এমবাপে হারলেন তবু বিশ্বের দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে যে বিরল কৃতিত্ব ছিনিয়ে নিলেন

WorldCup Final 2022 : ইতিহাস লিখেও ট্র্যাজিক নায়ক এমবাপে!

গত রাতের উত্তেজনার রেশ এখনও কাটেনি। এখনও মনে হচ্ছে এই বুঝি পেনাল্টি শ্যুটের বাকি দুটো গোলও ঝড়ের গতিতে পরিশোধ করে দেবেন এমবাপে। আর তারপরই শুরু হয়ে যাবে উল্লাস যার রেশ গিয়ে থামবে জন্মদিনের রাত অবধি। হ্যাঁ, আজ মধ্যরাতে ২৪ বছরে পা রাখবেন কিলিয়ান এমবাপে। কিন্তু তা নিয়ে কোনওরকম উত্তেজনাই আর অবশিষ্ঠ রইল না। বাঘের মতো আক্রমণ ঝড় তুলেও শেষ রক্ষা হয়নি গতরাতে। ঘা খেতে হল অচিরেই। কিন্তু ফরাসি খেলোয়াড় নিজের জাত চিনিয়ে দিতে ভুল করলেন না একরত্তিও।

প্রথমার্ধের দুরন্ত পারফরমেন্সের পর যখন মেসিবাহিনী নিশ্চিন্ত ফুটবলের প্রমোদ গুনছিলেন ঠিক তখনই মাত্র দেড় মিনিটের ফরাসি ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে যায় নীল সাদা শিবির। এই বিধ্বংসী ঝড়ের নাম এমবাপে। এ দিন ম্যাচের শুরু থেকে খেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল আর্জেন্টিনা। মাঠে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না এমবাপেকে। কিন্তু চাকা ঘোরানোয় ওস্তাদ এমবাপে। মুহূর্তের মধ্যে পুরনো হিসেব ওলটপালট করে দেওয়া, এ যেন আগে থাকতেই ঠিক করা ছিল। আশি মিনিট পরেও ০-২ গোলে পিছিয়ে ছিল দল। অথচ পলক পড়তে না পড়তেই স্কোর বোর্ড সমান সমান।

৪ বছর আগের রাশিয়া বিশ্বকাপে উল্কার গতিতে উত্থান ঘটেছিল এই ১৯ বছর বয়সী ফরাসি তরুণের। সেবার কোয়ার্টার ফাইনালেই স্বপ্নভঙ্গ হয় মেসির। তরুণ ফুটবলারের জোড়া গোলে ধরাশায়ী স্বয়ং মেসি। কিন্তু এবারে যেন কাতারে পা রেখেছিলেনই জিতবেন বলেই। প্রতিটা ম্যাচেই ম্যাজিক মোমেন্টস-এর সাক্ষী থেকেছে কাতার। বিশ্বকাপ বলে নয়, জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই দ্বিতীয়কে কেই বা মনে রাখে বলুন! নচেৎ লুকা মাদ্রিচও কি আরও আরও বেশি আলোর দাবি রাখেন না এ বিশ্বকাপে? এই প্রশ্নকেই আরও জোরালো করে উস্কে দিলেন এমবাপে। গত রাতে তিনি নিজেকে প্রমাণ করেন সর্বাঙ্গে। রেকর্ড করতেও ভুল করেন না। কিন্তু তবুও দ্বিতীয় হয়েই দাঁড়ি পড়ে সফরে। গতকাল হ্যাটট্রিক করলেন তিনি। বিগত ৫৬ বছর পর বার হ্যাট্রিক বিশ্বকাপ ফাইনালে। শুধু তাই নয়, মোট ৮টি গোল করে সোনার বুটও জিতলেন তিনি। একই সঙ্গে সবথেকে কম বয়সে বিশ্বকাপে ১০ গোল করার রেকর্ডও গড়লেন এমবাপেই। অথচ দিনের শেষে নায়কের শিরোপা কি জুটলো তাঁর? নাকি প্রতিনায়ক হয়ে থেকে যাওয়া, এটাই নিয়তি ছিল ফরাসি ঝড়ের।

বিশ্বকাপের ফাইনালে এর আগের হ্যাট্রিকটি করেন জিওফ হার্স্ট, ১৯৬৬ সালে। তারপর থেকে কেউই দাঁত ফোটাতে পারেনি সেই রেকর্ডে। অথচ মাত্র ২৩ বছরের এক তরুণ ফুটবলার যেন অচিরেই মিইয়ে দিল সব হিসেব। পরীক্ষার খাতায় যেন একেবারে পরিচিত অঙ্কটি পেয়েছেন তিনি, চটজলদি উত্তর মিলিয়ে দিলেন তাই। অথচ ইতিহাস লিখেও ট্র্যাজিক নায়ক এমবাপে!

মাঠে এদিন আবারও মুখোমুখি দুটি ১০ নম্বর জার্সি। এই জার্সি নম্বরের ম্যাজিক দর্শক আগেও দেখেছে। ভুললে চলবে না লুকার জার্সি নম্বরও ছিল ১০। তিনিও শেষবেলায় জানকবুল লড়াই করে গিয়েছেন। এদিন প্রথমে খানিকটা ঝিমিয়ে পড়া মনে হলেও শেষ পর্যন্ত টানটান উত্তেজনা ধরে রাখার সবটুকু কৃতিত্ব এই এমবাপেরই। অবশ্য খেলার শেষ বাঁশিটি বাজার পর চিত্রটা বদলায়। নীল সাদা শিবিরের অমন বাঁধ ভাঙা উত্তেজনা, মেসি এবং এমি মার্টিনেজকে ঘিরে থাকা হাজার হাজার সতীর্থদের ভিড়ে এমবাপেও ছিলেন মাঠে। অথচ ছিলেন একাকী। কোনও উত্তেজনা তখন ঘিরে ধরেনি তাঁকে। বোধ করি অত উচ্ছ্বাসের মাঝে সবাই ভুলতে বসেছিল সোনার বুট জয় হয়েছে কিন্তু তাঁরই। অর্থাৎ দিনের শেষে তিনিও কিন্তু অজেয়। এর মধ্যেই ক্যামেরা হয়তো খানিক ভুল করে একবার ঘুরেছিল এমবাপের দিকেও। কালো ঘোড়ার মুখে তখন নিজের কৃতিত্বের লেশমাত্র ছিল না। দলের হার যেন মাথা পেতে নিয়েছেন তিনি। এমনটাই ‘টিম ম্যান’ এমবাপেও।

এমবাপে জন্ম প্যারিসের শহরতলিতে। খেলার শুরুটা হয় রাস্তায় ফুটবল দিয়েই। পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে রোজদিন খেলতেন তিনি। ছোট থেকেই ভরপুর উৎসাহ ছিল খেলায়। একটা সময় সেই উৎসাহ দেখেই তাতে সার, জল দিলেন তাঁর বাবা। ভর্তি করিয়ে দিলেন স্থানীয় ক্লাবে। তাঁর বাবার কোথায়, ঘুমে জাগরণে সবেতেই ফুটবল ছিল এম বাপের সফরসঙ্গী। মাত্র ১০ বছর বয়স থেকে প্যারিসের বাসিন্দাদের নজর কাড়েন এমবাপে। যে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে আদর্শ মেনে খেলায় নামেন এমবাপে, তাঁর রেকর্ডও ভেঙে দিয়েছেন ইতিমধ্যেই।

স্থানীয় ক্লাব থেকে শুরু করে এমবাপে সুযোগ খুঁজতে থাকেন ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবে খেলার। মাত্র ১১ বছর বয়সে ট্রেনিং করেন চেলসিতে। রিয়েল মাদ্রিদেও এবং মোনাকোর অ্যাকাডেমিতেও ট্রেনিং করেছেন এমবাপে। অতঃপর ডাক পান প্যারিস সাজাঁ থেকে। সেখান থেকেই উত্থান এমবাপের। প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে নেমে ছিনিয়ে নিলেন জয়ের শিরোপা। এ যে কেবল সৌভাগ্য নয়, বরং এর সঙ্গে রয়েছে তাঁর কৃতিত্বও তা বোধ করি আজ আর জানতে বাকি নেই। সোনার বুটের ঝলকানি তা জানান দিচ্ছে ইতিমধ্যেই।

নিজের প্রথম বিশ্বকাপে জয়, দ্বিতীয় বিশ্বকাপে সোনার বুট, বিগত ৫৬ বছরের রেকর্ড ভেঙে বিশ্বকাপ ফাইনালে হ্যাট্রিক অথবা একাধিক বিশ্বকাপের ফাইনালে গোল করা পঞ্চম ফুটবলার, রেকর্ডের পর রেকর্ড তাঁর ঝুলিতে। আর এ সবই মাত্র ২৪ বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। আজ মধ্যরাতেই জন্মদিন তাঁর। কিন্তু এ কি উচ্ছ্বাসের? অথচ সিনার বুট যখন তাঁর পায়ে তখন তার জৌলুসে তো ফেটে পড়ার কথা ছিল আজ ফরাসি শিবির! অথচ ট্র্যাজেডিই দস্তুর মতো তাড়া করলো তাঁকে। রেকর্ড গড়েও কেমন যেন ফিকে লাগছে তাঁকে। স্বপ্নের পথে যে কটা সিঁড়ি ছিল, তারই একটাতে আলো জ্বলেনি। তবে এই ঘা সারতে চার বছর তো অনেকটা সময়, আবারও তিনি ফিরবেন খিপ্র বাঘের মতোই। আজ থেকে হিসেব কষুক আগামী।

More Articles