Film Review: জঞ্জালের স্তূপ, নেশাগ্রস্ত রোজনামচা! অন্য এক কলকাতার খোঁজ দেয় 'ঝিল্লি'
Film Review: ঈশান ঘোষের হাত ধরে 'ঝিল্লি'-তে কলকাতার মাঝেই লুকিয়ে থাকা অন্য এক অচেনা কলকাতা কত সহজে ধরা দিয়েছে!
জঞ্জালে ভরা, দুর্গন্ধময় ধাপার মাঠ আর কিছু 'অচ্ছুৎ' মানুষজন। ঈশান ঘোষের চলচ্ছবি 'ঝিল্লি'-র চরিত্র এরাই।
বাংলা ভাষায় নির্মিত ছবির ভিড়ে 'ঝিল্লি' অভিনব এক প্রচেষ্টা। কল্পনাতীত জীবনের রোজনামচা, অজস্র দীর্ঘশ্বাস ও অনেক কিছু না-পাওয়া দিয়ে ভরা এই ন্যারেটিভের খুব প্রয়োজন ছিল। বাংলা ফিল্ম মার্কেটে মেদসর্বস্ব গোয়েন্দাকাহিনি ও ছেলেভোলানো অ্যাডভেঞ্চারের দাপটের মুখে এই ছবি এক সপাটে থাপ্পড়।
ঈশান ঘোষের হাত ধরে এই ছবিতে কলকাতার মাঝেই লুকিয়ে থাকা অন্য এক অচেনা কলকাতা কত সহজে ধরা দিয়েছে! "ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি"― কথা-ক'টা এই ছবিতে অদ্ভুত ছন্দে উপস্থাপিত হয়েছে, যে ছন্দ একদম নতুন ও যথাযথ। ক্যামেরা ছুটছে ধাপার মাঠ করে শহরের দুরন্ত পথে-ঘাটে, 'অস্পৃশ্য' চরিত্রগুলোর তালে তাল মিলিয়ে। যেন বিহ্বল দর্শকদের ঈশান বলছেন― এই নাও, এদের চোখ খুলে-মন ভরে দেখো। এই হচ্ছে এরা, কেন্নোদের দল, যাদের কথা আধুনিক সভ্যতা ভুলে গেছে পুরোপুরি। মেট্রোপলিস বাড়ছে পরিসরে, এদের সংখ্যা কমে চলেছে, হয়তো একদিন হারিয়েই যাবে সবক'টা। যে ফ্লাইওভার দিয়ে রোজ ছুটে চলে অগুনতি স্বপ্ন, ঠিক তার তলায় হয়তো পড়ে স্বপ্নহীন ঘুমে মগ্ন কোনও অন্ত্যজ উইপোকা। স্বাধীনতার উন্মাদনায় 'প্রিভিলেজড' আমরা ভেসে বেড়াই, অথচ এদের কাছে তেরঙ্গা পতাকাটা একটা কাপড়ই কেবল। এই ছবি ভুলে ভরা জীবনের কথা বলে। আর্থসামাজিক প্রেক্ষিতে ধাপার মাঠকে কেন্দ্রে রেখে প্রশ্ন করার সাহস রাখে। ছবিটা অন্তহীন খিদেকে ক্যামেরাবন্দি করে অসম্ভব মুনশিয়ানায়।
আরও পড়ুন: ডেনড্রাইটকে অক্সিজেন ভাবে যারা, সেইসব মানুষের গল্প বলে ‘ঝিল্লি’
বকুল, গণেশ, শম্ভুদা, চম্পা আর গুড্ডুর মতো এমনই অনেক উইপোকা আমাদেরই আশপাশে ঘুরে বেড়ায়, যাদের অবয়ব আমাদের শোভিত চোখে ধরা পড়ে না। গোটা শহরের ময়লা জমা হয় যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে, সেখানকার বাসিন্দা এরা। আমাদের চিরাচরিত ঠিক-ভুলের বাইরে বেরিয়ে অন্য সব জীবনকে লেন্সে ধরা হয়, যা ভয় ধরায়, দম বন্ধ করে দেয়। গণেশ শহরে রোজগারের ধান্দায় থাকে। ক্রমশ অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকা বকুলকে বলে 'এখান' থেকে বেরিয়ে যেতে। ধাপার মাঠে বেশিদিন থাকলে দেহ বিকল হয়ে যাবে চিরতরে। বকুল পারে না বের হতে। মাদকাসক্ত বকুলকে আরও অন্ধকারে ঠেলে দিতে থাকে জীবনের অর্থহীনতা। চম্পা তার তৃতীয় লিঙ্গপরিচিতির জন্য সর্বত্র লাঞ্ছিত হয়। শম্ভুদার এত বয়স হলো, অথচ জীবনে স্থায়ী রোজগারপাতি কিচ্ছু নেই। বড় জায়গায় সুপারভাইজারের চাকরি পেয়েছে, বিশহাজার টাকা মাইনে― এইসব মিথ্যে বলে ক্ষণিকের শান্তি পায়। এইসব অচ্ছুৎদের যে জীবন হতে পারত, অথচ হয়নি― এই না-হওয়াকেই ক্যামেরাবন্দি করেছেন ঈশান। অথচ কাজটা সামলেছেন বেশ দক্ষ হাতে। তার কারণ, এই ধরনের ছবি করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, 'আর্ট হাউজ', 'অ্যাস্থেটিক্যালি অ্যারাউজিং' গোছের ছবি বানানোর চেষ্টা ছবির কাঠামোতে প্রকট হয়ে ওঠে। ঈশান সেইসব দিক মেপে-বুঝেই ছবি বানিয়েছেন ও সম্পাদনা করেছেন, যার দরুন 'ঝিল্লি' বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যম হয়ে ওঠেনি। ঈশান দেখাতে চেয়েছেন যে, জীবন এরকমই। এই গল্পগুলোও তাই আমাদের দেখা-শোনা-বোঝা প্রয়োজন।
এত গতিশীল একটা ছবি দেখে বিভোর হয়ে যেতে হয়। ক্যামেরার সে কী লিরিক্যাল মুভমেন্ট! কোনও দেখনদারি নেই, নেই কোনও আতিশয্য। 'ঝিল্লি' সবাই বানাতে পারবে না। ওইভাবে ক্যামেরাকে দিয়ে কথা বলানো সবার পক্ষে সম্ভব নয়।
ঈশান ঘোষ প্রখ্যাত ফিল্মমেকার গৌতম ঘোষের সুযোগ্য সন্তান। বাবার ছবিতে বিভিন্ন টেকনিক্যাল কাজকর্ম শেখার মাধ্যমে ফিল্মমেকিং-এ হাতেখড়ি। গৌতম ঘোষের ছেলে, তার মানে অনেক সুবিধাপ্রাপ্ত কেউ, এই ধারণাকে আক্রমণ করতে চেয়েছেন 'ঝিল্লি' বানিয়ে। সবসময় একটা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে-যেতে আরও বেশি পরিশ্রম করে নিখুঁত কাজ বের করার মনোবাসনা তৈরি হয়। চার-পাঁচ বছর ধরে এই ছবিটা শুট করা হয়েছে। ঈশান একটা ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। ধরেছিলেন সেইসব না-দেখাকে, যা আমাদের চোখের অদৃশ্য পর্দার আড়ালেই থেকে যায়।
বকুলের চরিত্রে অরণ্য গুপ্ত ধাপার মাঠে নিজেকে পুরোপুরি মিশিয়ে দিয়েছেন। এমন সুদক্ষ চরিত্রচিত্রণ খুব সহজ কথা নয়। বিতান বিশ্বাস (গণেশ) আশ্চর্য অভিনয় করেছেন। এছাড়া অবশ্যই উল্লেখযোগ্য শম্ভুনাথ দে (শম্ভুদা), সায়নদীপ গুহ (গুড্ডু) ও সৌরভ নায়েক (চম্পা)। প্রত্যেকেই মন দিয়ে নিজেদের কাজ করেছেন। ঈশান ছবিটা লিখেছেন, পরিচালনা করেছেন, সম্পাদনা করেছেন, সিনেমাটোগ্রাফি সামলেছেন। একা হাতে অনেক কাজ সামলাতে গেলে দক্ষতার প্রয়োজন হয় এবং 'ঝিল্লি' দেখে বলাই চলে যে, ঈশানের সেই দক্ষতা রয়েছে। তবে যা নিয়ে না বললেই নয়, তা হচ্ছে এই ছবির সাউন্ডের কাজ। ছবির নিজস্ব দৃশ্য-শ্রাব্যর সুরকে নানান মাত্রা যোগ করেছে অনীশ বসুর সাউন্ড ডিজাইন ও মিক্সিং। হাইব্রিড প্রোটোকলের সৌম্যজিৎ ঘোষ ও রাজর্ষি দাস এই ছবির স্কোর তৈরি করেছেন। এই ছবির মেজাজের সঙ্গে তাল রেখে কালারের অপূর্ব কাজ করেছেন মানস ভট্টাচার্য। সবার দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে যে ফসল ঘরে তোলা হয়েছে, তার স্বাদ অতুলনীয়।
'ঝিল্লি' দেখাকালীন ক্লোয়ি ঝাও পরিচালিত 'নোম্যাডল্যান্ড'-এর ছন্দ মনে পড়ে যাচ্ছিল কয়েকবার। ২০২০ সালে সেরা চলচ্চিত্রর জন্য অস্কার ও আরও অন্যান্য খ্যাতনামা পুরস্কার জিতে নেওয়া এই ছবিতে দেখানো হয় একুশ শতকের চরম আর্থিক মন্দার সম্মুখীন আমেরিকার পরবর্তী দশকে বদলাতে থাকা অর্থনীতি আর কিছু ঠিকানাহীন মানুষের লড়াইকে। অদ্ভুত ছন্দ দুটো ছবিরই, অথচ, তা কিন্তু কানে আঙুল গুজে শুনিয়ে দেওয়ার ছন্দ নয়। এই ছন্দ অনুভব করতে হয়। ছবির অভ্যন্তরীণ রিদম। হৃদয়ঙ্গম করার উপযোগী মন থাকতে হয়।
'ঝিল্লি'-তে কি খারাপ কিছুই নেই? অবশ্যই আছে। ন্যারেটিভে উত্থান-পতন কম, বেশ কিছু রিপিটেটিভ সিকোয়েন্স আছে (আকাশ দিয়ে এরোপ্লেন যাওয়ার শট), ক্লাইম্যাক্সের শেষ মিনিট পনেরোতে তাড়াহুড়ো ও এলোমেলো ভাব। এসব কয়েকটি প্রেক্ষিত রয়েছে, যেগুলোতে আরও যত্ন নেওয়া যেতেই পারত। কিন্তু ঈশানের এই সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি দিয়ে গোটা একটা ছবি বানানোর সৎ প্রচেষ্টাকে কোনও ভাবেই বাতিল করে দেওয়া যায় না। 'ঝিল্লি' অবশ্যই প্রয়োজনীয় একটা ছবি। এইভাবেও কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিকে যে দেখানো যেতে পারে, তা 'ঝিল্লি' না বানানো হলে বোঝা সম্ভব হত না। বিবিধ আলোচনার দাবি রাখে এই ছবি।
ঈশান ছবিটার উৎসর্গপত্রে লিখেছেন, 'To all the misfits of society whose voices remain unheard... but they do exist.' এ যেন এক অচ্ছুৎনামা, যার কোনও শুরু নেই, শেষও নেই। ঘটমান যাপনের ছন্দ, সুর, তাল, লয়, হতাশা, আফসোস, উৎসাহ ও ঔজ্জ্বল্য― সব নিয়েই 'ঝিল্লি'।