Film Review: অবাস্তব গল্প, একঘেয়ে প্রসেনজিৎ, বেমানান দেব! হতাশ করল 'কাছের মানুষ'
Film Review: কেমন হলো প্রসেনজিৎ-দেব অভিনীত 'কাছের মানুষ'?
পথিকৃৎ বসুর ছবি 'কাছের মানুষ' দেখে এই ধারণায় একপ্রকার বাধ্য হয়েই উপনীত হতে হয় যে, বাংলা ছবির দর্শকরা নিতান্তই বোকা। অন্তত দর্শকদের এমনটাই ভাবা হয় আর কী।
ছবির শুরুতে দেখা যায়, কুন্তল (দেব) নামের এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের যুবকের ভাই কোনও এক চিটফান্ডের এজেন্ট ছিল, সেখানে অনেকের টাকা লগ্নি করিয়েছিল, অথচ কোম্পানি ডুবে যাওয়ায় বহু মানুষের আর্থিক ক্ষতি হয়, লগ্নিকারীরা ভাইকে আক্রমণ করতে থাকে, অবশেষে বাইরের ও ভেতরের উভয়বিধ গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় কুন্তলের মা প্যারালাইজড হয়ে গিয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। পাওনাদারদের আনাগোনা কমতে থাকলেও কুন্তলের মনে অপরাধবোধ জন্মাতে থাকে, ভাইয়ের মৃত্যু, মায়ের অসুস্থতা- সমস্তকিছুর জন্য সে নিজেকে দোষারোপ করতে শুরু করে। তারপর একদিন সে নিজেই রেললাইনে কাটা পড়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। রেললাইনের ধারে তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় সুদর্শন (প্রসেনজিৎ) নামের এক ব্যক্তির, যে কিনা নিজেও আত্মহত্যা করবে বলেই সেখানে উপস্থিত হয়েছিল। সুদর্শন ইনশিওরেন্স এজেন্ট, বাড়িতে এক অসুস্থ বোন আছে, নিজে আগে গ্রাহকদের প্রিমিয়ামের টাকা মেরেছিল বলে সর্বত্র অবহেলিত। কুন্তলকে পেয়ে সুদর্শন এক অদ্ভুত চাল চালে― বাজারে আসা নতুন পলিসি 'জীবন আসান' যদি কুন্তলের নামে করানো যায় এবং পলিসি করানোর পর যদি কুন্তলের কোনও কারণে অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু হয়, তাহলে যে নমিনি থাকবে, সে সম্পূর্ণ ডেথ বেনিফিট পেয়ে যাবে। কুন্তল যদি নিজের মা-কে নমিনি করে যায়, তাহলে কুন্তলের মৃত্যুর পর সুদর্শন কুন্তলের মাকে টাকাটা পাইয়ে দেবে এবং বখরা তখন দুইভাগ হবে, একভাগ কুন্তলের মা পাবে এবং অন্যভাগ দিয়ে সুদর্শন নিজের বোনের হার্টের চিকিৎসা করাতে পারবে। কুন্তল এমনিতেও মরতে চাইছিল, আজ নয় তো কালই, এই ভেবে খানিক টালবাহানার পরে সুদর্শনের প্রলোভনে সে পা বাড়ায়। সমস্যা শুরু হয় তখনই, যখন কুন্তল ক্রমশ জীবনের তুচ্ছ সুখ-দুঃখগুলোকে ভালবাসতে শুরু করে।
খুব ছিমছাপ প্রেক্ষাপট হলেও একবার কেবল ভাবুন, মরব-মরব বলে হাহাকার জুড়ে দিয়েছে অমন জিম-টোনড একটি ছেলে, কুন্তল (দেব), যার বাবা মারা গেছে, ভাই সুইসাইড করেছে, মা প্যারালাইজড হয়ে গেছে, কিন্তু মাথার ওপর তাদের একটা ছাদ আছে, মাস গেলে ভাড়া গুণতে হয় না। কষ্ট করে সে কি দুটো পেটও চালাতে পারে না? এতটাই বেকার সে? কুন্তল সাড়ে চার বছর নাকি চাকরি করেছে, এখন চাকরি নেই, অথচ চাকরি নেওয়ার কোনও চেষ্টাটুকুই নেই ছবির শুরুতে (শেষের দিকে আছে, তাও নাম কা ওয়াস্তে)! নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েরা সামান্য টিউশন করে হলেও রোজগার করে থাকে। ধার-দেনা থাকে কমবেশি, সেই আঁচ তো কুন্তলের গায়ে লাগছে না। নিজেই সে বলছে ছবির শুরুতে, ভাই চিটফান্ডের এজেন্ট ছিল, সবাই মিলে টাকা ঢেলেছিল, এখন কোম্পানি বসে যাওয়ায় ভাইকে সবাই ছেঁকে ধরেছে, তাই ভাই নিরূপায় হয়ে সুইসাইড করেছে। এখন আর পাওনাদাররা এসে বিরক্ত করে না। তাহলে কুন্তলের অসহায়তাটা ঠিক কোনখানে? ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য সে নিজেকে দোষী ভাবছে। নিজেকে এত দোষী ভাবার মধ্যে আসলে কি কোনও রোম্যান্টিসিজম লুকিয়ে? রোজ নতুন-নতুন ধোপদুরস্ত টি-শার্ট, জিনসের প্যান্ট। অথচ সে নাকি অবসাদে ভুগছে, মরতে চাইছে!
আরও পড়ুন: Film Review: গল্পের গরু গাছে, দর্শক কাঁদিয়েই দায়িত্ব সারল ‘লক্ষ্মী ছেলে’
সুদর্শন গোটা ছবিতে 'আমার বোনটাকে বাঁচাতে চাই' বলে বিকট বাড়াবাড়ি করে গেল! অথচ, তার যদি বোনকে সুস্থ করে তোলার এতই ইচ্ছা থাকে, তাহলে সে কোনও কাজ করে না কেন ঠিকঠাক? বোঝা যায়, সুদর্শন অসৎ। এই অসৎ মানসিকতার উৎস কোথায়? বোনকে সুস্থ করতেই কি সে টাকা মেরেছিল? নাকি এটা তার স্বভাব? মানে অসততা নিয়েও এক প্রকাণ্ড সিউডো-রোম্যান্টিসিজমে আক্রান্ত বঙ্গদেশের ফিল্ম-করিয়েরা। সুদর্শন চরিত্রটির না সৎ উপার্জনের কোনও সদিচ্ছা আছে, না সে একটাও উচিত কাজ করেছে নিজের বোনকে সুস্থ করার জন্য। হার্টের অপারেশনের জন্য সে প্রাইভেট ডাক্তার দেখাতে পারছে প্রত্যেক মাসে, অথচ সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারছে না? যেখানে সে জানে, নিজের বোন প্রায় মৃত্যুমুখী? সে ইনশিওরেন্স এজেন্ট, এর আগে তার মানে অনেককে পলিসি করিয়ে দিয়েছে। তাহলে সে কি কমিশন পায় না প্রত্যেক মাসে? তার উচ্যবাচ্যটুকু নেই ছবিজুড়ে! আর সেও তো ছবির শুরুতে গিয়েছিল মরতে, তার মরার চিন্তাটা জন্মাচ্ছে কোথা থেকে? মানুষ কি এমনি-এমনি আত্মহত্যা করে? তার ওপর এরকম চতুর একটা লোক? সেই শেষ সীমায় কি সে পৌঁছতে পেরেছিল, যার দরুণ নিজের প্রিয় বোনকে ফেলে সে চলে গিয়েছিল রেলে কাটা পড়তে? কোনও সদুত্তর নেই।
'কাছের মানুষ' ছবিটিতে রুক্ষ্ম বাস্তব দেখাতে গিয়ে দৃশ্যায়নে বেশ কিছু ফাঁকি রয়ে গেছে, যা এরকম 'বাস্তবোচিত' ছবিতে থাকার কথা ছিল না। এবং এই ফাঁকিগুলোর কারণেই চরিত্রগুলোর মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন জাগে, দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এত কথা বলার দরকার ছিল না, যদি এটি সাধারণ মূলধারার ছবি হতো। অথচ ছবির গায়ে 'ইন্টেলেকচুয়াল' বেশভূষা চাপানো হলে, তারপর সেটাকে মূলত নাগরিক দর্শকের কাছে বিক্রি করতে চাইলে প্রাথমিক তথ্য পরিবেশনের ক্ষেত্রে আরও নিপুণ হওয়া দরকার। বাস্তবোচিত ছবি বানাচ্ছি, অথচ বাস্তবের ছিটেফোঁটাটুকু নেই, অথচ দর্শকদের কাছে উপস্থাপন করছি বাস্তবের খোলস পরিয়ে― এ তো প্রবঞ্চনা! তারকাখচিত ছবি বানিয়ে দর্শকদের হলে টেনে আনতেই পারে কোনও ছবি, কিন্তু সিনেমা মাধ্যমের প্রতি কি কোনও দায় নেই তার?
ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'কর্ণসুবর্ণের গুপ্তধন' ও পথিকৃৎ বসুর 'কাছের মানুষ' একই দিনে মুক্তি পেয়েছে। গুপ্তধন ফ্র্যাঞ্চাইজির এই ছবি কিন্তু কিন্তু আগের দুটো ছবির মতোই অনুরূপ কাঠামো মেনে চলেছে, নিরাপদে খেলতে চাইছে, কোনও নতুনত্ব নেই, অথচ ছবিটা দর্শকদের কাছে সৎ থাকতে পারছে। ফাঁকিবাজি নেই। তার অনেকগুলো কারণ আছে। গল্পের জাল বোনা হচ্ছে যতটুকু যুক্তি লাগানো যায়, তা লাগিয়ে। গুপ্তধন উদ্ধার বা সংকেতের মীমাংসা- সব হচ্ছে দর্শকদের সাসপেন্সকে জোরদার করার মাধ্যমেই, দর্শকদের ঠকিয়ে নয়। ফিকশনের মধ্যে ইতিহাস ঢোকাতে গেলে যেটুকু যা স্বাধীনতা লাগে, নেওয়া হচ্ছে। খুব লঘু হয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আবেদনটুকুতে ভেজাল মেশানো নেই। কিন্তু শৈল্পিক ছবি করব বলেই যেখানে পরিকল্পনা, সেখানে ফাঁকিবাজি সহজেই দৃশ্যমান হয়। যুক্তিবুদ্ধিকে মাঠের বাইরে পাঠাতে হলে, পাঠাব! দর্শক বোকা, আজীবন বোকা হয়ে এসেছে, প্রশ্ন করবে না কোনও দিন- এই মানসিকতা নিয়ে কি ছবি তৈরি হতে পারে?
'কাছের মানুষ' ছবির আত্মহত্যাপ্রবণ, প্রায় গরিব চরিত্রগুলি যখনতখন ট্যাক্সিতে উঠে পড়ে। ছবির শেষে একটা ক্যামিও আছে, সেই চরিত্রটি এক বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, সে কেন আছে, কী করছে, কে অভিনয় করেছে, সেসব এখন বলছি না, জাস্ট বলতে চাইছি যে, এই মাপের এক ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের কাছে কি অঢেল সময় আছে ছবির শেষে জ্ঞান বিতরণ করার? এই ছবির মূল দুর্বলতাটা ঠিক এখানেই যে, ছবিটা যতটা বাস্তবকে ছুঁয়ে থেকে শুরু হয়েছিল, ছবি যত এগিয়েছে, ততই আরও অবাস্তবের দিকে মোড় নিয়েছে।
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় অভিজ্ঞ অভিনেতা হলেও এই ছবিতে তাঁর অতি-অভিনয় চোখে লেগেছে। আগে যেভাবে, যে ঢঙে বাণিজ্যিক ছবিগুলো করতেন, সেখানে যেভাবে উচ্চকিতভাবে কথা বলতেন, এখানেও সেভাবেই অভিনয় করেছেন, যা ভীষণভাবে একঘেয়ে ও বিরক্তিকর লেগেছে। প্রসেনজিৎ বা তথাকথিত আগেকার বাণিজ্যিক শিল্পীদের মধ্যে একটা ব্যাপার আছে, ভালো পরিচালকের হাতে পড়লে এঁরা চাপা সংযত অভিনয়টা বের করেন। আর এর বাইরে যেখানে লাউড হতে বলা হয়, সেখানেই পুরনো অতীত বেরিয়ে আসে।
দেবের তো এই ছবিতে অভিনয় করা উচিতই ছিল না। কুন্তল চরিত্রটি কোনও অ্যাভারেজ দেখতে, অনায়কোচিত কাউকে দিয়ে করানো দরকার ছিল। দেবের পেশিবহুল, চকচকে চেহারা এই ছবিতে একেবারেই যায়নি। তাঁর অভিনয়ও খুব একটা মনে রাখার মতো নয়।
ইশা সাহা ছাড়া আমাদের এখানে আর কোনও পারদর্শী অভিনেত্রী নেই, এটা বাঙালি দর্শকরা এতদিনে হাড়ে-হাড়ে বুঝে গেছেন। কিন্তু তাঁর অভিনয়ে চোখে পড়ে সেই একই অভিব্যক্তি, সিনেমা-ভেদে চরিত্রগুলোকে আলাদা করা যায় না সেভাবে।
ইদানীং আমাদের সিনেম্যাটোগ্রাফিকে মাস্টারক্লাস বানানোর সহজ টোটকা হলো ব্যাকগ্রাউন্ডকে ব্লার করে দাও, মানে ব্যাকগ্রাউন্ডকে আউট অফ ফোকাস করে দাও। ব্যস, কেল্লা ফতে! সবাই সিনেম্যাটোগ্রাফি দেখে ছিটকে গিয়ে বলবে, উহ্ কী দেখিলাম! জন্মেও ভুলিব না। এঁরা কি আদৌ শ্যালো ফোকাসের উচিত ব্যবহার সম্পর্কে অবগত? কোথায় কী ব্যবহার করতে হয়, কেন করতে হয়, সেসব নিয়ে কি ধারণা আছে আদৌ?
তবে এই ছবিতে গানগুলো ভালো। বিশেষ করে 'মুক্তি দাও' ও 'টাকা লাগে' গানদু'টি। ছবির সম্পাদনা বেজায় সাধারণ ও অনেকাংশে দুর্বল।
বাংলা সিনেমার মূল সমস্যা হচ্ছে, আমাদের সুশীল ফিল্মকরিয়েরা গরিব, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত- এই তিনটে শ্রেণি থেকে অনেক অনেক দূরে অবস্থান করেন। এঁরা না তো জানেন স্ট্রাগলের মানে, আর না জানেন কীভাবে এই তিন শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছেলে-মেয়েরা জীবনে টিকে থাকার জন্য লড়াই করে। আসলে অধিকাংশ ফিল্ম-করিয়েদের জীবন পশ কফি শপ, রেস্টুরেন্ট, ফরেন ট্যুর, রিচ সোশ্যালাইটের মধ্যে আটকে। তাই এঁরা যখন সোশ্যাল স্ট্রাকচারের নিচুতলার মানুষজনদের জীবনকে নিজেদের সাবজেক্ট করেন, তখন স্বভাবতই সেখানে ফাঁকি চলে আসে।
ছবি: কাছের মানুষ
পরিচালক: পথিকৃৎ বসু
অভিনয়: প্রসেনজিৎ, দেব, ইশা সাহা