ভারতীয় ফুটবলকে কতটা ধাক্কা দিতে চলেছে ফিফার নিষেধাজ্ঞা?
ফেডারেশনের নির্বাচনে সুপ্রিম কোর্টের গড়ে দেওয়া কমিটির হস্তক্ষেপ মোটেও ভালোভাবে নেয়নি ফিফা। যার জেরেই এই শাস্তির মুখে পড়তে হলো ফেডারেশনকে।
১৬ অগাস্ট ২০২২, মঙ্গলবার। বারটা মঙ্গল হলেও দিনটা বড়ই অমঙ্গলের ভারতীয় ফুটবলের জন্য। ভারতীয় ফুটবলে এই দিনটিকে কালো দিন বললে অত্যুক্তি করা হয় না। কিছু মানুষের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার মানসিকতা আজ বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে ভারতীয় ফুটবলকে।অনেক সাবধানবাণীর পর সত্যি সত্যিই অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনকে (AIFF) নির্বাসিত করল ফিফা। ফিফার তরফে এক প্রেস বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ফেডারেশনে 'তৃতীয় পক্ষের' হস্তক্ষেপের কারণেই এই নির্বাসন। আসলে ফেডারেশনের নির্বাচনে সুপ্রিম কোর্টের গড়ে দেওয়া কমিটির হস্তক্ষেপ মোটেও ভালোভাবে নেয়নি ফিফা। যার জেরেই এই শাস্তির মুখে পড়তে হলো ফেডারেশনকে। মঙ্গলবার ভোরের দিকে ফিফার তরফে ই-মেল করে এক প্রেস বিবৃতিতে এই কথা জানানো হয়।
ভারতীয় ফুটবল বেশ কিছুদিন ধরেই ফিফার নিষেধাজ্ঞার প্রতি একপ্রকার গা-ছাড়া মনোভাব দেখিয়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে AIFF সভাপতি হিসেবে প্রফুল্ল প্যাটেলের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়। ভারতীয় ফুটবল চালানোর জন্য প্রশাসকদের একটি কমিটি (CoA) গঠন করে আদালত। সিওএ-কে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নতুন নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য একটি খসড়া সংবিধান গঠনের দায়িত্বও দেওয়া হয়।
এই নির্বাসনের আসল কারণ
ফিফা এবং এএফসি এই বছরের জুন মাসে ভারতে একটি প্রতিনিধি দল পাঠায়। একটি রোডম্যাপ তৈরির জন্য যা এই ধরনের নিষেধাজ্ঞাকে রোধ করবে। ৩ অগস্ট একটি রায়ে, সুপ্রিম কোর্ট একটি অন্তর্বর্তী সংস্থা গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়, যা তৈরি হওয়ার কথা ৩৬ জন প্রাক্তন ফুটবলারের একটি ভোটিং কমিটির সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে। এই ঘটনাকে ফিফা চূড়ান্ত করা রোডম্যাপ থেকে বিচ্যুতি বলে মনে করে। ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা একটি চিঠিতে জানায়, রোডম্যাপ অনুসারে, ফিফা, এএফসি এবং ভারতীয় ফুটবলের অন্যান্য অংশীদারের সঙ্গে বসে তৈরি করা নতুন আইন অনুমোদনের জন্য এআইএফএফ-এর ২০২২ সালের অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে একটি বিশেষ সাধারণ সভা ডাকার কথা ছিল। বলাই বাহুল্য, তা হয়নি। ফলত এই ঘটনাটিকে ফিফা সরাসরি নিজেদের নির্দেশিকা অমান্য করা বলে বিবেচিত করেছে। যথারীতি বারংবার সাবধানবাণী দেওয়া সত্বেও ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন সাবধান না হওয়ায় এই নির্বাসনের খাঁড়া নেমে এল দেশের ওপর।
আরও পড়ুন: শ্রমিকের কান্নায় ভেজা স্টেডিয়ামের মাটি, কাতার বিশ্বকাপ দাসব্যবস্থার স্মৃতি ফেরাবে
কী প্রভাব পড়তে চলেছে?
সত্যি বলতে এই ঘটনাটির বহুমুখী প্রভাব দেখা যেতে পারে ভারতীয় ফুটবলের ওপর। ক্লাব ফুটবল এবং বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ ভারতীয় ফুটবলের মেরুদণ্ড। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই নির্বাসন সোজা সেই মেরুদণ্ডে আঘাত করেছে। এর সম্ভাব্য ফলাফল কী হতে পারে?
ভারত থেকে সরতে পারে মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ
চলতি বছরের ১১-৩০ অক্টোবর ভারতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ। ফিফার এই নির্বাসনের ফলে বিশ্বকাপও ভারতে হবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। যতদিন না সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের কার্যকরী কমিটি সমস্ত নিয়ন্ত্রণ পুনরায় ফিরে পাচ্ছে, ততদিন এই নির্বাসন বহাল থাকবে বলে ফিফার তরফে প্রেস বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। মেয়েদের বিশ্বকাপের বিষয়টি নিয়ে অবশ্য ফিফা পরবর্তীতে ভাববে। আগামীতে পরিস্থিতি কোনদিকে গড়ায়, তা দেখেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে ফিফা। যদিও এই মাসের শুরুর দিকেই সর্বভারতীয় ফেডারেশনকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি, ভারতের কাছ থেকে আসন্ন অনূর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপ আয়োজনের অধিকারও কেড়ে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিল ফিফা।
নির্বাসিত জাতীয় দল
নিঃসন্দেহে, ফিফার নিষেধাজ্ঞা ভারতের জাতীয় ফুটবল দলকে সবথেকে বেশি প্রভাবিত করবে। ভারত সম্প্রতি এএফসি এশিয়ান কাপ ২০২৩-এর জন্য যোগ্যতা অর্জন করেছে। প্রতিযোগিতায় না খেলতে পারলে তা খেলোয়াড়, ভক্ত এবং দেশের সমগ্র ফুটবল সম্প্রদায়ের জন্য বিপর্যয় বলেই বিবেচিত হবে। এর পাশাপাশি, ভারত ২০২৩ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া ফিফা বিশ্বকাপ ২০২৬ কোয়ালিফায়ারে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। একইসঙ্গে ভারত আন্তর্জাতিক ফ্রেন্ডলি ম্যাচ অথবা অন্য কোনও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলতে পারবে না।
এশিয়ান স্তরে নির্বাসিত ভারতীয় ক্লাবগুলি
AIFF-কে নির্বাসিত করায় এএফসি কাপে খেলা হচ্ছে না এটিকে মোহনবাগানের। আগামী ৭ সেপ্টেম্বর যুবভারতীতে আন্তঃআঞ্চলিক সেমিফাইনাল খেলার কথা ছিল এটিকে মোহনবাগানের। সবুজ-মেরুনের এই খেলতে না পারার জন্য মোহনবাগান সচিব দেবাশিস দত্ত দায়ী করেছেন AIFF-কেই।
বিদেশি বিভ্রাট
ফিফা ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনকে নির্বাসিত করায় মহা বিপদে পড়েছে ইস্টবেঙ্গল। আজ থেকেই কলকাতায় শুরু হচ্ছে ডুরান্ড কাপ। তার পরে আইএসএল। এই পরিস্থিতিতে বিদেশি ফুটবলারদের পাওয়া যাবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে ইমামি ইস্টবেঙ্গলের অন্দরে। ১২ অগাস্ট একসঙ্গে পাঁচ জন বিদেশিকে সই করিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। তার মধ্যে তিন বিদেশি ইভান গঞ্জালেজ, অ্যালেক্স লিমা ও ক্লেইটন সিলভা আগে ভারতে খেলেছেন। তাই তাঁদের আন্তর্জাতিক ছাড়পত্র পেতে সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, নতুন দুই ফুটবলার চারালাম্বোস কারায়ুকু ও এলিয়ান্দ্রোকে নিয়ে। একইসঙ্গে অনিশ্চয়তা দেখা গিয়েছে এশিয়ান কোটার বিদেশি সই করানোর ক্ষেত্রেও।
সমাধান
AIFF-কে নির্বাসনের পাশাপাশি সমাধানও বাতলে দিয়েছে ফিফা। ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন-এর সামনে মূলত দু'টি শর্ত রেখেছে তারা।
প্রথমত, কমিটি অব অ্যাডমিনিস্ট্রেটর্সকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, AIFF-এর হাতে পুরো দায়িত্ব তুলে দিতে হবে, করাতে হবে নির্বাচন। অর্থাৎ নির্বাচন হলেই কেটে যাবে সব সমস্যা।
এখানে বলে রাখা ভাল, এই মাসের শেষে নির্বাচন হওয়ার কথা। সেটা হলেই ভারতীয় ফুটবল ফের ফিরতে পারবে স্বমেজাজে। বিশ্বকাপ আয়োজনের ক্ষেত্রেও আর কোনও সমস্যা হবে না। মোহনবাগানও খেলতে পারবে এএফসি কাপে। এই প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে বাইচুং ভুটিয়া বলেন, "ভারতীয় ফুটবলকে নির্বাসিত করার ঘোষণা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। খুব কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফিফা। তবে সেই সঙ্গে এর একটা ভাল দিকও রয়েছে। ফুটবল প্রশাসনকে আবার ঠিক পথে ফেরানোর সুযোগ পেয়েছি আমরা। তার জন্য ফুটবল ফেডারেশন, সব রাজ্যের ফুটবল সংস্থাগুলোকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে।" সত্যি বলতে ফিফার নির্বাসন তুলতে নির্বাচনই এখন একমাত্র পথ। যত তাড়াতাড়ি সেই নির্বাচন করা যাবে, ততই লাভ ভারতীয় ফুটবলের।