দিল্লি যেন 'দুর্গ'! লোকসভা ভোটের আগে বিজেপির পাশা পাল্টে দিতে পারে কৃষক-বিক্ষোভ?
Farmers protest in Delhi: সকাল থেকেই বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে সেই এলাকা। কৃষকদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে পুলিশ।
ভোটের ঠিক আগে আগে উত্তাল দিল্লি। রাজপথ জুড়ে বিক্ষোভে নেমেছেন কৃষকেরা। একগুচ্ছ দাবি ও দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চনার প্রতিবাদে। ২০২০-২১ সালে কৃষকদের আন্দোলনের জেরে বড় ধাক্কা খেতে হয়েছিল মোদি সরকারকে। এবার আর সেই সুযোগ কৃষক আন্দোলনকে দিতে নারাজ প্রশাসন। জোর কোমর বেঁধেছে দিল্লি পুলিশ। মঙ্গলবার থেকেই দিল্লির উদ্দেশে রওনা হয়েছে কৃষকদের মিছিল। দিল্লি-সোনিপত লাগোয়া সিঙ্ঘু সীমানা দিয়ে যাতে তাঁরা রাজধানীতে ঢুকে পড়তে না পারে, তার জন্য কড়া নজর রেখেছে পুলিশ। হরিয়ানা ও পঞ্জাবের সীমান্তগুলিতে রাখা হয়েছে কড়া নজরদারি। যাতে কোনও ভাবেই কৃষকবিক্ষোভের মুখে না পড়তে হয় রাজধানীকে।
মঙ্গলবারই পঞ্জাব-হরিয়ানা সীমানার শম্ভু এলাকায় কৃষক আন্দোলনকে ঘিরে উত্তেজনা ছড়ায়। আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়তে হয়েছিল পুলিশকে। বুধবারও ছবিটা বিশেষ বদলালো না। বেশিরভাগ কৃষকই পঞ্জাব ও হরিয়ানা সীমান্ত থেকে দিল্লির দিকে আসছেন। দিল্লিকে তো এমনিতেই নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ঘিরে দিয়েছে প্রশাসন। সিমেন্টের ব্লক, তিন দিকে বেড়া, বিরাটাকার সব কন্টেনার এনে রুদ্ধ করা হয়েছে কৃষকদের রাস্তা। মঙ্গলবার শম্ভু এলাকায় কৃষকেরা ব্যারিকেড সরানোর চেষ্টা করলে তাদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্য়াস ছোড়ে পুলিশ। রাতের দিকে আন্দোলন থেকে আংশিক বিরতি নিয়েছিলেন কৃষকনেতারা। তারপর বুধবার সকাল থেকে নতুন দমে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ আন্দোলন। দিল্লি চলো মার্চে যোগ দিয়েছেন হাজার হাজার কৃষক। তবে কার্যত শম্ভু এলাকার মতোই একই ছবি দেখা গেল দিল্লির সিংগু সীমান্তেও। সকাল থেকেই বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে সেই এলাকা। কৃষকদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে পুলিশ। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে দিল্লি সীমান্তে প্রচুর পরিমাণে পুলিশ এবং আধাসামরিক বাহিনীর জওয়ানদের মোতায়েন করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: জারি ১৪৪ ধারা, ভোটের আগে দিল্লির পারদ চড়াছে কৃষক বিক্ষোভের আঁচ
দিল্লিকে কৃষি আন্দোলনের আঁচ থেকে বাঁচাতে এক মাসের জন্য সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। মোতায়েন করা হয়েছে রায়ট পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী। তবে হার মানতে নারাজ কৃষকেরাও। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য-সহ একাধিক দাবি নিয়েছেন কৃষকেরা। নিজেদের লক্ষ্যে অচল তাঁরাও। বুধবার শম্ভু সীমান্তে কৃষকদের চোখ ঢাকার জন্য বিশেষ চশমা বিতরণ করতে দেখা গিয়েছে। যা তাঁদের কাঁদানে গ্যাস থেকে বাঁচাতে সাহায্য করবে। সেখানেই একটি সাংবাদিক সম্মেলনও করেন কৃষক-নেতারা। তাঁদের অভিযোগ, শুধু কাঁদানে গ্যাসই নয়। তাঁদের বিরুদ্ধে প্লাস্টিক ও রাবার বুলেট ব্যবহার করছে পুলিশ। এখনও পর্যন্ত মঙ্গলবারের ঘটনায় কৃষক ও সংবাদমাধ্যম কর্মী-সহ ৬০ জনেও বেশি মানুষ জখম হয়েছেন বলে খবর। তবে কৃষক সংগঠনগুলির দাবি, সেই সংখ্যাটা শতাধিক। এখানেই শেষ নয়, কৃষক-নেতাদের দাবি, শাসকদল এমন একটা ধারণা তৈরি করছে, যাতে প্রমাণ করা যায় হয় কৃষকেরা বিরোধী দলের লোক নাহলে আতঙ্কবাদী। একই সঙ্গে কৃষিআন্দোলন নিয়ে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকারও নিন্দা করেছেন তাঁরা।
২০২০ সালে কৃষির ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও, সরকার এ ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ। এর ফলে চরম সমস্যায় পড়েছেন কৃষকরা। এবারও কৃষকদের দাবিগুলির মধ্যে কৃষি সহায়ক মূল্য নির্ধারণের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট আইন প্রণয়নেরও দাবি করা হয়েছে। এ ছাড়া, বিদ্যুৎ আইন, ২০২০ বাতিল, কৃষিঋণ মুকুব, লখিমপুর খেরিতে কৃষক হত্যাকাণ্ডের মূল ষড়যন্ত্রকারী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনির শাস্তিরও দাবি করেছে কৃষক সংগঠনগুলি। একই সঙ্গে মৃত কৃষকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের দাবিতেও সরব হয়েছে তারা। এছাড়া, চার বছর আগে আন্দোলনের সময় বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। সেই সব মামলা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিলেও, সরকার কথা রাখেনি বলেই অভিযোগ। সেই সমস্ত কিছু নিয়েই এবার পথে নেমেছেন কৃষকেরা।
লোকসভা ভোটের আর দেরি নেই। এরই মাঝে ফের কৃষকদের এ হেন বিদ্রোহকে মোটেই ভালো চোখে দেখছে না বিজেপি সরকার। ২০২০ সালে কৃষকবিক্ষোভ যখন মাথাচাড়া দিয়েছিল, সে সময় তা থামানো রীতিমতো চ্যালেঞ্জের কাজ হয়ে উঠেছিল সরকারের পক্ষে। বাধ্য হয়ে পিছু হঠে সরকার। এমনিতেও হরিয়ানার জাঠদের চটাতে চায়না বিজেপি। হবে না-ই বা কেন! তাদের ভোট রাজ্যগুলির অন্তত চল্লিশটি লোকসভা আসনকে প্রভাবিত করতে পারে। ফলে সে বার আর কোনও রাস্তা খোলা ছিল না বিজেপি সরকারের হাতে। তবে এবার আর সেই জায়গাটাই তৈরি হতে দিতে চাইছে না কেন্দ্র। পঞ্জাব ও হাইকোর্টের তরফে স্বাধীন ভাবে চলাফেরার অনুমতি পেলেও দিল্লিতে যে কোনও ভাবে কৃষকদের ঢেউকে প্রতিহত করতে বধ্যপরিকর সরকার। বুধবার সকাল থেকেই সিঙ্ঘু সীমানায় দেখা গিয়েছে সেই ছবি। নামানো হয়েছে র্যাফ। গাজিপুর সীমান্তে বহুস্তরীয় ব্যারিকেড তৈরি করেছে পুলিশ। পুলিশের তরফে বিজ্ঞপ্তি জারি করে কৃষকদের ‘দিল্লি চলো’ কী ভাবে মোকাবিলা করা হবে, সেই কথা বলা হয়েছে। সেখানে স্পষ্ট করা হয়েছে, আন্দোলন মোকাবিলায় কৃষকদের প্রতি ‘নরম মনোভাব’ দেখাবে না পুলিশ। কৃষকেরা যদি আক্রমণাত্মক হয়, তবে তা কঠোর হাতে দমন করতে হবে। কৃষকদের রুখতে পঞ্জাব-হরিয়ানা সীমানা এবং দিল্লিতে ঢোকার সমস্ত রকম প্রবেশপথে ব্যারিকেড, কাঁটা দেওয়া তার জড়িয়ে কার্যত দুর্গের চেহারা দেওয়া হয়েছে। দিল্লির টিকরি সীমানার দিকে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বন্ধ করা হয়েছে যানবাহন চলাচল।
আরও পড়ুন:জলপাই ক্ষেতে ছিটকে উঠল কৃষকের রক্ত, আর কত বিলালের নিথর দেহ দেখে থামবে ইজরায়েল?
এরই মধ্যে কৃষক নেতা রাকেশ টিকাইতের নেতৃত্বে আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি ভারত বনধের ডাক দেওয়া হয়েছে। সরকার নমনীয় না হলে আরও বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়ার কথাও ঘোষণা করা হয়েছে কৃষকদের ইউনিয়নের তরফে। কৃষকেরাই রোদেজলে কাজ করে দেশের মানুষের মুখে জল তুলে দেয়। তাঁদের সঙ্গে বঞ্চনার পরিণাম যে কতটা মারাত্মক হতে পারে, তার ভুক্তভোগী বিজেপি সরকার। আর সেটাই ভাবাচ্ছে বিজেপির শীর্ষনেতৃত্বকে। আর সে কারণেই সম্ভবত কৃষক আন্দোলনকে বিন্দুমাত্র সুযোগই দিতে চাইছে না বিজেপি। এদিকে, ভোটের আগে সেই সুযোগটাই নিতে মরিয়া বিজেপি বিরোধী জোট ইন্ডিয়া। ভোটে জিতে ক্ষমতায় এলে কৃষকদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের গ্যারান্টি দিয়ে একটি আইন আনার কথা বলেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী ও মল্লিকার্জুন খাড়্গে। কৃষকদের উপর এই অন্যায়ের তীব্র নিন্দা করেছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।