রিয়েলিটি শো থেকে সোজা গিনেস বুকের পাতায়, মার্শাল আর্টে ভারতের মুখ উজ্জ্বল করল নাগাল্যান্ড

Faith In Action, Nagaland: সম্প্রতি একটি জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো-তে অংশ নেয় ফেইথ ইন অ্যাকশন মার্শাল আর্টস অ্যাকাডেমি। সেই মঞ্চেই জীবনের সেরা মার্শাল আর্টস কিকটি দেয় ওই দলটি। যা তাদের এনে দিয়েছে বিশ্বসম্মান।

নাগাল্যান্ড। উত্তরপূর্বের এইসব ভূখণ্ডের মানুষগুলোকে বেশিরভাগ সময়েই ব্রাত্য করে রাখে সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসী। কারণ ভূখণ্ডগত কারণে এদের সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতবাসীর রূপগত কিছু তফাৎ রয়েছে। ভাষাগত বিভাজন তো নতুন কিছু নয়। তার পাশাপাশি এ যেন এক অন্যতর বঞ্চনা। নিজের দেশেই বহিরাগত হয়ে থাকার লাঞ্ছনা, যেটা মেঘালয়, নাগাল্যান্ডের মতো উত্তর-পূর্বাঞ্চলের (নর্থ ইস্ট) মানুষদের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে রোজ রোজ।

তবে তাদের সাফল্যকে নিজের করে নিতে কখনওই পিছপা হয়নি দেশ। বরং সেই গর্বে আরও বেশি করে গর্ববোধ করেছি আমরা। আর আরও একবার দেশের নাম বিশ্বের সামনে উজ্জ্বল করল নাগাল্যান্ড। সেখানকার ফেইথ ইন অ্যাকশন মার্শাল আর্টস অ্যাকাডেমি ভারতের জন্য ছিনিয়ে এনেছে অনোন্য সম্মান। ইতিমধ্যেই জায়গা করে নিয়েছে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে।

আরও পড়ুন: আলো থেকে অস্ত্র তৈরি থেকে খতরনাক মার্শাল আর্ট, অশোকের গোপন সংঘের পরিচয় আজও অজানা

সম্প্রতি একটি জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো-তে অংশ নেয় ফেইথ ইন অ্যাকশন মার্শাল আর্টস অ্যাকাডেমি। সেই মঞ্চেই জীবনের সেরা মার্শাল আর্টস কিকটি দেয় ওই দলটি। যা তাদের এনে দিয়েছে বিশ্বসম্মান। ওই রিয়েলিটি শোয়ের প্রাথমিক অডিশনেই সকলকে মুগ্ধ করেছিলেন অ্যাকাডেমির সদস্যরা। স্বাভাবিক ভাবেই মেগা অডিশনে পৌঁছতে সময় লাগেনি দলটির। নাগাল্যান্ড থেকে সোজা মুম্বই পৌঁছে যায় দলটি। আর সেখানেই মেগা অডিশনে ঘটিয়ে ফেলে তারা ম্যাজিক।

মার্শাল আর্ট বা সমরকলার উৎস সম্ভবত জাপান। তবে দিনে দিনে প্রাচ্য এশীয় ও ইউরোপে ছড়িয়ে যায় মার্শাল আর্ট। আত্মরক্ষা থেকে যুদ্ধক্ষেত্র, প্রায় সব ক্ষেত্রেই দারুণ জনপ্রিয় এই সমরকৌশলটি। তবে মোটেও সহজ নয় এই মার্শাল আর্ট। কঠোর অনুশীলন, নিয়মানুবর্তিতা, মনঃসংযোগের প্রয়োজন। আর সেখানেই ছক্কা হাঁকিয়েছে নাগাল্যান্ডের এই দলটি। তাঁদের এই সাফল্যে ইতিমধ্যেই শুভেচ্ছা জানিয়েছে, নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী। টুইটারে তিনি তাঁর শুভকামনাও জানিয়েছেন।

২০০৮ সালে শুরু হয় ফেইথ ইন অ্যাকশন তাইকোন্ডো অ্যাকাডেমির পথচলা। ছোটদের মার্শাল আর্ট শিক্ষা দেওয়ার জন্য়ই ওই অ্যাকাডেমিটি শুরু করেন মাস্টার দীপ কুমার। তিনি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন, তখন থেকেই শুরু হয় তাঁর মার্শাল আর্ট শিক্ষা। তবে তার কারণ অবশ্য ছিল মজাদার। সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালী একটি বড় দলের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন দীপ কুমার। সেই দলটির হাতে বেধড়ক মারও খান তিনি। সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলেন, পাল্টা মার ফিরিয়ে দেবেন। সেই প্রতিহিংসার আগুন থেকেই শুরু হয় মার্শাল আর্ট শেখা। নিজেকে প্রতিনিয়ত বদলার জন্য তৈরি করেছিলেন দীপ। তবে যখন শেখা সম্পূর্ণ হল, ততদিনে জীবনকে দেখার চোখ বদলে গিয়েছে তাঁর। শিক্ষাপর্বে যে নিয়মানুবর্তীতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে, সেখান থেকে এই সমরকৌশলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জন্মেছিল তাঁর। ফলে সেই শ্রদ্ধার কাছে হার মানতে হল প্রতিহিংসাকে। বরং তার বদলে তাঁর মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়া।

সেখান থেকেই ২০০৮ সালে নিজের তাইকোন্ডা অ্যাকাডেমি শুরু করেন দীপ। বিভিন্ন আকারের কাঠের বোর্ড লাথি মেরে ভাঙা। দেখতে সহজ হলেও কাজটা মোটেই সহজ নয়। আর সেটাই নিজের অ্য়াকাডেমির পড়ুয়াদের শেখান দীপ। তবে শুধু তাইকোন্ডা শিক্ষা নয়, এর পাশাপাশি মাদক, ধূমপানের বিরুদ্ধে সচেতনতার বাড়ানোর কাজও করে থাকেন তিনি। আর সেটাও করেন ওই তাইকোন্ডা এবং মার্শাল আর্ট শিক্ষার মাধ্য়মেই।

প্রথম যখন অ্যাকাডেমি তৈরি হয়, তখন তাঁর কাছে এক ফালি জমিও ছিল না, যেখানে শিক্ষাকেন্দ্রটি তৈরি করতে পারেন তিনি। সাহায্যের জন্য বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সকলের সামনে হাত পেতেছেন তিনি। শেষমেশ একটুকরো জমি জুটে যায়। সেখানেই সাত-আট জন ছাত্র নিয়ে শুরু হয় শিক্ষাদান। সেই শূন্য থেকে শুরু করে আজ অন্তত ৬০০ জন তাইকোন্ডা শেখেন দীপের কাছে। শুধু নাগাল্যান্ড নয়, ত্রিপুরা এূং আসামেও ছড়িয়ে রয়েছেন তাঁর ছাত্রছাত্রীরা।

আর সেই অ্যাকাডেমি থেকেই কয়েক জন ছাত্রছাত্রী ছিনিয়ে এনেছেন বিশ্বসম্মান। আর এ যে দীপের জন্য কত বড় পাওনা, তা বলে বোঝানো অসম্ভব। শুধুমাত্র দেশের এত বড় একটা মঞ্চে যে তাঁদের কৌশল দেখানোর সুযোগ পেয়েছেন তাঁরা তাই নয়, বিশ্বের কাছেও তুলে এনেছে দীপের অ্যাকাডেমির নাম। আপাতত আরও বড় একটি প্রতিষ্ঠান শুরু করতে চান দীপ। যেখানে শুধু অ্যাকাডেমিই নয়, তার সঙ্গে থাকবে নিজস্ব একটি স্টেডিয়াম। শুধু পড়ুয়া বা নবিশ তৈরি নয়, তাঁদের রোজগারের ব্যবস্থাও করে দিতে চান দীপ। তাঁর অ্যাকাডেমির কৃতি পড়ুয়ারা সেখানে মার্শাল আর্ট এবং তায়কোন্ডা শেখাবেন। আর আগামী দিনে তাঁর অ্যাকাডেমি থেকে শিখে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেবেন পড়ুয়ারা, এমনকী অলিম্পিকে ভারতের হয়ে জিতে আনবে পদক, এমনই নানা স্বপ্নে বুক বাঁধছেন দীপ।

আরও পড়ুন:ডাক্তার হয়ে হাজার হাজার ফুট থেকে লাফ! ভারতের প্রথম মহিলা প্যারাট্রুপার আজও আড়ালেই

তবে এর পাশাপাশি আরও একটা স্বপ্ন রয়েছে দীপ ও তাঁর ছাত্রছাত্রীদের। এই মার্শাল আর্টের মাধ্যমেই একদিন নাগাল্য়ান্ডকে তুলে আনবেন জগৎসভায়। যাতে আর কেউ দেগে না দিতে পারে চিঙ্কি বা চিনাম্যান বলে। দেশের মধ্যে থাকা একটি ভূখণ্ডকে দেগে না দিতে পারে অভারতীয় বলে। দেশের জন্য বিশ্বরেকর্ড ছিনিয়ে আনার পর এটুকু স্বপ্ন কার না দেখার ইচ্ছা হয় বলুন তো!

More Articles