দু'দফা দাবি নিয়ে আপস নয়, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আগেই স্পষ্ট বার্তা জুনিয়র ডাক্তারদের
RG Kar Doctor's Protest: শনিবার ডাক্তারদের যে প্রতিনিধিরা বৈঠকের জন্য কালীঘাটে এসেছিলেন, সোমবারও তাঁদেরকেই আসতে অনুরোধ করা হয়েছে ইমেলে।
এর আগে তীরে এসে তরী ডুবেছে চার-চার বার। শেষ মুহূর্তে এসে বাতিল হয়ে গিয়েছে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক। পঞ্চম বার জুনিয়র ডাক্তারদের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের জন্য ডাক পাঠাল নবান্ন। সোমবার সকালে মুখ্যসচিব মনোজ পন্থের তরফ থেকে ই-মেল পান চিকিৎসকেরা। জানানো হয়েছে, সরকারের তরফ থেকে এটিই ‘পঞ্চম এবং শেষতম চেষ্টা’। পঞ্চম বারে কি আলোচনার টেবিলে দেখা হতে চলেছে মুখ্যমন্ত্রী ও আন্দোলনরত চিকিৎসকদের? সেদিকেই তাকিয়ে গোটা দেশ।
আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি চলছে। প্রশাসনের কাছে রয়েছে তাঁদের নির্দিষ্ট ছ'দফা দাবি। প্রথম বার নবান্নের তরফে আসা মেল অপমানজনক বলে বৈঠকের আহ্বান এড়িয়েছিলেন আন্দোলনকারী চিকিৎসকেরা। তার পরের বার চিকিৎসকেরা নিজেরাই বৈঠকে সাড়া দেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু সেই বৈঠকও হয়নি শেষপর্যন্ত। এরই মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের তরফে জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে ফেরার অনুরোধ জানানো হয়। কাজে ফেরার জন্য বেঁধে দেওয়া হয় সময়ও। তবে কাজে ফেরেননি চিকিৎসকেরা। বরং মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে চার দফা শর্ত বেঁধে আন্দোলন চালিয়ে যান জুনিয়র ডাক্তারেরা। এর মধ্যে ফের আলোচনার ডাক দেওয়া হয় নবান্নের তরফে। সেই ডাক পেয়েই মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে নবান্নে যান আন্দোলনকারীরা। কিন্তু ডাক্তারদের শর্ত মেনে লাইভ সম্প্রচারে নবান্ন রাজি না হওয়ায় ফের বৈঠক বানচাল হয়ে যায়। গত শনিবার দুপুরে ধর্নামঞ্চে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পর বিকেলে কাকভেজা হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার জন্য তাঁর কালীঘাটের বাসভবনে গিয়েছিলেন জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি দল। তবে শেষপর্যন্ত সেই বৈঠকও আলোচনার টেবিল পর্যন্ত পৌঁছয়নি। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ফের ধর্নামঞ্চে ফেরেন জুনিয়র ডাক্তারেরা।
আরও পড়ুন: কেন গ্রেফতার টালা থানার ওসি? সুপ্রিম কোর্টে কী কী প্রমাণ দাখিল করবে সিবিআই?
এরই মধ্যে আরও একবার বৈঠকের জন্য ডাক পেলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। তাঁদের পাঁচ-ছ'দফা দাবির কথা গোড়া থেকেই বলে আসছেন আন্দোলনকারীরা। সেগুলি হল —
- আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত সমস্ত দোষীদের দ্রুত চিহ্নিত করা, অপরাধের উদ্দেশ্য সামনে আনা এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ।
- তথ্যপ্রমাণ লোপাটের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচার।
- সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণে ‘ব্যর্থ প্রমাণিত’ কলকাতা পুলিশের কমিশনার বিনীত গোয়েলের ইস্তফা।
- রাজ্যের সব মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা।
- রাজ্যের সব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভয়মুক্ত পরিবেশ গড়া এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ সুনিশ্চিত করা।
- স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা, স্বাস্থ্য আধিকারিকের পদত্যাগ।
আন্দোলনকারীদের বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য অন্যতম শর্ত ছিল, গোটা বৈঠকের লাইভ সম্প্রচার। তাতে প্রথম থেকেই রাজি হননি নবান্ন। সে সময় ভিডিওগ্রাফিতে রাজি থাকলেও পরে সেই দাবিও নাকচ করে দেওয়া হয় নবান্নের তরফে। সোমবার বিকেল ৫টা নাগাদ ফের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালীঘাটের বাড়িতে ডাকা হয়েছে আন্দোলনকারীদের। মুখ্যসচিব মনোজ পন্থের তরফে ইমেলে বলা হয়েছে, ‘‘গত ৯ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল, ১০ সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টা থেকে জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে ফিরতে হবে। নাগরিক হিসাবে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ পালন করা আমাদের কর্তব্য। তাই এটা আপনাদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক করানোর জন্য আমাদের তরফে পঞ্চম এবং শেষতম চেষ্টা। খোলামনে আলোচনার জন্য কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রী বাড়িতে আপনাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমরা বিশ্বাস করি, সুচিন্তার জয় হবেই। আপনাদের আগের দিনের বক্তব্য অনুযায়ী, এই বৈঠকের কোনও ভিডিয়োগ্রাফি বা সরাসরি সম্প্রচার হবে না কারণ, বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন। বৈঠকের পুঙ্খানুপুঙ্খ কার্যবিবরণীতে দু’পক্ষের সই থাকবে।’’
শনিবার ডাক্তারদের যে প্রতিনিধিরা বৈঠকের জন্য কালীঘাটে এসেছিলেন, সোমবারও তাঁদেরকেই আসতে অনুরোধ করা হয়েছে ই-মেলে। অর্থাৎ সোমবারও চিকিৎসকদের তিরিশ জন প্রতিনিধিকেই ঢুকতে দেওয়া হতে পারে। বিকাল ৪টে ৪৫ মিনিটের মধ্যে তাঁদের কালীঘাটে পৌঁছে যেতে বলা হয়েছে। তবে ই-মেল পাওয়ার পর এখনও ডাক্তারদের প্রতিক্রিয়া, পরবর্তী পদক্ষেপ জানা যায়নি। তবে যতদূর শোনা যাচ্ছে, নিজেদের ৬ দফা দাবির বিশেষ দু'টি দাবি নিয়ে অবস্থানে অনড় তাঁরা। আরজি করের চিকিৎসক খুনের তদন্তভার এখন সিবিআইয়ের হাতে। বিচারপ্রক্রিয়ার গুরুভার রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের এজলাসে। ফলে এই দুটোর কোনওটাই যে রাজ্য সরকারের হাতে নেই, তা ভালোই বুঝতে পারছেন আন্দোলনরতরা। আবার সুরক্ষাকাঠামো বা ভয়মুক্ত পরিবেশের ব্যাপারেও রাজ্য কিঞ্চিৎ হলেও সচেষ্ট। তাছাড়া সুপ্রিম কোর্ট এ ব্যাপারেও মতামত দিয়েছে। পড়ে রইল কলকাতার পুলিশ কমিশনার পদ থেকে বিনীত গোয়েলের অপসারণ, স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা ও স্বাস্থ্য আধিকারিকের পদত্যাগের দাবি। এই দুই দাবি নিয়ে কোনও রকম সমঝোতা নয় বলেই জানা গিয়েছে চিকিৎসকদের তরফে।
সূত্রের খবর, জুনিয়র ডাক্তারদের অধিকাংশের মতে, বাকি চার দফা দাবির মধ্যে সরকার দুটি মেনে নিলেই কর্মবিরতি তুলে নেওয়া উচিত। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এমনিতেই হাসপাতালে ভয়মুক্ত পরিবেশ সুনিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। তা ছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা পরিকাঠামো বাড়ানোর ব্যাপারেও সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়ে রেখেছে। সরকারকে মঙ্গলবার এ বিষয়ে স্ট্যাটাস রিপোর্ট পেশ করতে হবে সর্বোচ্চ আদালতে। এই দাবিগুলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমনিতেই মেনে নিয়েছেন। শনিবার ধর্নামঞ্চে গিয়ে তিনি পরিষ্কার করে বলেছেন সেটি। সেই সঙ্গে হাসপাতাল পরিচালন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনা ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করে নেওয়ারও আশ্বাস দিয়েছেন।
জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশের দাবি, অনেকেই কাজে ফিরতে চাইছেন। কারণ তাঁদের এর পরেও জেদাজেদি করলে সর্বোচ্চ আদালতও তা ভালো ভাবে না-ও নিতে পারে। তা ছাড়া সরকার যেহেতু সহানুভূতি দেখাচ্ছে এবং বারবার আলোচনার জন্য ডাকছে, তাতে এর পর কোনও আড়ষ্টতা দেখালে জনমতও বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে। গত শুনানিতেই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় জানিয়ে দিয়েছিলেন, ১০ সেপ্টেম্বর বিকেল ৫টার মধ্যে জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে ফিরতে হবে। কিন্তু তার পরেও কর্মবিরতি চালিয়ে যাচ্ছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। নির্ধারিত সেই সময়ের পর আরও পাঁচ দিন কেটে গেছে। মঙ্গলবার ফের সুপ্রিম কোর্টে মামলার শুনানি রয়েছে। জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে বড় অংশ মনে করছে, কর্মবিরতি সোমবার প্রত্যাহার না করলে মঙ্গলবার আদালতের ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হবে। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশকে অবমাননা করা সঙ্গত কাজ হচ্ছে না।
আরও পড়ুন: ক্ষমা চাইলেন মমতা, আরও একবার ফিরে যাচ্ছেন চিকিৎসকেরা
সোমবার দেখতে দেখতে সাত দিনে পড়ল জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্না। স্বাস্থ্য ভবনের সামনে বৃষ্টি, খারাপ আবহাওয়া মাথায় করেই তাঁদের আন্দোলন চলছে। শনিবার শেষ বার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার জন্য জুনিয়র ডাক্তারেরা পৌঁছলেও সরাসরি সম্প্রচার এবং বৈঠকের ভিডিয়োগ্রাফির দাবি নিয়ে মতানৈক্যে ফের ভেস্তে যায় বৈঠক। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অপেক্ষা করেছিলেন ডাক্তারেরা। মমতা নিজেও বেরিয়ে এসেছিলেন। বৈঠক না করতে চাইলে তাঁদের অন্তত চা খাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন তিনি। কিন্তু তাতেও রাজি হননি জুনিয়র ডাক্তারেরা।
কালীঘাট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ডাক্তারেরা জানান, মুখ্যমন্ত্রীর কথা মতো নিজেদের সব শর্তই ছেড়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। সরাসরি সম্প্রচার এবং ভিডিয়োগ্রাফি ছাড়াই বৈঠক করতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু শেষে তাঁদের বলা হয়, তিন ঘণ্টা মুখ্যমন্ত্রী অপেক্ষা করেছেন। আর বৈঠক সম্ভব নয়। আবার সল্টলেকের ধর্নামঞ্চে ফিরে আসেন ডাক্তারেরা। তার পর সোমবার আবার তাঁদের বৈঠকের জন্য ডাকা হল। সরকারের তরফে এটাই শেষ চেষ্টা, জানিয়ে দিলেন মুখ্যসচিব। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যপ্রশাসনের জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতি শেষ আহ্বান সফল হবে তো আদৌ? নাকি সে-ই পথেও পড়বে আগের দিনের মতোই কাঁটাচ্ছে। ভাবাচ্ছে গোটা রাজ্যকেই।