বাবরি ধ্বংসের প্রেক্ষাপটে অমর বন্ধুত্বের গল্প! কেন দেখতে হবে 'দোস্তজী'
Film Review: দিনের শেষে, 'দোস্তজী' একটি সৎ কাজ। আর আক্ষরিক অর্থেই 'ছবি' বা 'ফিল্ম'।
এক চিনচিনে ব্যথাকে ছবিটা শুরু থেকে ধরতে চায়। ব্যথাটা একটু-একটু করে দর্শকের মধ্যে ছড়িয়ে যায়, মনের গভীরে গিয়ে ধাক্কা মারে। 'এ ছবি তো সোজা-সাপ্টা নয়!', 'বেশ গুছিয়ে বানানো ছবি' ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে যেই দ্বিতীয় ভাগ এল, অমনি ছবির ছন্দ এলোমেলো হয়ে গেল। প্রথম ভাগের ন্যারেটিভ যে অভিমুখে এগোচ্ছিল এবং যে প্রান্তবিন্দুতে পৌঁছনোর কথা ছিল, তা হলোই না! এমনটা কেন?
প্রসূন চট্টোপাধ্যায়ের ছবি 'দোস্তজী'-র কথা বলছি। বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে মুম্বইতে বিস্ফোরণ ও দেশজুড়ে দাঙ্গা ইত্যাদিকে কেন্দ্রে রেখে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছবি অতীতে হয়ে গেছে। মণি রত্নমের মাস ফিল্ম 'বম্বে' (১৯৯৫) বা সৈয়দ আখতার মির্জার ক্লিনিক্যাল স্টাডি 'নাসিম' (১৯৯৫)-এর মতো কয়েকটি ছবি সেই সময়ের আবর্তেই আমরা পেয়েছিলাম, ছবিগুলো বানানোও হয়েছিল সময়ের দাবি মেনে। তাই যখন শুনি বাবরি ধ্বংসের পরবর্তী প্রভাবকে প্রেক্ষিত বানিয়ে আবার একটা ছবি আসতে চলেছে, তাও বাংলায়― তখন স্বভাবতই উৎসুক হয়ে উঠেছিলাম। অনেক প্রত্যাশা নিয়ে দেখতে গিয়ে খানিক আশাহত হলাম বলা চলে।
'দোস্তজী' ছবির গল্পের কেন্দ্রে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত একটি গ্রাম ও সেখানকার দুই শিশুর বন্ধুত্বের ক্রম-বিবর্তন। পলাশ (আশিক শেখ) আর সফিকুল (আরিফ শেখ) পাশাপাশি বাড়িতে থাকে। এক স্কুলে পড়ে ওরা। একসঙ্গে স্কুলে যায়। পলাশ পড়াশোনায় ভালো হলেও সফিকুলের পড়ায় মন বসে না। বচ্চনের 'দিওয়ার' ছবির পোস্টারের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। ছবি তুলতে গিয়ে নায়কের মতো পোজ দিয়ে দাঁড়ায়। কষ্ট করে একটা ঘুড়ি কেনে সফিকুল, নদীপারে যায় পলাশকে নিয়ে ঘুড়ি ওড়াবে বলে। অথচ চেত্তা দিতে গিয়ে পলাশের কারণে ঘুড়ির কাঠি ভেঙে যায়। সেই নিয়ে দুই বন্ধুর মন কষাকষি, অভিমান। রাগের বশে একজন আরেকজনকে বলে বসে, 'আমি তোমার সঙ্গে জীবনে কথা বলব না।’ স্কুলে দু'জন আলাদা বসে। অথচ কথা বলব না বললেই কি আর থাকা যায়? নতুন ঘুড়ি কেনার পয়সা জোগাড় করে পলাশ, বন্ধুর জন্য একবেলা হেঁটে স্কুলে গিয়ে। দেশজুড়ে ধর্মীয় উন্মাদনার কারণে সেই ছবির মতো সুন্দর গ্রামেও এসে লাগে ভয়াবহ আঁচ। গ্রামের মুসলমান সম্প্রদায় মসজিদ বানাতে চায়, ওদিকে হিন্দুরা চায় মন্দির বানাতে। পলাশ আর সফিকুলের পরিবারের বড়রা পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে না, দুই বাড়ি বেড়া দিয়ে আলাদা করা। সফিকুল জল খেতে চাইলে পলাশের মা আলাদা রাখা গ্লাসে করে জল দেয়। সফির আব্বা সফি-কে রামযাত্রায় যেতে বারণ করে। পলাশের পরিবার আতঙ্কের চোটে নদিয়ার হিন্দু-প্রধান এলাকায় উঠে যাওয়ার সংকল্প নেয়।
আরও পড়ুন: কেন দেশজুড়ে আলোড়ন বাংলা ছবি ‘দোস্তজী’ ঘিরে? কোন জাদুতে মাত অমিতাভ থেকে প্রসেনজিৎ
থেকে-থেকে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম শুরুর ভাগের বেশ কিছু মুহূর্তে। অদ্ভুত এক গতিতে ন্যারেটিভ এগোচ্ছে― যা খুবই স্বাভাবিক লাগছিল― এরকম ভাবনা ঘুণাক্ষরেও মনে আসেনি যে, এই দুই বাচ্চার সারল্যকে নির্মাতা 'স্পুনফিড' করাতে চাইছেন জোর করে। এরকম ভাবনা আসার কথা নয়, কিন্তু আসে, কারণ আমাদের বাংলা ছবি ও বেশ কিছু অন্যান্য আঞ্চলিক ছবিতে এই সমস্যাটা এখনও আছে, বেশ ভালোরকমভাবেই আছে। নান্দনিকভাবে সুন্দর বানাতে গিয়ে ছবির প্রকরণ হয়ে ওঠে দুঃসহ, এলোমেলো ও সর্বোপরি অহেতুক। 'দোস্তজী'-তে সেসবের অবতারণা নেই শুরুতে, একেবারে নিজস্ব এক ছন্দ নিয়ে ছবি এগোনো শুরু করে। এই ছন্দ আক্ষরিক অর্থেই মুর্শিদাবাদের অন্দরের ছন্দ এবং প্রসূনের সিনেভাবনার ছন্দ। বেশ কিছু মুহূর্ত, যেমন এখনই মনে পড়ছে― রামায়ণ-কেন্দ্রিক যাত্রাপালা আর ব্যাকস্টেজে রাম, রাবণ ও হনুমানের একত্রে সিগারেট খাওয়া। সেখানে সূক্ষ্মভাবে কমেন্টারি করা হয়েছে। এরকম আরও অনেক মুহূর্ত আছে। গোটা গ্রামে যখন বাইরের পৃথিবীর সাম্প্রদায়িকতার আঁচ এসে লাগছে বড়দের গায়ে, সেখানে এই দুই সরল বাচ্চা ছেলে নিজেদের আপন লয়ে জীবন কাটিয়ে চলেছে। দেখানোর জন্যই দেখানো না, প্রসূন অনেকভাবে অনেককিছু বলতে চেয়েছেন, তাতে সফলও হয়েছেন, আর সেই যে এক অদেখা চিনচিনে কষ্ট, সেই কষ্ট বা ব্যথা মনের গভীরে ছড়িয়ে যাচ্ছিল অনেকানেক হাসির উপাদান থাকা সত্ত্বেও। বাইরে চলছে আদর্শগত যুদ্ধ, আর এই গ্রামের ভিন ধর্মের দুই শিশুর বন্ধুত্ব সেই যুদ্ধের মুখে সপাটে থাপ্পড় যেন বা! খুব সুন্দর এক পরিপূরক সুর-তাল-লয়ে এগোচ্ছিল ছবি। গতি দ্রুত কি কম, তা বলছি না। এই তাল ছবিটার আপন তাল, গত সাত-আট বছর ধরে পরিশ্রম করে বানানো কাজের নিজস্ব তাল।
কিন্তু দ্বিতীয় ভাগের তাল-লয় একেবারে ভিন্নদিকে মোড় নেয় ও ব্যক্তিগত মতে, প্রথমভাগের প্রত্যাশা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। এখানে স্বভাবতই বলা যায় যে, এটাই তো হওয়া উচিত! ইন্টারভালের আগে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে, তার পরবর্তী ন্যারেটিভ তো এমনই হওয়া দরকার! ছবির গতি শান্ত হয়ে যাবে, আগে ছিল দুই বন্ধু, এখন কেবল এক, তার মাধ্যমেই তো গল্প আনফোল্ড হবে! এসব মেনেও বলতেই হয়, ছন্দ কেটেছে। মন খারাপের নতুন ছন্দ, যা গড়ে তোলার কথা ছিল দ্বিতীয় ভাগ থেকে ক্লাইম্যাক্স পর্যন্ত, তা দুর্ভাগ্যবশত গড়ে ওঠেনি। যে ছবি শুরুতে এত বাহুল্যবর্জিত, যথাযথ ও সচেতন, সেই ছবি একটা নির্দিষ্ট পর্যায় অতিক্রম করার পর কেন অহেতুক সবকিছুকে টেনে-টেনে বড় করে দেখাতে চাইবে কোনও আবশ্যক প্রয়োজনীয়তা ছাড়া? শুঁয়োপোকার কামড় খেল সফিকুল, আর তারপর থেকে সেই পোকার প্রজাপতি হয়ে উড়ে যাওয়া অবধি সমস্ত সিকোয়েন্স, শট সেন্স আরও আঁটোসাঁটো হওয়া উচিত ছিল। ঘটনার বেগকে পলাশের পরিবার আর সফিকুলকে কেন্দ্র করে ওইভাবে আবর্তিত না করে সামগ্রিক রিদমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিকল্পনা করা যেতে পারত। ইমোশনাল দিক থেকে ধাক্কাটা পাওয়ার পরে পোক্ত হাতে দর্শকদের সামনে নতুন কিছু পেশ করা উচিত ছিল। অথচ, যা হচ্ছে ও যা হতে চলেছে, সবই যেন কীভাবে দর্শক টের পেয়ে যাচ্ছে আগে থেকে!
আর এই ছবি তো কোথাও পৌঁছচ্ছে না সেই অর্থে, অবশ্যই সফিকুলের কামিং অফ এজ-কে ও দুজনের বন্ধুত্বের অমরত্বকে ফোকাসে আনতে চাইছে ছবি, কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না! শুরুতে যে প্রেক্ষিত, যে ধর্মীয় চাপা উন্মাদনায় ছবির চরিত্রদের জগতকে দেখানো হতে থাকে, সেই প্রেক্ষিতই বা কোথায় ও কেন ভ্যানিশ হয়ে গেল? এটা আমার বেশ খারাপ লেগেছে, সত্যি বলতে। দর্শকের প্রত্যাশা তৈরি করা হচ্ছে একভাবে, অথচ ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছতে-পৌঁছতে ছবির ভাষ্য অনেকটাই বদলে যাচ্ছে, এটা তো আশা করিনি! প্রথমে ভাবছিলাম ও ভাবানোও হচ্ছিল যে― যে উন্মাদনা দেশের বিভিন্ন মেট্রো শহর ও মফস্বলকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল, ইতিহাস বদলে দিয়েছিল চিরতরে, সেই প্রেক্ষিতকেই বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে দুই শিশুর বন্ধুত্বের কাঠামোয় ফেলে পর্যবেক্ষণ করা হবে সময়কে। কিন্তু এ তো সময়ের নিরীক্ষা নয়, এ তো বন্ধুত্বের গল্প! কিন্তু বন্ধুত্বের বিবর্তন এমন 'রিপিটেটিভ' হয়ে যাবে কেন শেষের দিকে এসে? সত্যি বলতে খুবই আশাহত হলাম এত চমৎকার একটা কাজের দিশাহীন গতি দেখে।
এই প্রসঙ্গে একটি বিষয়ে আলোচনা করতে চাই। প্রসূন ও তাঁর টিমের এটিই প্রথম কাজ, পরিশ্রমের সীমা-পরিসীমা নেই এ কাজের পিছনে। বিগত সাত-আট বছর ধরে ছবিটা বানানো হয়েছে ধাপে-ধাপে। জার্নির ব্যাপারে আশা করি সবাই অবগত। কত লাঞ্ছনা, গলাধাক্কা, বঞ্চনা, কষ্ট, জটিলতা, অনেক রকম হতাশ মুহূর্ত পার করে 'দোস্তজী' তৈরি হয়েছে আর আমরা এই ২০২২-এর শেষে এসে বড় পর্দায় তা দেখার সুযোগ পাচ্ছি। এগুলো ব্যর্থ নয় কোনওভাবেই। কারও একবিন্দু পরিশ্রমও অহেতুক নয়। এই ছবির পিছনের ভাবনাকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। খুবই চমকে যেতে হয় ছবির প্রথম ভাগ দেখে। এত পরিণতভাবে বক্তব্য রাখছেন নির্মাতা, সর্বোপরি দর্শককে ভাবনার খোরাক যোগাচ্ছেন। দর্শক ভাবছে ছোট-ছোট বিষয় নিয়ে। ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। সূক্ষ্ম কিছু মন্তাজ, সিন ক্রিয়েশন, ছবির তালমেল সবই চোখে পড়েছে। কিন্তু ছবির দ্বিতীয় ভাগ তুলনামূলকভাবে দুর্বল, নানা আঙ্গিক দিয়েই। 'দোস্তজী' শেষভাগে অন্য গতিজাড্য ধরে নিয়েছে। বন্ধু-বিচ্ছেদজনিত সেই একরৈখিক শোক বারবার দেখানো হতে থাকলে তার আর তেমন অর্থ ও গভীরতা থাকে না। দর্শকের মনে শক-ভ্যালু ও শোক-ভ্যালু সব তরলায়িত হয়ে যায়।
পলাশ ও সফিকুলের চরিত্রে অভিনয় করা আশিক ও আরিফ শেখ এই ছবির অনবদ্য দুই সম্পদ। যেভাবে এই দু'টি বাচ্চা ছেলে অভিনয় করেছে, তা মনে রাখার মতো। তুহিন বিশ্বাসের ক্যামেরার কাজ বেশ নিটোল, গল্পের সঙ্গে প্রবল মানানসই। এই ছবি সম্পাদনা করেছেন সুজয় দত্তরায় ও শান্তনু মুখোপাধ্যায়। দ্বিতীয়ার্ধে সম্পাদনায় আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন ছিল। কালারিস্ট মানস ভট্টাচার্য খুব বিশ্বাসযোগ্যভাবে সুখ-দুঃখের নানা পরত তুলে ধরেছেন। প্রসূন চট্টোপাধ্যায় এই ছবির কথক ও চিত্রনাট্যকার, পরিচালক ও শব্দ পরিকল্পক। খুবই যত্ন নিয়েছেন সব ক্ষেত্রে, তবে চিত্রনাট্যে দুর্বলতা থাকার দরুন অনেককিছুতে প্রভাব পড়েছে।
উদ্যোগ, প্রচেষ্টা, এতদিনের পরিশ্রম ও অধ্যাবসায় ব্যর্থ একেবারেই নয়, সেই দাবিও কেউ করছে না। কথা হোক 'দোস্তজী' নিয়ে। সবাই দেখতে যাক। দিনের শেষে, 'দোস্তজী' একটি সৎ কাজ। আর আক্ষরিক অর্থেই 'ছবি' বা 'ফিল্ম'। গতে বাঁধা কাজ নয়, ফাঁকি দিচ্ছে না দর্শককে। এই কারণেই হলে গিয়ে 'দোস্তজী' দেখা দরকার।