পিতৃঋণ শোধ হল না এ জন্মে, তারার দেশে আলোময় থেকো বাবা..

Father's Day 2023: শুনেছি, পিতৃমুখী কন্যারা নাকি সুখী হয় ! আর পিতৃকায়াধারিনীরা? যদিও জীবদ্দশায় আমাদের ভাব কম, আড়িই ছিল বেশি!

প্রিয় বাবা,

চাঁদের হাসি বাঁধ ভাঙছিল আকাশে। রাসপূর্ণিমার রাত্রি ছিল সেদিন। উত্তরের ঘরের বিছানায় শুয়ে বৃদ্ধা মায়ের হাতটা চেপে ধরে কিছু যেন বলার চেষ্টা করলে তুমি। শব্দেরা ছেড়ে গিয়েছিল তোমায়। দু’চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলের ধারা। রাত্রি পোহালো না। তার আগেই তারার দেশে পাড়ি জমালে তুমি।

প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা চাইলেই এখন লক্ষ লক্ষ বর্গমাইল দূরের মানুষের সঙ্গে সহজেই কথা বলতে পারি। কিন্তু পরপারে পাড়ি জমানো পূর্বজদের সঙ্গে প্ল্যানচেট ছাড়া আর কিভাবে যোগাযোগ করা যায়, তা আমার জানা নেই। তাই আমার সমস্ত উপলব্ধি পোস্ট করলাম তোমার মহাশূন্যের ডাকবাক্সে; চিঠির কথাশরীরে।

আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে , সেদিন কি কথা হয়েছিল তোমাদের মায়ে-পোয়ে? দু'টি নাবালক সন্তানের গুরুদায় কি সঁপে দিয়েছিলে নিজের ষাটোর্ধ্ব মায়ের কাঁধে? নাকি অন্তিম বিদায় চেয়েছিলে নিজের গর্ভধারিণীর কাছে!

জানো বাবা, চোখ বুঝলেই আমি তোমাকে দেখতে পাই। ফর্সা নাকের কোলে একটা কালো চশমা গুঁজে সংবাদপত্রের পাতায় ঝুঁকে পড়েছ তুমি। দুপুরের অনুরোধের আসর শেষে আকাশবাণী কলকাতার সংবাদ শোনায় মগ্ন তুমি। আমি তোমার সেই ধারাটিই পেয়েছি। সংবাদপত্রদের প্রতি আমারও আকর্ষণ তীব্র।

উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলে তুমি। সময় পেলেই শোনাতে দেশ-দুনিয়ার কথা। বড় অর্থহীন লাগতো সে সব কিশোরী বেলায়। আজ দেখি স্মৃতির খাঁজে খাঁজে জমে আছে সেই অমৃতকথা। শুনেছি, পিতৃমুখী কন্যারা নাকি সুখী হয় ! আর পিতৃকায়াধারিনীরা? যদিও জীবদ্দশায় আমাদের ভাব কম, আড়িই ছিল বেশি!

“আচ্ছা মা, দাদামনি কেমন ছিল”? “এখন কোথায় আছে”? প্রায়শই প্রশ্ন করে আমাকে সাত বছরের টুকুন। বোঝাতে পারি না তাকে সবকিছু। নিজে সন্তানের জননী হয়ে বুঝেছি, সন্তানের অসন্তোষ, তার দেওয়া ব্যথা বুকে কতখানি বাজে! সবাই উচ্চকণ্ঠে নিজের যন্ত্রণার কথা বলতে পারেনা। তুমিও পারতে না। রোগের যন্ত্রণা, সংসারের যন্ত্রণা সব নিয়ে তুমি পঞ্চাশ না ছুঁয়েই পৃথিবী ছাড়লে।

আজ বড় অপরাধী বলে মনে হয় নিজেকে। তোমার অসহায়তাগুলোকে বুঝতে না পারা, সর্বোপরি, তোমার জন্য কিছুই করতে না পারার আক্ষেপ আমার সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে রইল। এই চিঠি তাই আমার ক্ষমাভিক্ষার আর্জিপত্র। শুনেছি, মানবশিশু জন্মের সময়ই কতগুলি ঋণ নিয়ে জন্মায়। দেবঋণ, ঋষিঋণের মতোই পিতৃঋণও একটি। এই জন্মে আর তা শোধ করা হলো না আমার। পরজন্মে যেন সেই সুযোগ থেকে ঈশ্বর আর আমাকে বঞ্চিত না করেন! তারাদের দেশে আলোময় থেকো তুমি।

প্রণমান্তে ,
তোমার স্নেহের নন্দিনী

More Articles