যদি ফিল্ম দিলে না 'কান'-এ

Cannes Film Festival: পৃথিবীর তথাকথিত সব চেয়ে বেশি সংখ্যক ছবি যে দেশে তৈরি হয় সেই ভারতবর্ষের একটা সুযোগ মূল প্রতিযোগিতায় কেন আসবে না এত বছরে?

আমি সিনেমা-প্রেমিক। খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা নয় কারণ বাঙালি মাত্রই কবিতা আর সিনেমার প্রেমিক। অবশ্য আমার বাস টালিগঞ্জে। ইন্দ্রপুরী, টেকনিশিয়ানস, এনটি ওয়ান আর হালের দাসানি- সব স্টুডিওই আমার বাড়ির আশেপাশে। ছোটবেলা থেকে বাবুরাম ঘোষ রোডের ওপর দিয়ে বহু সিনেমাশিল্পীদের যাতায়াত দেখেছি। তাঁদের ছবি দেখলে হাঁ-মুখ করে সমীহে গদগদ হয়ে পড়ি না, বাংলা সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের এমনভাবে কথার মাঝে নিয়ে আসি 'দেব', 'জিৎ', 'কোয়েল', 'শ্রাবন্তী', 'বুম্বাদা' নামে ডেকে, যেন মনে হয় এঁরা সব আমার বাড়ির লোক, দূর সম্পর্কের আত্মীয়! অলিগলিতে সিরিয়ালের শুটিং চললে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাই। দাঁড়িয়ে শুটিং দেখাটা অত্যন্ত 'নিম্ন রুচি' বলে বোধ হয় যেন! বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে সিনেমার প্রসঙ্গ উঠলে আলোচনা গভীরে নিয়ে যেতে পারি। কথাগুলোয় খানিক কৌতুকের আভাস পাওয়া গেলেও, এগুলির মধ্যে আর যাই থাক মিথ্যে নেই। গম্ভীরভাবে বললে বলা যায়, বাঙালি প্রথম থেকেই সিনেমার মারাত্মক প্রভাবের মধ্যে ছিল এবং এই বিশেষ শিল্পমাধ্যমটি আমাদের আজও আন্দোলিত করে চলেছে। সত্যজিৎ রায় ছাড়া আরও বহু পরিচালক বিশ্বমানের এমন সব ছবি করেছেন এবং বাংলা ভাষাতেই, যে বাঙালি মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেনি। তাছাড়া, ফিল্ম সোসাইটি, বিভিন্ন ক্লাব, পাঠচক্র, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রম যেভাবে গড়ে উঠেছে তাতে সিনেমা বাঙালি সংস্কৃতির খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে অচিরে। ছোট থেকে বড়, গরিব থেকে ধনী, ছাত্র থেকে ভাবুক- সকলেই সিনেমা দেখতে, পড়তে চায়। দশ বছর আগে অবধি বিশ্বের নানা দেশের সিনেমা দেখতে পাওয়া আজকের মতো সহজলভ্য ছিল না। এখন সিনেমা দেখার বিভিন্ন মঞ্চ তৈরি হয়েছে। এমনকী ইউটিউবেও সিনেমা দেখা যায়। তবে বলতে দ্বিধা নেই, বিশ্বের অনেক ভালো, পুরস্কারপ্রাপ্ত সিনেমাই আমার প্রথম দেখা 'পাইরেটেড সিডি'-র দৌলতে। ২০০৪-০৫ সাল নাগাদ টালিগঞ্জ মেট্রোর বাইরে একটা দোকান ছিল। মোবাইলের নানা জিনিসের পাশাপাশি সেখানে সিনেমার সিডি বিকিকিনি হত। অবিকল শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটার মাহেলা জয়বর্ধনের মতো দেখতে দোকানি ছেলেটি বাড়িতে বিশ্বের নানারকম সিনেমা টরেন্ট থেকে ডাউনলোড করে সিডি বানিয়ে বিক্রি করত। দাম পড়ত ৪০ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে। কেনার সময় খুব ভালো, বিরল সিনেমা পাওয়া গেলে আমাদের মুখের অভিব্যক্তিতে কোনও খুশির চিহ্ন ফুটিয়ে তোলা যেত না অবশ্য তার কারণ সিডিটা মূল্যবান বুঝলেই তার দাম দশ-বিশ টাকা বেড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকত।

আরও পড়ুন: লাল গালিচার কথা || বাঙালি পরিচালকের চোখে কান

বাড়িতে সিডি চালিয়ে বা কম্পিউটারে এমন নানা দেশের সিনেমা দেখতে দেখতে আমরা বুঝতে শিখলাম, প্রতি বছর মে মাস নাগাদ ফ্রান্সের কান নামক এক সমুদ্রঘেরা শহরে সাত দিনব্যাপী একটি ফিল্মোৎসব চলে এবং সারা বিশ্বজুড়ে নতুন সিনেমা কোনও আঙ্গিকে এগিয়ে চলেছে তার আভাস এখান থেকেই পাওয়া যায়। হাতের কাছে পাওয়া বা সিডির দোকান থেকে কেনা ওই উৎসবে উদযাপিত বিশেষ সিনেমাগুলো দেখে নেওয়া আমাদের একটা খেলা হয়ে দাঁড়াল। আমাদের 'সিনেমা দেখার চোখ' বদলে যেতে শুরু করল খুব দ্রুত। গত ১৬ মে থেকে ২৭ মে চলেছে এ বছরের কান চলচ্চিত্র উৎসব। এই উৎসবের নানা রকম সিনেমা বহু বছর ধরে দেখেছি। মনে থেকে গেছে বেশ কয়েকটি নাম, যেগুলির কাছে আমি বার বার ফিরে যাই।

একটা আলটপকা বিষয়ে আসা যাক। পুরুষের অস্তিত্ব নির্ভর করে কীসের উপরে? শক্তি, সাহস, কর্মক্ষমতা তো বটেই, তার সঙ্গে আরেকটি জিনিস হলো তাঁর শিশ্নের ঋজুতা! ইতিহাস সাক্ষী, পুরুষের লিঙ্গোত্থান না হলে সমাজের সব সংস্থানগুলো তাঁকে নিষ্ঠুর ভাবে দূরে সরিয়ে দেয়। এমনকী অন্য পুরুষরাও। পিতৃতন্ত্রের সব চেয়ে বড় শিকার পুরুষই। তাঁর গুণ, প্রতিভা, ইচ্ছা, ভালোলাগা কোনও কিছুরই মূল্য থাকে না যদি সে ধ্বজভঙ্গ হয়। এমন একটা বিষয় নিয়ে মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে অনবদ্য এক ছবি নির্মাণ করেন সিনেমার বিস্ময়বালক স্টিভেন সোডারবার্গ, ১৯৮৮ সালে।

গ্রাহাম পরিচিত-অপরিচিত মেয়েদের কিছু মুহূর্ত ভিডিওবন্দি করে রাখে। সেসব ভিডিওতে মেয়েরা মূলত তাঁদের যৌনাচার ও যৌন আকাঙ্খার কথা বলে চলে। গ্রাহাম, যে আগেই সকলকে জানিয়েছে যে সে 'ইমপোটেন্ট' এবং এইসব ভিডিওগুলি দেখে সে পরে তৃপ্তি পায়, ছবির শুরুতে অতএব, তাঁকে আমাদের বিকৃতমনস্ক মনে হয়। পাশাপাশি জনকে আমাদের মনে হয় তুলনামূলক বেশ ভালো মানুষ। জন কিন্তু তাঁর শ্যালিকা সিনথিয়ার সঙ্গে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়ায়। তবু তাদের ঘনিষ্ঠ দৃশ্য আমাদের কাছে অনেক স্বাভাবিক। স্টিভেন সোডারবার্গ ওই কম বয়সেও মারাত্মক উজ্জ্বল এক ছবিকরিয়ে। তিনি গল্পকে এত সহজ, একরৈখিক হতে দেন না। জনের স্ত্রী অ্যান আর গ্রাহামের যে সম্পর্ক, তার দর্শন আমাদের অবাক করে। অ্যান নিজের সাইকো-অ্যানালিসিসে জানিয়েছে, জনের সঙ্গে যৌনতা তার পছন্দ নয়। এখানেই সিনথিয়া আর জনের সম্পর্ক তাই এক সামাজিক ছাড় পেয়ে যায়, এমনকী দর্শকের চোখেও। জন আমাদের চোখে হয়ে উঠল যৌন বুভুক্ষু অসহায় পুরুষ। তার মানে গভীর এক বিশ্বাস আমাদের মধ্যে চলেই যে যৌনতা ছাড়া নারী-পুরুষের সম্পর্কের কোনও সম্ভাব্যতা নেই তবে। আর সেই নারী বা পুরুষ যদি নিজেই জানায় তার অক্ষমতা বা অনিচ্ছার ব্যাপারে, তবে তো কথাই নেই। তাঁদের বিরুদ্ধে যে কোনও কাজই করা যায়। সহজেই ভুলে যাওয়া যায়, শরীরের ইচ্ছে না থাকলেও তাদের একটা সংবেদনশীল মন থাকতে পারে, সম্মান-অসম্মানের বোধও। গ্রাহাম, অ্যান, জন আর সিনথিয়া একটি সম্পর্কের গোলোক ও তার টানাপোড়েনে ঘুরপাক খায়।

একপক্ষ সম্পর্কের আধার হিসেবে যৌনতাকে চায়, আরেক পক্ষ যৌনতা ছাড়াও যে সম্পর্কের বুনিয়াদ থাকতে পারে তা বিশ্বাস করতে চায়। ছোট, ছোট সংলাপে ভরা দৃশ্যগুলি অপূর্ব সংযোজনায় ছড়িয়ে পড়ে। পরিচালনা এক্কেবারে যৎসামান্য, যেন ক্যামেরার সামনে চরিত্রগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে যাতে তারা নিজেদের মতো এগিয়ে যেতে পারে কিন্তু শিল্পনৈপুণ্যের দিক থেকে সেটাই আবার অনির্বচনীয়। নব্বইয়ের দশক সেই দশক যখন সারা বিশ্বেই ধীরে ধীরে সাইকো-অ্যানালিসিস কাউন্সিলরদের রমরমা তৈরি হচ্ছে। সামাজিক মানুষ আরও ব্যক্তিগত হয়ে পড়ছে, সকলেরই ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য প্রকট হচ্ছে। ওই ভিডিওগুলো আসলে সেইসব ব্যক্তিগত আখ্যানের গল্প। পটভূমিটি তাই শুধু চারজনের না থেকে আরও অনেকের হয়ে উঠছে। এবং যৌনতা নিয়ে এত কিছু কিন্তু একটি যৌনদৃশ্যও এই ছবিতে নেই! তাছাড়া, আজ 'আসেক্সুয়ালিটি' নিয়ে অনেক আলোচনা হয় কিন্তু স্টিভেন সোডারবার্গ সেই কতদিন আগে অ্যানের মধ্যে দিয়ে আমাদের সেই ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন।

আমাদের সৌভাগ্য 'সেক্স, লাইজ অ্যান্ড ভিডিওটেপ'-এর মতো অভিনব, প্রায়-ছোকড়া এক ফিল্মকরিয়ের ছবিকে বড় বড় ছবির মাঝে (অফিশিয়াল সিলেকশনে তোরনাতোরের 'সিনেমা প্যারাডিসো', কুস্তুরিকার 'দ্য টাইম অফ জিপসি', স্পাইক লি-এর 'ডু দ্য রাইট থিং') খুঁজে বার করে উইম ওয়েন্ডের্সের জুরি ১৯৮৯ সালে 'পাম দ্য অর' পুরস্কার দিয়েছিল। এই ছবি সিনেমার ইতিহাসে আজ যুগান্তকারী পর্যায় উত্তীর্ণ। গ্রাহাম চরিত্রে জেমস স্পেডারের অভিনয় শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার জিতে নিয়েছিল। তিনি যে অভিনয়টা এই ছবিতে করেছিলেন তা নিয়ে আলাদা করে গবেষণা হতে পারে। তাঁর চাহনি, ভেঙে ভেঙে কথা বলা, তথাকথিত 'দুর্বল' পুরুষ চরিত্রের চিত্রন এক কথায় অনবদ্য।

ভালো ফিল্মকরিয়ের লক্ষণ হলো তিনি ভাল গল্প বলতে পারেন। গল্পের ঢেউয়ে আপনি কোথা থেকে কোথায় ভেসে যাবেন টের পাবেন না। আর খুব ভাল ফিল্মকরিয়ের লক্ষণ: তাঁকে যে গল্পই দেওয়া হোক না কেন তিনি নিজের মতো বানিয়ে তা এমন পর্যায় নিয়ে যাবেন যে তখনও আপনি ধরতে পারবেন না কোথা থেকে কোথায় ভেসে গেলেন! গল্পের কঙ্কালটা ধরা যাক, এক্কেবারে সহজ। বন্ধুর বউকে আরেক বন্ধুর পছন্দ হয়ে গেছে। ভালোবাসা বাঁধ মানে না, দু'জনেই বিবাহ-বহির্ভূত প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে তাই, তাতে কেউ খুনও হচ্ছে। এতটা অবধি যেন পুরো ব্যাপারটাই অতি সাধারণ। কিন্তু সেই এক বন্ধু যদি হয় ক্যাথলিক পুরোহিত যে নাকি রক্ত খায় আর তার বন্ধুর বউ যদি বলে আমাকেও মেরে ফেলে রক্তখেকো করে দাও, তবে কি সেই গল্প আর তেমন সহজ থাকে? আমরাও নড়েচড়ে বসি! শুধু তাই নয়, হাঁ-করা মুখ আমাদের ছবি শেষ না হওয়া অবধি বন্ধ হতে পারে না! পার্ক চ্যান-য়ুক এই সময়ের একজন সাংঘাতিক সিনেমা পরিচালক। তাঁর কিংবদন্তি 'রিভেঞ্জ ট্রিলজি'- 'সিম্প্যাথি ফর মিস্টার ভেঞ্জিয়েন্স', 'ওল্ডবয়' আর 'লেডি ভেঞ্জিয়েন্স' দুনিয়ার সকল ফিল্মপণ্ডিতের ইতিমধ্যেই দেখা এবং সেগুলি প্রায় 'কাল্ট' পর্যায় উত্তীর্ণ। এই ছবিগুলি অবধি আমরা ভেবেছিলাম তিনি রক্ত, হিংসা, সম্পর্কের টানাপোড়েন আর অনিয়মিত হাস্যরস নিয়ে বেশ ভালো কাজ করেন। কুয়েন্তিন তারান্তিনোর মতো বিশ্বখ্যাত পরিচালক রীতিমতো ঘোষণা করে তাঁর 'ক্রাফট' ঝেড়ে নেন! তারান্তিনো বহু জায়গায় বলেওছেন 'কিল বিল'-এর দুটো ভলিয়ুমেই কিছু কিছু 'ক্রাফট' পার্ক চ্যান-য়ুকের 'ওল্ড বয়' থেকে প্রায় টোকা। কিন্তু 'থার্স্ট'-এ এসে চ্যান-য়ুক যেন সারা পৃথিবীর দর্শকদের আরও এক ধাপ অবাক করে দেন।

সাং-হূন খ্রিস্টধর্মের পুরোহিত গোছের মানুষ। হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে মৃত্যুপথযাত্রীদের তিনি ভগবানের বাণী শুনিয়ে শেষবেলার শান্তি দেন। মনুষ্য সমাজের প্রতি তাঁর দায়ভার অনেক। তিনি মানুষকে ভালবাসেন। তাঁর দয়া এতটাই যে এক বিপজ্জনক রোগের টিকা আবিষ্কারের তিনি বোড়ে হয়ে যান। দুর্ভাগ্যবশত, পরীক্ষাটি অসফল হয়। তিনি মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েও ফিরে আসেন তবে আগাগোড়া বদলে যান। তাঁর তারুণ্য ফিরে আসে, শক্তি দ্বিগুণ হয়, তিনি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেন। আর? আর হয়ে ওঠেন রক্তপিপাসু! তিনি রোদে থাকতে পারেন না। সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বের হন। আর রক্ত তাঁকে খেতেই হয়। অবশ্য খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত মানুষটি কাউকে মেরে রক্ত খান না। হাসপাতালের ব্লাডব্যাঙ্ক থেকে রক্ত চুরি করেন! সাং-হূনের সদ্যপ্রাপ্ত 'আকর্ষণীয়' ব্যক্তিত্বের বহু শিষ্য জুটে যায়। তার মধ্যে একটি পরিবার তাঁরই পুরনো বন্ধু কাং-য়ু, তার স্ত্রী তায়-জু আর মা মিসেস রা। এই পরিবারের ঙ্গে সাং-হূন এতটাই জড়িয়ে যান যে তায়-জু-এর প্রেমে পড়েন। তায়-জু, এক অত্যাচারিত বধূ। তার অসহায়ত্ব সাং-হূনকে নাড়িয়ে দেয়। দু'জনে মিলে খুন করে কাং-য়ুকে জলে ডুবিয়ে। তারপর জানা যায় তায়-জু-এর অত্যাচারের গল্পগুলো সব মিথ্যা। সাং-হূনকে অপরাধবোধ কুরে কুরে খায়। সাং-হূন আর তায়-জু-র মধ্যেকার পরবর্তী যৌনতার দৃশ্যগুলি বোধহয় সিনেমার ইতিহাসে সব থেকে ঘৃণিত অথচ সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যগুলির কয়েকটি। তারা যতবারই একে অপরের কাছে উলঙ্গ হয়ে উপস্থিত হচ্ছে কাং-য়ু-এর জলেডোবা, ফোলাফাঁপা শরীরটা তাদের মধ্যে বাধা এসে দাঁড়াচ্ছে! গা রি-রি করে ওঠে! সাং-হূন 'ভ্যাম্পায়ার' হলেও তাঁর পাপ-পুণ্যের বোধ লাগা মন যেন নষ্ট হয় না, সে কারণেই তায়-জুকে মেরে ফেলতে গিয়েও তিনি আসলে আরও এক রক্তপিপাসু বানিয়ে দেন। কিন্তু সাং-হূন তো মানুষ মারতেন না, তায়-জু কথায় কথায় মানুষ মেরে রক্ত খায়। একদা মানব সমাজের হিতসাধনে ব্রতী ছিলেন যে সাং-হূন, তিনি কি এসব মেনে নিতে পারেন? পারা সম্ভব নয়। তিনি একদিন তাই নিজেকে আর নিজেরই হাতে তৈরি 'ভ্যাম্পায়ার' প্রেমিকাটিকে মেরে ফেলেন। স্রেফ রক্তপিশাচের গল্প কিন্তু তার আড়ালে এমন মানবিক ছবি সিনেমার ইতিহাসে খুব কম তৈরি হয়েছে। এই যে রক্তের পিপাসা, এর মধ্যে দিয়ে পরিচালক যেন কত কিছু নির্দেশ করেছেন। আমাদের মনের গহিন ইচ্ছাগুলো কিংবা মাটিচাপা ঈর্ষা বা কোনওদিনও নিজেকে নিজের থেকে উদ্ধার হতে না দেওয়া সমকামিতা- এমন অনেককিছুই যেন এই পিপাসায় গ্রোথিত থাকতে পারে। আবার তার সঙ্গেই পায়ে পায়ে অপরাধবোধের আখ্যান।

নীল-সাদা-কালোতে একেকটা 'ফ্রেম' এত অপূর্ব যে আনন্দে উদ্বেল হয়ে যেতে হয়। শেষ দৃশ্যে, ভোর হবে আরেকটু বাদে, তায়-জু কিছুতেই মরতে চাইছে না কিন্তু সাং-হূন কোনও পথ খোলা রাখেননি। সূর্যের আলো তাদের পুড়িয়ে দেবেই। তায়-জু-এর অসহায় ছোটাছুটি চোখে জল এনে দেয়। যেন ওই যে যৌথ আত্মহত্যা করে যে পরিবারগুলো, তাদেরই লুকনো গল্প। ওটুকুও কেউ যদি ইউটিউবে দেখে তবে বুঝতে পারবে কী শক্তিশালী এই ছবি, 'থার্স্ট' আর সিনেমা সত্যিই আজ কোন গল্পে কতদূর যে কোন বিন্দু ছুঁয়ে যেতে পারে তার ইয়ত্তা নেই!

"আমায় কোথাও যেতে হবে এবং আমি হয়তো নাও ফিরতে পারি। কিন্তু আমি তোমাকে শুধু এটাই জানাতে চেয়েছিলাম যে বেনিসিও আর তোমার কাছাকাছি থাকাটাই আমার জীবনের একটা শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি।..."

নিকোলাস ওয়াইন্ডিয়ের ছবির আপাত রঙিন, ভয়াল হিংসার যে মোড়ক তা ছাপিয়ে যেতে পারলে মানবপ্রেমের এক অজানা ফল্গুর সন্ধান পাওয়া যায়। তাঁর নির্মাণের যে মন্থর গতি, ক্লোজ-শট আর চমৎকার সঙ্গীতের ব্যবহার তা ভীষণভাবে নতুন, চমকপ্রদ। উজ্জ্বল রঙের ক্যানভাস তাঁর, সংলাপের মাঝে নীরবতা আর সব চেয়ে বড় কথা নানা অপ্রত্যাশিতের দেখা মেলে ওঁর যে কোনও ছবিতেই। এই 'ড্রাইভ'- সিনেমাতেই অপূর্ব দৃশ্য নির্মাণ- আইরিনের চড় মারবার মুহূর্ত অথবা লিফ্টে সেই চুম্বন কিংবা ক্ষুর চালিয়ে শ্যাননের কব্জি কেটে দেওয়া- এ দৃশ্যগুলি যত অভিজ্ঞ দর্শকই হোক, আগে থেকে ধারণা করা মুশকিল। অথচ, ছবিটিতে হুটহাট 'টুইস্ট' বদলের অবকাশ নেই। আর নানারকম বিপরীতমূলক চরিত্র পরিচালক এখানে এক সুতোয় বেঁধেছেন। মারাত্মক কঠিন এক কাজকে কেমন অবলীলায় সাফল্যের শেষ সীমায় পৌঁছে দিয়েছেন।

সিনেমা এমন এক জাদু-মাধ্যম যে মাঝে মাঝে তাকে ভাষায় প্রকাশ করাটাও মনে হয় বাড়তি। এই যে একটি ফিল্ম আর আমি; আমাদের মধ্যে তখন কেউ নেই, সেই আনন্দ কারও কাছে ব্যক্ত করা ভীষণ দুরূহ কাজ হয়ে ওঠে। কী বলব? বললে কেউ বুঝবে যে 'ওকজা' ছবির মেয়েটা আসলে আমারই ছোটবেলা। যে সময় আমাদের প্রত্যেকেরই একটা প্রিয় পোষ্য কীভাবে যেন জুটে যায়। ওর থেকে বেশি ভালো আর কাউকে লাগে না।

আমেরিকান একটি সংস্থা গবেষণা করে জন্ম দিয়েছে কয়েকটি 'সুপার পিগ' (বিরাটাকৃতি শূকর)-এর। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সেগুলিকে। দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অনেক ভেতরের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে এক নাতনি আর দাদুর যত্নে বেড়ে ওঠে একটি 'সুপার পিগ'। আয়তনে তখন সেটি প্রায় একটি হাতি। কোম্পানি আসলে এই উদ্ভাবন করেছে যাতে মাংসের চাহিদায় তারা বাজারে মোনোপলি গড়ে তুলতে পারে। আর এই গবেষণার সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার সিউলের এই শূকরটি। ছোট মেয়েটি অর্থাৎ মিজা ভালোবেসে যার নাম রেখেছে 'ওকজা'। কিন্তু ওকজাকে কোম্পানি ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। মিজা তবে ছাড়ে না। কিছুতেই না। সে ওকজার পিছু পিছু নিউইয়র্ক পৌঁছে যায়। বাকি কাহিনি ওকজাকে উদ্ধারের। তাতে মিজা পশুঅধিকার আন্দোলনের সাহায্যও পাবে। কী অপূর্ব চরিত্র-চিত্রণ আর এক একটা দৃশ্য! ফুড-চেন ব্যবসা আর ভিগানদের সেই পুরনো লড়াইও  ছবিতে উপস্থিত। এই সিনেমায় একবার প্রবেশ করলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত বেরোনো যায় না। 'হাতি মেরে সাথী', 'তেরে মেহেরবানিয়া', 'সবুজ দ্বীপের রাজা' এমনকী 'পাতালঘর' দেখে বড় হয়ে ওঠা আমাদের সকলের সমস্ত ছোটবেলা এ ছবিতে বন্দি হয়ে আছে। আমরা সকলেই আসলে মিজা! প্রতিটা দৃশ্য এখানে অপ্রত্যাশিতের ম্যাজিকে পরিপূর্ণ! হবে নাই বা কেন, পরিচালকের নাম যে বং জুন হো।

আরও পড়ুন: সিনেমাপাগল শৈশবের আশ্চর্য গল্প! অস্কারের দৌড়ে শামিল এই ভারতীয় ছবি কেন দেখবেন

টালিগঞ্জ মেট্রোর সেই 'মাহেলা জয়বর্ধন'-এর সেই ছেলেটি একগুচ্ছ সিডি আমাদের সামনে রাখত তা থেকে নিজেদের বেছে নিতে হত। কখনও কখনও সে 'ভালো' সিনেমার তালিকাও চাইত। এমন করেই পেদ্রো আলমোদোভারের দ্বিতীয় ছবি 'পেপি, লুকি, বম অ্যান্ড আদার অ্যাভারেজ গার্লস' আমাদের হাতে এসে পড়ে। ততদিনে 'অল অ্যাবাউট মাই মাদার', 'টক টু হার' বা 'ব্যাড এডুকেশন' দেখেছি; আলমোদোভারের ছবি ও তাদের রঙ, চরিত্র, সঙ্গীত, যৌনতা আর রোমাঞ্চের প্রেমেও পড়ে গিয়েছি। কিন্তু এ ছবি আলাদা। 'পেপি, লুকি, বম অ্যান্ড আদার অ্যাভারেজ গার্লস' আসলে স্পেনে ফ্রাঙ্কোর অত্যাচারি শাসনের অবসান যখন হয়, যখন ফিল্মে, সাহিত্যে নিষেধাজ্ঞা-এর মতো জঘন্য জিনিসের অবলুপ্তি ঘটে, তার পরে বানানো। আমাদের দেশ ও রাজ্যের এখনকার যে দমবন্ধ-অবস্থা; যখন মানুষ ভাত না চেয়ে জাত ও ধর্ম চিনছে, যখন মানুষ কী খাবে, কী পরবে, কী বলবে রাষ্ট্রই ঠিক করে দিতে চায়, যখন প্রতিবাদীদের দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে জেলে ঠাঁই দেওয়া হয় আর যখন নারী-শরীর পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রের তাঁবে আনবার চেষ্টা হয়, তখন স্পেনে ফ্রাঙ্কোর রাজত্ব কেমন ছিল তা বোধ করি বুঝতে অসুবিধা হয় না। পেদ্রোর এই ছবি সেই ফ্যাসিস্ত শাসনের বিপ্রতীপে দাঁড়ানো এক অনবদ্য নির্মাণ। পেপি আধুনিক নারী যার অস্ত্র নিজেরই শরীর, লুকি মর্ষকামী গৃহবধূ, বম লেসবিয়ান পাঙ্করক শিল্পী। সাধারণ পেদ্রোর সিনেমা বলতে সর্পিল, জটিল চিত্রনাট্য বোঝায়। এ ছবি কিন্তু তা নয়। ছবিকরিয়ের প্রথম ছবি, প্রায় শিক্ষানবিশি সময়ের নির্মাণ তা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু এ ছবির বক্তব্য ও তার তেজ সাংঘাতিক। চেতনায়ও তুখোড়। সিনেমার সীমা যতদূর টানাটানি করা যায় এমনকী কান ধরে, যা পরবর্তীতে জন ওয়াটার্স, গ্রেগ অ্যারাকি বা হালের গ্যাসপার নোই দেখিয়েছেন, পেদ্রো তাঁর এ ছবিকে সেই উজ্জ্বল সম্ভবনায় মুড়ে দিয়েছেন। এখানে মহিলার প্রস্রাব দৃশ্য, পুরুষের শিশ্নের মাপ, বাড়ির বারান্দায় গাঁজার চাষ আর রূপান্তরকামী জীবনের হাস্যময় ঘাতপ্রতিঘাত এমন এক বৈপ্লবিক দ্যোতনার সৃষ্টি করে যা এক অর্থে অনির্বচনীয়। এমনকী সৌন্দর্যের পরাকাষ্ঠাও। স্বাধীন মানে সবকিছু থেকে স্বাধীন। স্বাধীনতা মানে সমাজ, অর্থ, রাজনীতি, নৃতত্ত্ব, শরীর, সংস্থান- সবের স্বাধীনতা। এখানে স্বাধীনতার অর্থ কোনও শর্তের নয় এক্কেবারে বিশুদ্ধ স্বেচ্ছাচারিতা! পেদ্রো পরবর্তীকালে থ্রিলার, কিচ, ক্যাম্প, ক্যুইরচেতনা, নারীত্ব আর কমেডি নিয়ে এক নিজস্ব, রঙিলা 'ক্রাফট' তৈরি করবেন। 'পেপি, লুকি, বম অ্যান্ড আদার অ্যাভারেজ গার্লস' আসলে সেসবের সূতিকাগৃহ।

প্রখ্যাত অভিনেতা ও পরিচালক নন্দিতা দাশ সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন কান চলচ্চিত্র উৎসব আসলে ফিল্ম প্রদর্শনের জায়গা, জামাকাপড়ের নয়। হয়তো তিনি মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন মৃণাল সেন-এর 'খারিজ'-এর পর কানের মূল প্রতিযোগিতায় আজ অবধি ভারতীয় কোনও চলচ্চিত্র কোনও সুযোগই পায়নি। ফি-বছর নায়িকা-মডেলরা কানে যাচ্ছেন, 'রেডকার্পেট'-এ হেঁটে ছবি তুলছেন কিন্তু ভারতীয় সিনেমার উপস্থিতি সেখানে নেই। দু'একটা বিভাগে কেউ কেউ আছেন কিন্তু পৃথিবীর তথাকথিত সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ছবি যে দেশে তৈরি হয় সেই ভারতবর্ষের একটা সুযোগ মূল প্রতিযোগিতায় কেন আসবে না এত বছরে? কান চলচ্চিত্র উৎসব নাক-উঁচু। সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালী'কে 'বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট'-এর মতো সান্ত্বনা পুরস্কার দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল, কানের ফেলে দেওয়া 'চারুলতা' বার্লিনে গিয়ে শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার জিতে এনেছিল কিন্তু এতগুলো বছরে ইরান, তাইওয়ান, আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়ার সিনেমা যেভাবে কান ফিল্মোৎসবে জায়গা করে নিতে পেরেছে ভারত কেন বহু আগে শুরু করেও তা পারল না? কান চলচ্চিত্র উৎসবের ছবি দেখতে দেখতে আমাদের সত্যিকারের দেখার চোখ উন্নত হয়েছে। কত অনাবিষ্কৃত পরিচালক ও তাঁদের কাজের খোঁজ পেয়েছি কিন্তু দেশের বেলা? তরুণ বয়সের সেসব বন্ধুবান্ধবও হারিয়ে গেছে যাদের মধ্যে সিডি চালাচালি হতো আর এক একটা ছবি দেখার পর বেঁধে যেত তুমুল তর্ক। আমরা কেউ ছবিকরিয়ে হতে পারিনি ঠিকই কিন্তু রসিক দর্শক হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি।  তারুণ্যের সেই উত্তেজনা হয়তো বা ধীরে ধীরে স্তিমিত হচ্ছে।

আজ সিডির সেই দোকানটাও আর খোলা নেই। পুলিশ বহুদিন বন্ধ করে দিয়ে গেছে।

 

More Articles