কেষ্টর কতটা ডানা ছাঁটবে দল? বীরভূমের সিংহাসন থাকবে অনুব্রতর দখলেই?
অনুব্রতকে নিয়ে দল এত নরম কেন? এই নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ময়নাতদন্তে উঠে আসছে অনেক কারণ।
তোমার আসন শূন্য আজি...।
গানের লিরিক কি এক্ষেত্রে এরপর অন্যপথে ঘুরে গেলে ভালো হতো? কারণ এটা ঠিকই যে তাঁর প্রতাপে একসময়ে বীরভূম থর থর কেঁপেছে। তবে তাঁর বীরত্ব দল দেখেছে, জেলা দেখেছে, আর তাঁকেই ঘাড় ধরে হিড়হিড় করে নিজাম প্যালেসে হাজির করেছে সিবিআই। গ্রেফতার অনুব্রত মন্ডল। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতারের পর তাঁর গ্রেফতারি তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে, তৃণমূলের 'কলঙ্কিত নায়ক'-এর তালিকার দুই নম্বরে। সে তিনি এক নম্বর হোন বা দুই নম্বর, পার্থর ডানা ছাঁটতে দল কোনওরকম রেয়াত করেনি, কিন্তু অনুব্রতর বেলায় 'জিরো টলারেন্স' নীতি এখনও পুরোপুরি নেননি মমতা, অভিষেকরা। কেন? এই নিয়ে তৃণমূলের যুক্তির অভাব নেই, তবে নিন্দুকের মুখ বন্ধ করা মুশকিল। এর ময়নাতদন্ত শুরু করে দিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
"দিনটা ছিল বাবুদের পতাকা তুলার দিন", আর কেষ্টর অনুপস্থিতিতে বোলপুরে তৃণমূল কার্যালয়ে সভাপতির চেয়ার ফাঁকা রেখেই বিশেষ বৈঠক করা হয়। সেখানে ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক-সহ দলের নেতারা। সেখানেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সাংগঠনিক কাজ চলবে অনুব্রত মন্ডলের আসন ফাঁকা রেখেই। ২৫ অগাস্ট তাঁকে নিয়ে আরও বড় সিদ্ধান্ত হয়। কালীঘাট সূত্রে খবর, বীরভূমের জেলা সভাপতি পদে এখনই কাউকে নিয়োগ করা হবে না। অনুব্রতই জেলা সভাপতি থাকবেন। তা তিনি আসানসোল জেলে থাকুন বা প্রেসিডেন্সি জেলে।
অনুব্রতকে নিয়ে দল এত নরম কেন? এই নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ময়নাতদন্তে উঠে আসছে অনেক কারণ। এক এক করে তাতে আলো ফেলা যাক।
আরও পড়ুন: দুর্নীতির শিখরে একাই পার্থ-অনুব্রত, না কি নেপথ্যে আরও বড় জাল? বাড়ছে জল্পনা
অনুব্রতর ক্ষমতা খর্ব
এই মুহূর্তে জেল হেফাজতে রয়েছেন অনুব্রত মন্ডল। আর তা থাকাকালীনই বড় পদক্ষেপ তৃণমূলের। ক্ষমতা খর্ব হলো বেতাজ বাদশার। পূর্ব বর্ধমানের তিনটি বিধানসভা কেন্দ্র আউশগ্রাম, মঙ্গলকোট আর কেতুগ্রামের দায়িত্ব থেকে কার্যত সরানো হলো অনুব্রতকে। বীরভূমের পাশাপাশি পূর্ব বর্ধমানের তিনটি বিধানসভা কেন্দ্র দেখতেন অনুব্রত। খাসতালুকে বসেই এই তিন বিধানসভাতে নজরদারি চালাতেন তিনি। কিন্তু তিন বিধানসভা কেন্দ্র দেখার দায়িত্ব আপাতত রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে দেওয়া হয়েছে বলে তৃণমূল সূত্রে খবর। ২৫ অগাস্ট কলকাতায় উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক হয়। সেখানেই অনুব্রত মন্ডলকে এই তিন জায়গা থেকে সরানোর সিদ্ধান্ত শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়েছে বলেই খবর। যদিও এই বিষয়ে দলের তরফে স্পষ্টভাবে কিছু জানানো হয়নি।
এখনই বীরভূম নয়
বর্ধমানের তিন বিধানসভা কেন্দ্র থেকে অনুব্রত মন্ডলকে সরানো হলেও বীরভূমে এখনও হাত দেওয়া হয়নি। কিন্তু কেন? তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে বিরোধীরা। যদিও অনুব্রত মন্ডলের গ্রেফতারের পর থেকেই দলের রাশ এই এলাকায় কার হাতে থাকবে তা নিয়ে একটা জল্পনা তৈরি হয়েছে। একাধিক নাম সামনে আসছে। যদিও বীরভূমে যে শেষ কথা এখনও অনুব্রতই, তা কার্যত স্পষ্ট করে দিল তৃণমূল নেতৃত্ব। বীরভূমে অনুব্রতকে তৃণমূলের জেলা সভাপতি পদ থেকে এখনই সরাবে না দল। আপাতত তাঁর 'খড়ম’ নিয়ে জেলা শাসন করবে না কোনও সহোদর। অর্থাৎ বীরভূমে চড়াম চড়াম ধ্বনি আবারও শোনার সম্ভাবনা জিইয়ে রাখল তৃণমূল।
সামনেই পঞ্চায়েত ভোট
সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। আর এই পঞ্চায়েত নির্বাচনকে সামনে রেখে ফের একবার বাংলায় ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে বিজেপি। এই অবস্থায় কোনও জায়গা ছাড়তে নারাজ তৃণমূল। তবে কি অনুব্রত মন্ডলের গ্রেফতারি সংগঠনে প্রভাব ফেলতে পারে, আর তা বুঝেই এহেন সিদ্ধান্ত? প্রশ্ন উঠছে।
একসময় বামেদের শক্ত ঘাঁটি ছিল এই বীরভূম। কিন্তু গত কয়েক বছরে তৃণমূল যেভাবে সংগঠন বিস্তার করেছে, তার নেপথ্যে যে অনুব্রত ছিলেন, সেকথা স্বীকার করে নেন দলের অনেক নেতাই। তবে ২৫ অগাস্টের ঘটনা বদলে দিয়েছে অনেক কিছুই। গরুপাচার মামলায় বোলপুরের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে তৃণমূল নেতাকে। এদিকে আবার দল বলছে, দুর্নীতি কোনওভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।
এর আগে এখানে পঞ্চায়েতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একাধিক আসন জিতিয়েছেন অনুব্রত। গত লোকসভা ভোটের আগে তাঁকে বলতে শোনা যায়, বীরভূমে সব আসনে না জিতলে দল ছাড়ব। এরপর দিদির ধমক খেয়ে সেই পথে পা বাড়াননি। এবার অনুব্রত-হারা বীরভূমে পঞ্চায়েতে যদি প্রভাব পড়ে, তাহলে তার জের গড়াবে লোকসভা ভোটে। কারণ সেই ভোটেরও আর বেশি দেরি নেই। দল ভালোই জানে, বীরভূমে সংগঠন তৈরিতে অনুব্রতর বিকল্প নেই, তাই তেতো পাচন খাওয়ার মতো কি তাঁকে হজম করতে হচ্ছে?
পদ চাননি অনুব্রত
তিনি নাকি কোনওদিন মন্ত্রিত্ব চাননি। তিনি নাকি বড় কোনও দলীয় পদ চাননি। তাঁকে দিদির ডিফেন্ড করার পিছনে এটা একটা বড় কারণ হলেও একমাত্র কারণ নয়। এক্ষেত্রেও বালাই সেই পঞ্চায়েত আর লোকসভা ভোটের কড়া নাড়া।
তৃণমূল সূত্রের মতে, অনুব্রতকে না সরানোর সিদ্ধান্ত কৌশলগত। অনুব্রত মন্ডল গ্রেফতারের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা নিয়ে সরব হয়েছিলেন। সংবাদমাধ্যমে দলের এক নেতার কথায় প্রকাশ, দিদি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন যে, অনুব্রতর পাশে না দাঁড়ালে দলের অনেকেই হতাশ হয়ে পড়বেন। অনুব্রত ছিলেন দক্ষ সংগঠক। বীরভূমের জেলা সভাপতির পদ অতিরিক্ত কখনও কোনও পদ চাননি তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে ঠিক, কিন্তু এও ঠিক, বীরভূমে তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে অনুব্রত জনপ্রিয়। দলের কর্মী-সমর্থকদের জন্য প্রচুর করেওছেন এই নেতা।
সম্ভবত সেই কারণেই বীরভূমে জেলা সভাপতি পদে আপাতত কোনও বদল হবে না। তবে ব্লক সভাপতি স্তরে বদল হতে পারে। আর তাঁদের মাধ্যমেই কালীঘাট বা ক্যামাক স্ট্রিট থেকে বীরভূমকে দেখভাল করা হবে।
টাকার নির্লজ্জ প্রদর্শন নয়
এই যুক্তি যতই শাক দিয়ে মাছ ঢাকুক, তৃণমূল যে একে হাতিয়ার করবে তা বলাই বাহুল্য। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে টাকার নির্লজ্জ প্রদর্শন দেখেছে রাজ্য। তাঁর ঘনিষ্ঠর বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া টাকার পাহাড় দেখে খোদ গোয়েন্দা কর্তাদের ভিরমি খাওয়ার অবস্থা! রাজ্যবাসী বাক্যহারা! অনুব্রতর ক্ষেত্রে শোনা গেছে, তিনি দুর্নীতির টাকায় প্রাসাদ গড়েছেন। (শোনা গেছে, চোখে দেখেনি রাজ্য) বীরভূমে তাঁর ও তাঁর মেয়ের নামে থাকা কোম্পানি, বাড়ি-গাড়ি, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সব খতিয়ে দেখছে সিবিআই। এখনও পর্যন্ত বোলপুরে অনুব্রতর চালকলে ৫টি বিলাসবহুল গাড়ির ছবি দেখেছে রাজ্য। যেহেতু তাঁর ঝুলি থেকে বেড়াল থুড়ি টাকা বের করে সিবিআই এখনও তা প্রদর্শন করতে পারেনি, তাই নাকি তাঁকে রক্ষাকবচ দিচ্ছে দল।
সামাজিক নৈতিকতার প্রশ্ন
দিদিকে কি কোথাও সামাজিক নৈতিকতার প্রশ্ন তাড়া করছে? পার্থর ক্ষেত্রে দল জিরো টলারেন্স নীতি নিলেও অনুব্রতর হয়ে ব্যাট করেন খোদ দলনেত্রী। বলেন, "অনুব্রতকে গ্রেফতার করলেন কেন? কী করেছিল কেষ্ট? কেষ্টকে জেলে আটকালে কী হবে? ওদের এজেন্সির কিছু লোক রয়েছে, তাঁদের টাকা দিয়ে পোষে। মাঝরাতে কেন সিবিআই বাড়িতে ঢুকছে? কেষ্টর বাড়িতে তাণ্ডব চালিয়েছে সিবিআই।"
পার্থর নামের সঙ্গে অর্পিতা জুড়ে যাওয়াটা মমতার দলের ইমেজের পক্ষে ভালো নয়। এদিকে মমতা বারবার বলেছেন, কেষ্ট বউকে শেষদিন পর্যন্ত দেখতে আসত কলকাতায়। দুটো দুই মেরুর ঘটনা। একদিকে দলের ইমেজের প্রশ্ন। তাই পার্থর এহেন ঘটনার পাশে দাঁড়ানো মানে দলকে স্বখাত সলিলে আরও টেনে নামানো। আর অন্যদিকে অনুব্রত তাঁর স্ত্রীর জন্য বারবার কলকাতায় এসেছিলেন, এর জন্য দলের দায়বদ্ধতা থেকে আসলে নৈতিকতার জন্ম নেয়। তাই কি মমতা দুই মেরু রচনা করেও নৈতিকতার পাশে দাঁড়ালেন? আজকে দলের দুর্দিনে এটা হয়তো দেখানোর প্রয়োজন ছিল।
দল যে কারণ দেখাক, আর ময়নাতদন্তে অনুব্রতর ডানা না-ছাঁটা নিয়ে যে কারণই উঠে আসুক, মোদ্দাকথা হলো উন্নততর বামফ্রন্টের ফরমুলা একদিন এই রাজ্যে কাজে আসেনি। এখন রাজ্য মুখ ঢাকছে প্ল্যাকার্ডে। উন্নততর তৃণমূলের ইঙ্গিত। তাই এত কাণ্ডের পর অনুব্রতর ডানা না-ছাঁটা, তা অভিষেকের কোনও পাশার চাল কি না, তা সময়ই বলবে।