কেন তিন তিনটি কৃষি আইন বাতিল করলেন মোদি? কৃষক স্বার্থ নাকি ভোট চরিতার্থ?
শুক্রবার ১৯ নভেম্বর ছিল ভারতের জন্য অত্যন্ত বড় একটি দিন। এই দিনকেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেন, ভারতের সবথেকে বিতর্কিত তিনটি কৃষি বিল সম্পূর্ণরূপে বাতিল হতে চলেছে। পাশাপাশি কৃষকদের কাছ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করে তিনি কৃষি ব্যবস্থায় আরও উন্নতি আনার জন্য বদ্ধপরিকর হবার আশ্বাসন দিয়েছেন নিজের ভাষণে। কিন্তু, আপাদমস্তক একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং দুর্দান্ত বক্তা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কি শুধুমাত্র কৃষকের কথা চিন্তা করেই এই তিনটি কৃষি বিল বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিলেন? নাকি এর পিছনে প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে?
তবে ভারতে যে শুধুমাত্র কৃষক স্বার্থের কথা ভেবে এবং আন্দোলনের চাপে কোন আইন বদলে দেওয়া হয়েছে সেটা একেবারেই নয়। আজ অব্দি ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে আজকের নরেন্দ্র মোদি, কেউই কিন্তু এতদিন খুব একটা আন্দোলনের ধার ধারেন না। বারংবার বিরোধীদের ফ্যাসিস্ট তকমা সত্ত্বেও নিজের এই সিদ্ধান্তে কায়েম ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু হঠাৎ করে কি এমন হল যে কৃষক আন্দোলনের প্রতি নরম মনোভাব পোষণ করলেন মোদি? সমস্ত দলিত সম্প্রদায় এবং খেটে খাওয়া মানুষের কণ্ঠরোধ করার অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, তিনি হঠাৎ করেই কৃষি আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল? সেরকম হয়তো নয়, কারণ ভারতের রাজনীতিবিদদের কাছে আসল কিন্তু নির্বাচন।
১৩৮ কোটি মানুষের দেশ এই ভারত। দেশের কোনো না কোনো প্রান্তে একটা না একটা নির্বাচন প্রত্যেকদিন হয়েই চলেছে। আর এই বিশাল বড় গণতান্ত্রিক দেশে সবথেকে বড় লক্ষ্যই হলো জয় লাভ করা। রাজতন্ত্র ভারতে অতীত হলেও রাজতন্ত্র কায়েম করতে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলই চাইছে। শুধু নামটা গণতন্ত্র। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ডবল ইঞ্জিন তৈরি করার স্বপ্ন নিয়ে বিজেপি যেভাবে নিজেদের ইঞ্জিন ভেঙ্গে বসেছিল, সেখান থেকে কার্যত স্পষ্ট হয়েছে, সব জায়গায় মোদি হাওয়া চলে না। তার মধ্যে আবার ২০২২ সালে বিজেপির কাছে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ। ক্যাপ্টেন অমৃন্দর সিং বর্তমানে বিজেপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রাখতে শুরু করেছেন। তার হাত ধরে পাঞ্জাব দখল করা বিজেপির সবথেকে বড় স্বপ্ন।
অন্যদিকে আবার উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন ২০২২ সালেই। সেখানে যোগী আদিত্যনাথকে জয়লাভ করানো বিজেপির আরো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতি একেবারে গরমা গরম। এইরকম জায়গাতেই, একটা মোক্ষম চাল খেলে দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ভক্তদের ভাষায় মোদির মাস্টারস্ট্রোক। গুরু নানকের জন্মদিনে সমস্ত কৃষক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করলেন, তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। নিজের হিন্দি ভাষণের মধ্যেও বারংবার রিপিল শব্দটি ব্যবহার করে প্রত্যাহার করে নেওয়ার আসল অর্থ পর্যন্ত বুঝিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
আবেগে ভেসে গিয়ে মোদির ঘোষণা, 'আপনারা এবারে গ্রামে ফিরে যান। সেখানে গিয়ে আবার নতুন করে চাষবাস শুরু করুন। আপনার পরিবার, গোটা ভারত আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আসুন আমরা এক নতুন অধ্যায় শুরু করি।' তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এরকম রূপ আমরা এর আগে কিন্তু লক্ষ্য করিনি। এর আগে তিনি আন্দোলনকারীদের দেশদ্রোহী বলেছিলেন, আন্দোলন এর উপরে পুলিশকে দিয়ে লাঠিচার্জ করিয়েছিলেন, একাধিক দমননীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন যাতে এই কৃষক আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু শক্ত মাটিতে হাল চালানো কৃষকদের দমিয়ে রাখা গেল না। এমনকি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সুপুত্র কৃষকদের উপরে গাড়িও চালিয়ে দিয়ে হুংকার দিয়েছিলেন, দরকার পড়লে কৃষকদের মেরেও দেওয়া যাবে, কিন্তু কৃষি আইন বাতিল হবে না।
কিন্তু একি! এই সন্ত্রাসবাদি, পাঞ্জাবের ধনী চাষী, খালিস্তানিদের প্রতি হঠাৎ করেই আবেগমথিত হয়ে পড়লেন খোদ নরেন্দ্র মোদি? বিদেশি শক্তির ব্যাখ্যা দিয়ে আসা, কানাডার প্রেসিডেন্টকে অপমান করা থেকে শুরু করে, আরো কত কিছুই না করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি এন্ড কোম্পানি। এমনকি বেঙ্কাইয়া নাইডু পর্যন্ত মোদির প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছিলেন তিনি নাকি কোন সিদ্ধান্ত চট করে ফেরত নেন না। যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় অত্যন্ত ভেবেচিন্তে নেন, এবং পরবর্তীতে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যাতে তাকে তার সিদ্ধান্ত ফেরত নিতে না হয়। এহেন একজন প্রধানমন্ত্রী নিজের সিদ্ধান্ত ফেরত নিয়ে নেওয়ায় প্রশ্ন তো উঠছেই।
তবে এই প্রশ্নের উত্তরটা ২০২১ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন আগেই দিয়ে দিয়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে জয়লাভ করলেও তারপর থেকে ধীরে ধীরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করেছে। ২০২১ সালে বাংলায় মোদির ডবল ইঞ্জিন একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে। বলতে গেলে ইঞ্জিন একেবারে বেলাইন। ভক্তরা যতই ভোটের পার্সেন্টেজ দেখাক না কেন, আদতে কিন্তু বিজেপি ২০০ এর টার্গেট এর ধারে-কাছে পর্যন্ত যেতে পারেনি। তার মধ্যেই মোদির জনপ্রিয়তা কমানোয় ইন্ধন যোগানোর কাজ করেছে এই নাছোড়বান্দা কৃষি আন্দোলন। তবে জাতীয় নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এখনো অত্যন্ত জনপ্রিয়। বলতে গেলে ভারতের মানুষের কাছে আর কোন বিকল্প অপশন নেই।
রাহুল গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে খুব কম লোকেই চান। প্রধান বিরোধী দল হিসেবে লোকসভায় স্থান পেলেও কংগ্রেসের অবস্থা যে কতটা খারাপ সেটা আর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হয় না। তাই অগত্যা, জিতবেন সেই মোদিই। কিন্তু, জাতীয় স্তরের নির্বাচন আর রাজ্য স্তরের নির্বাচন অন্যরকম। রাজ্যে কিন্তু একটা জাতীয় দলকে নানা রাজ্যের নানা ছোটখাটো দলের সঙ্গেও জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়। সেখানেই মোদির জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে শুরু করেছিল। ২০১৯ সালের পর থেকে এই সিদ্ধান্তে অটল প্রধানমন্ত্রীও কিন্তু সিদ্ধান্ত বদল করেছেন। কর্ণাটক উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী বদল থেকে শুরু করে, বিভিন্ন অ-বিজেপি রাজ্যের সঙ্গে সমন্বয় বজায় রাখা, সবকিছুই করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
তারপরে আবার পাঞ্জাব হরিয়ানার কৃষকদের ধনী কৃষক তকমা দিয়েও খুব একটা লাভ হয়নি। বরং সারা দেশের ভাগচাষীরাও এই আন্দোলনে শামিল হয়ে গেলেন। কৃষক আন্দোলন ধীরে ধীরে একটি আলাদা রাজনৈতিক মঞ্চে পরিণত হচ্ছিল। বিরোধীদের কাছে আগামী নির্বাচনে বেশ মচমচে একটি আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই কৃষক আন্দোলন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে আরো অনেক জননেতারাই এই কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন নিজেদেরকে। এসব নেতাদের সঙ্গে তারা কথাও বলেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যদিও কৃষক আন্দোলনের সম্পর্ক অনেক পুরনো। নন্দীগ্রামে কৃষক আন্দোলনের কারণেই কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজকে মমতা হয়েছেন, ঠিক যেমনভাবে তেভাগা আন্দোলন থেকে কৃষিকে ভিত্তি বানানোর চেষ্টা করেছিল বামফ্রন্ট।
আগামী ২৯ নভেম্বর শীতকালীন অধিবেশন শুরু হতে চলেছে লোকসভায়। তার আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে আসছেন দিল্লিতে সফর করতে। বিজেপির থিংক ট্যাংক আগে থেকেই ঠাওর করে ফেলেছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি এবারের লোকসভা অধিবেশনে কৃষক আন্দোলনের মোর্চা নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন তৈরি করবে। অধিবেশন কার্যত বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে মনে করেছিলেন মোদী অমিত শাহরা। তাই, অনেক দিক থেকেই বিজেপির কাছে চাপ আসছিল যত তাড়াতাড়ি হোক পরিস্থিতি সামলানোর। কিন্তু পরিস্থিতি সামলানো তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। তাই পুরো পরিস্থিতিটাকেই উপড়ে ফেলে দিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।
বুঝিয়ে দিলেন, রাজনৈতিকভাবে পিছু হটলেও পিএম অলওয়েজ কেয়ারস। ভোট সামনেই। তাই এই সময় যদি বোধোদয় না করা হয়, তাহলে কিন্তু ভবিষ্যতে সমস্যা আছে। যদি কোনভাবে উত্তর প্রদেশ হাত থেকে বেরিয়ে যায়, তাহলে কিন্তু এই রাম মন্দির করার পুরো খরচাটাই জলে চলে যাবে। তাই রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের জন্য আবার একটি মাস্টার স্ট্রোক খেলে দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যে সমস্ত মিডিয়া চ্যানেলগুলি এতদিন ধরে প্রধানমন্ত্রীর কৃষি আইনের গুনগান করে আসছিলেন, তারাই এবারে আইন বাতিল করার সিদ্ধান্তের গুনগান করছেন। ভক্তরাও বলছেন, যখন মোদী করেছেন, হয়তো কিছু ভালো ভেবেই করেছেন! কৃষকরাও বেশ খুশি, কারণ তাদের আন্দোলন সফল হয়েছে। কয়েকটি রাজনৈতিক দল নিজেদেরকে কৃষকপন্থী হিসেবে প্রমাণ করতেও উদ্যোগী। কিন্তু, আসলে কিন্তু জিতলেন মোদি। ভোটের আগে বিরোধীদের হাত থেকে সমস্ত অস্ত্র কেড়ে নিয়ে কার্যত তাদেরকে খোলা মাঠে দাঁড় করিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী। যোগী আদিত্যনাথ এবং অমরিন্দর সিং এর হাতে পরবর্তী ব্যাটনটা তুলে দিয়ে দূর থেকে মুচকি হেসে বুঝিয়ে দিলেন, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়। সত্যিই! ভোট বড়ো বালাই!