'-এর ক্ষেত্রেও উঠে এসেছে মহারাষ্ট্রের একটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিশ্বাসের গল্প। আসলে ফিল্ম স্কুলের তথ্যচিত্র তৈরি করার ক্ষেত্রে নিজের পছন্দমতো পটভূমি বাছার স্বাধীনতা আমাদের থাকেনা। ক্ষেত্রসমীক্ষা করার মতো করে ছোট ছোট দলে ভাগ করে আমাদের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হত। সেই জায়গা থেকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে বেছে নিতে হত সিনেমার পটভূমি। হাতে সময় থাকত খুব অল্প। তার মধ্যেই জমা দিতে হত বিষয়ভাবনা। ইনস্টিটিউট থেকে একবার আমরা গিয়েছিলাম পুণের ভান্ডারদারা নামে একটি জায়গায়। সেখানে ঘুরতে ঘুরতে চায়ের দোকানে এক বৃদ্ধ মরাঠি ভদ্রলোকের মুখে শুনি কালসুবাইয়ের মিথটি। সেখান থেকেই এসেছিল ছবির ভাবনা। তৈরি হয় 'কালসুবাই' ছবিটি। মহারাষ্ট্রের কলি উপজাতিদের উপরে তৈরি হয়েছে এই ছবি।
ঠিক তেমন ভাবেই নেহমিচ ছবির পটভূমি মহারাষ্ট্রের গাদচিরিলি গ্রাম। ঋতুস্রাব বা মাসিক নিয়ে আজও ট্যাবুর শেষ নেই দেশজুড়ে। আজও ঋতু চলাকালীন মেয়েদের নানা বিধিনিষেধের মধ্যে দিন কাটাতে হয়। এমনকী তা বহুসময়েই প্রাণঘাতী পর্যন্ত হয়ে উঠতে পারে। যেমনটা হয়েছিল আদিবাসী গ্রাম গাদচিরিলিতে। গাওকারের মতো ভয়ঙ্কর প্রথা আজও মানা হয় সেখানে। যেমনটা মানা হয় নেপালেও। ঋতুস্রাব চলাকালীন বাড়ির মেয়েটির ঠাঁই হয়না ভিটেবাড়িতে। তাঁকে থাকতে হয়ে গ্রামের উপকণ্ঠে একটি নোংরা, অস্বাস্থ্যকর কুঁড়েঘরে। জানলার গরাদ বেয়ে সেখানে ঢোকে না রোদের ছায়াও। শীতের রাতে মেলে না ওমটুকুও। সেখানেই একটি মাদুর আর ছেঁড়া কম্বলে কোনওমনে দিন কাটাতে হয়। পাশেই হয়তো বাঁধা রয়েছে গবাদি পশু। মনে করে কেউ খেতে দিয়ে গেলে খাবার মেলে। আর এই প্রথাই প্রাণ কেড়েছিল এক কিশোরীর। লকডাউন চলাকালীন খাবারের অভাবে মারা যায় মেয়েটি। সেই ঘটনার কথা পড়েছিলাম কাগজে। স্বাভাবিক ভাবেই নাড়া দিয়ে গিয়েছিল সেই মৃত্যু। আর সেখান থেকেই ছবি তৈরির ভাবনা। অদ্ভুত ব্যপার, এই গ্রামে ঋতুস্রাব বোঝানোর জন্য মরাঠিতে একটি সাংকেতিক বাক্য ব্যবহার করা হয়, যার ইংরেজি করলে দাঁড়ায় 'I have been touched by a crow;. অর্থাৎ 'কাকে ঠুকরে দিয়েছে আমাকে'। এত উন্নয়ন, এত বিজ্ঞানের আলো পৌঁছয় না এসব গ্রামে। তাই এরা পরম নিষ্ঠার সঙ্গে এই অন্যায় প্রথাকে আয়ু দিয়ে চলেছেন প্রতিদিন।
শুধু সিনেমা বানানোই নয়, ছবি তোলাও আমার বরাবরের পছন্দের কাজ। একবার মহারাষ্ট্রেই একটি উইন্ডমিলে ছবি তুলতে গিয়ে আমি সেখানকার দারোয়ানের কাছ থেকে একটি গল্প শুনি। সেখানে একটি চেনা শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয় প্রায়শই। 'bird shattering'। ভদ্রলোক জানিয়েছিলেন, উইন্ডমিলগুলিতে যখন টারবাইন তৈরি হয়, পাখিরা বুঝতে পারে না। তার ওর মধ্যে দিয়ে উড়তে গিয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সাময়িক ভাবে টারবাইন থেমে যায়। আমার মনে হয়েছিল, এই ঘটনার সঙ্গে গাদচিরিলি গ্রামের সেই সাঙ্কেতিক বাক্যের আশ্চর্য মিল। ওই গ্রামের মেয়েদের জীবন যেন সেই সব টারবাইনগুলির মতো। যা কাকের স্পর্শে থমকে যায় কিছুদিনের মতো। নাকি ওই পাখির মতো। যা সমাজের এই ট্যাবুর আড়ালে আদতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, বা মরে যায় ওই কিশোরীর মতো। কিন্তু এই জীবনের যে এই সামগ্রিক থমকে যাওয়া মাসিকের সময়ে, তা তো কাঙ্ক্ষিত নয় কোনও ভাবেই। তবে এই বিষয়টি নিয়ে তথ্যচিত্র বানানো কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ছিল না কখনওই। পাশাপাশি ছবি বানানোর ক্ষেত্রে, বিশেষত ছোটো ছবির ক্ষেত্রে প্লটকেন্দ্রিক ছবি বানানোর বা জোরালো গল্প বলার তাগিদ আমার নেই। বরং দর্শকের কাছে সিনেমাটিক অভিজ্ঞতাটুকু পৌঁছে দেওয়াটাই আমার বেশি পছন্দের কাজ। সেখান থেকেই 'নেহমিচ' ছবিকে ধরার চেষ্টা। 'নেহমিচ' মরাঠি শব্দ। সর্বদা, চিরকালীনের মতো বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার হয় শব্দটি। খুব অদ্ভুত আবেদন খুঁজে পেয়েছিলাম শব্দটির মধ্যে। মনে হয়েছিল ছবি ঘিরে এই শব্দটি থাকুক। এই জন্য ইংরেজি টাইটেলকার্ড বা কোনও রকম প্রতিশব্দ ব্যবহার করা হয়নি ছবিটিতে। এই বহুমাত্রিকতার অবকাশটুকু থাক ছবি ঘিরে। এটাই ছিল চাওয়া।
কান-এ ছবি প্রদর্শিত হওয়ার পরে পরিচিতি বেড়েছে। অনেকে 'আন্তর্জাতিক' বলেও দেগে দিচ্ছেন আজকাল। তবে সার্বিক ভাবে আন্তর্জাতিক ছবি বা দেশীয় ছবি, এ ভাবে সিনেমাকে দেখার পক্ষপাতি নই। স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবির ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর সুযোগ এ দেশে তেমন নেই বললেই চলে। যে সুযোগটা আন্তর্জাতিক স্তরে অনেকটাই বেশি। এতদিন ছোট ছবির উপরেই কাজ করেছি, তাই আন্তর্জাতিক মঞ্চেই সেই ছবি দেখতে পেয়েছে মানুষ। তবে বাংলায় কাজ করতে চাই। সমস্ত পরিচালকের মতোই বড় পর্দায় আরও বেশি দর্শকদের কাছে নিজের ছবিকে পৌঁছে দেওয়ার তাগিদ অনুভব করি তো বটেই। আর সেই জায়গা থেকেই আসতে চলেছে আমাদের প্রথম ফিচার ছবি 'কাকতাড়ুয়া'। কলকাতার ছেলে হিসেবে আমার শহর আমার ছবিকে কীভাবে দেখছে, তা জানতে লোভ হয় বৈকি। যুগের হাওয়ায় ওটিটি-র জনপ্রিয়তা বাড়লেও পরিচালক হিসেবে বড়পর্দায় ছবি তৈরি করা এবং প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়ার ব্যাপারটিকে সবচেয়ে আকর্ষনীয় মনে হয়।
আরও পড়ুন: সিনেমাই কি সত্যি! RAW- এর অন্দরে গুপ্তচরদের জীবন আসলে কেমন?
পুণেতে থাকার দরুণ গত কয়েক বছর প্রেক্ষাগৃহে বাংলা ছবি দেখার সুযোগ হয়নি বললেই চলে। তবে কলকাতায় ফিরলেই বাংলা ছবি দেখার চেষ্টা করেছি। কৌশিক গাঙ্গুলী, সৃজিত মুখোপাধ্যায়, অতনু ঘোষ অনেকের ছবিই ভালো লাগে। আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তের 'আসা যাওয়ার মাঝে' ছবিটি আমার অন্যতম পছন্দের ছবি। ওই ছবির ভাষা সেই সময় আমাকে ভাবিয়েছিল।
এখন মাঝেমধ্যেই বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধরনের সমালোচনা শুনতে পাই। তবে আমি কিন্তু সে বিষয়ে সামান্য ভিন্নমত। যে স্বল্প পরিসরে, সর্বোপরী স্বল্প বাজেটে বাংলায় যে মানের ছবি হচ্ছে, তা আক্ষরিক অর্থেই প্রশংসনীয়। আমার এই স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিটি দাঁড় করাতেই দিন সাতেক সময় লেগে গিয়েছে। সেখানে বাংলার পরিচালকেরা যে ডেডলাইনে কাজ করেন, তা ভাবনার বাইরে। বম্বে বা অন্য জায়গায় পরিচালকেরা যে স্কেলে কাজ করতে পারেন, তার এক তৃতীয়াংশও পান না বাংলার পরিচালকেরা। আর সেদিক থেকে দেখতে গেলে এই সময়ে দাঁড়িয়ে বাংলা ছবির এই রূঢ় সমালোচনা করা কাজের কথা নয় বলেই মনে হয়। আপাতত খুব দূরের কথা ভাবতে চাই এমনটা নয়। তবে নিজের ভাষায় নিজের শহরের মানুষের জন্য ছবি বানাতে কে না চায়! সাগরপারে পাওয়া সম্মানের মতোই সেই চাওয়াটাও খুব সৎ এবং যত্নের।
(সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুলিখনে সোহিনী দাস)