Film Review: গল্পের গরু গাছে, দর্শক কাঁদিয়েই দায়িত্ব সারল 'লক্ষ্মী ছেলে'
কেমন হলো কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের 'লক্ষ্মী ছেলে'?
এত উচ্চশিক্ষিত, বাস্তববোধসম্পন্ন, দূরদর্শী সব মানুষজন, তারা জগতের যাবতীয় বিষয় নিয়ে কথা বলছে, আলোচনা করছে অথচ, চিকিৎসার কল্যাণে সুস্থ হয়ে যাওয়া বাচ্চাটিকে নিয়ে আবার হিজলগঞ্জের গ্রামে ফেরত যাওয়ার পর কেমন ধরনের দুর্দশা হতে পারে, কীরকম ভয়ানক পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে, তা এদের মধ্যে কেউ আগে থেকে আন্দাজ করতে পারল না? কেউ না? চরম বিপদের মুহূর্তে আমরা তো সবথেকে খারাপটা আগে ভেবে নিয়ে সেই অনুযায়ী কদম বাড়িয়ে থাকি! সবাই এত হইহল্লা করছে, মানবতার ক্লাস দিচ্ছে দর্শকদের, অথচ প্রয়োজনীয় দুশ্চিন্তাটুকু করছে না, যে দুশ্চিন্তা এক পলকে মনে চলে আসার কথা! কী কাঁচা মানের প্লট হোলে ভরা 'লক্ষ্মী ছেলে' ছবিটি― যাঁরা নিরপেক্ষভাবে দেখবেন― তাঁরা অনায়াসেই বুঝতে পারবেন।
এখানেই আসে ভালো ছবি-খারাপ ছবির দ্বৈরথ। কৌশিক গাঙ্গুলীর 'লক্ষ্মী ছেলে' ছবিটিকে ভালো মানের ছবি বলতে সংকোচ হচ্ছে। ছবির বক্তব্যকে সম্মান জানিয়েও বলা যায়, ফিল্ম তথা সিনেমা বানানোর নামে মোটা দাগের ইমোশন-সর্বস্ব ছবি 'লক্ষ্মী ছেলে', যেখানে ছবির সামগ্রিক কাঠামো থেকে শুরু করে চিত্রনাট্য পর্যন্ত অনেক কিছুতেই গলদ লুকিয়ে। এবং এটাই আশ্চর্যের― বাঙালি হুজুগে মাতে, এই ছবির ক্ষেত্রেও মাতছে― তা একদিক থেকে ভালো― কিন্তু ছবিটায় এই উচ্চ মানের ভুলত্রুটিগুলো নিয়ে কেউ কিছু বলছে না বা লিখছে না। খুব ফিনফিনে একটা চোখে-দেখা-যায়-না এমন পর্দা আমাদের সাংস্কৃতিক মননে চেপে বসেছে হালফিলে। মুশকিল এখানেই যে, এই পর্দাকে সবাই বড় ভালবাসে। সেই কারণে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় ('লক্ষ্মী ছেলে') বা অপর্ণা সেনের ('দ্য রেপিস্ট') মতো এককালের ভালো-ভালো কাজ করা ফিল্মকরিয়েরা এখনও এমন দুর্বল ছবি বানিয়েও সর্বসেরা চলচ্চিত্রর তকমা একপ্রকার জবরদখল করতে পারছেন।
সত্যজিৎ রায়ের শেষ জীবনে বানানো ছবি 'গণশত্রু'-তেও এত দুর্বলতা ছিল না, যা কৌশিকের 'লক্ষ্মী ছেলে'-তে আছে। তার থেকেও যেটা বেশি করে আছে, তা হল চরিত্রগুলোর ওপরে অথর তথা ন্যারেটরের একছত্র প্রভাব। চরিত্রগুলো নিজেরা নিজেদের কথা বলছে না। ওদের কনসার্নগুলো ওদের নিজস্ব কনসার্ন নয়। যিনি কথক, যিনি ছবিটি প্রেজেন্ট করছেন― এখানে কৌশিক― তিনিই যেন নিজের কথা বলিয়ে দিচ্ছেন চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে। নয়তো আমির হোসেন একবার হলেও সার্বিকভাবে ধর্মীয় উন্মাদনার কথা ভাবত বা আনমনে হলেও বলত। হিন্দু ধর্ম নিয়ে একদল মানুষের ব্যবসা, কুসংস্কারের ভূতকে তা দেওয়া, এসবের বিরোধিতার পাশাপাশি আমিরের নিজস্ব চেতনা কোথায়? যতই ছবির শেষে 'মানবতার জয় হোক' জাতীয় লেখা স্ক্রিনে ফুটিয়ে তোলা হোক না কেন। আমি একটা ছবি বানাচ্ছি, সোশ্যাল-পলিটিক্যাল সমস্ত বিষয় নিয়ে কমেন্টারি করতে চাইছি, সেখানে আমার বক্তব্য এত নড়বড়ে কেন হবে? 'লক্ষ্মী ছেলে' ছবিটা তো আমির হোসেনের জয়জয়কার করার ছবি। কিন্তু আমির জয়জয়কার তখনই পেত, যদি সে ন্যারেটরের কথা না বলে নিজের কথা বলত। যতই সে নতুন প্রজন্মের ছেলে হোক, যতই সে শিক্ষিত হোক, তার মধ্যে তো একটা শঙ্কাবোধও আছে এই নতুন ভারতে, যেখানে রোজ সংখ্যালঘু নির্যাতনের আখ্যান রচনা হয়। সেই দ্বিধাটা, আতঙ্কটা, উৎকণ্ঠাটা কোথায়? আমির চরিত্রটি তাই যতটা না নিজের ছন্দে চলেছে, তার থেকেও বেশি যেন কৌশিক তাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।
ছবিতে বাকি ছেলেমেয়েদু'টির যেন কোনো ভূমিকাই নেই। তাদের স্ট্যান্ড কোথায়? তাদের বক্তব্য কোথায়? কোথায় তাদের ভাবনা, এক-দু'বার ভয়েস ওভারে আমিরের ব্যাপারে কথা বলা ছাড়া? কোনও শেডই নেই। নতুন প্রজন্মের উচ্ছ্বাসপ্রবণ ছেলেমেয়ে বলে এত একরঙা কেন হতে হবে তাদের? এখানেও, ন্যারেটরের ইচ্ছেটাই প্রধান হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় কি এমন চড়া দাগের মেলোড্রামা দিয়েই ইদানীং বাজিমাত করতে চাইছেন? 'নগরকীর্তন' ছবিতেও তাই, এখানেও তাই। মোদ্দা কথা হলো, দর্শকদের ছবির শেষে কাঁদাতে হবে। এতে করে গল্পে যুক্তিকে জলাঞ্জলি দিতে হলেও ক্ষতি নেই। তর্কের তো জায়গাই নেই, কেননা বাঙালি এখনও কান্নায় এক্সপার্ট, ইমোশনে তা দিলে তাদের আর কিচ্ছু লাগে না।
চরিত্রের অগ্রগতি 'লক্ষ্মী ছেলে'-তে একেবারেই নেই। সবকিছু এক জায়গায় থমকে আছে। আর সবকিছু একমাত্রিক। এই একঘেয়েমি কাটাতে চেয়েছেন বিভিন্ন জনের ভয়েসওভার ও বিভিন্ন টাইমলাইন ইন্টারকাট করে, কিন্তু তাতে চিড়ে খুব একটা ভেজেনি। টাইমলাইন ওলটপালট করে দেখানোর একটা নিজস্ব আর্ট আছে, তার নিজস্ব সুর-তাল-ছন্দ আছে। 'লক্ষ্মী ছেলে'-তে এই ওলটপালট নতুন কিছু যোগ করেনি, বরং অহেতুক লেগেছে। 'নগরকীর্তন-এও এমন চেষ্টা করেছিলেন প্রথম অর্ধে। ওখানে তাও যথাযথ ছিল, এই ছবিতে তা কষ্ট-প্রচেষ্টা বলেই মনে হলো।
সব পাশে সরিয়ে রাখতে চাইলেও ছবির শেষার্ধটা পাশে সরানো যায় না। এত আরোপিত ক্লাইম্যাক্স কেন? অথর যা চাচ্ছেন, তাই হচ্ছে ন্যারেটিভে। বাবুল সুপ্রিয়র চরিত্রটি, যিনি আবার মন্ত্রী, তিনি মাসখানেক ধরে গ্রামের পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনও ইন্টারনাল ইনভেস্টিগেশন করালেন না? তিনি জাস্ট বললেন, হ্যাঁ তোরা যা। বাচ্চাটাকে দিয়ে আয়। আমি বলে দিচ্ছি লোকাল থানায়। ওরা লোক পাঠিয়ে দেবে। মন্ত্রীরা এত ইনোসেন্ট হয়? এত সাদা মনের হয়? তার তো আরও সব দিক তলিয়ে দেখা উচিত ছিল। কী থেকে কী হয়, তার তো ভালোমতো জানা। এক মুসলিম ছেলে একপ্রকার চুরি করেই (যদি গ্রামের ওদের বক্তব্যকে ধরি) বাচ্চাটিকে নিয়ে এসেছিল, যে বাচ্চা ওই গ্রামের জমিদারের ছেলের নাম-প্রচারে সাহায্য করছিল, সেই বাচ্চাকে তাদের নাকের ডগা দিয়ে নিয়ে এল। এবার বাচ্চাকে সুস্থ করে আমির যাবে সেই গ্রামে, বাচ্চাকে ফেরত দিতে। সামান্য মূর্খ লোকও তো আন্দাজ করতে পারবে, কী কী ঘটতে পারে। সেখানে এত বিদ্বান লোকজন তা আগে থেকে ধরতে পারল না? চরিত্রগুলোয় কোনও নিজস্বতা নেই। এখানেও সেই একই ব্যাপার, ন্যারেটর চাইছেন দর্শকের চোখের জল, তাই তিনি যেন-তেন প্রকারেণ ন্যারেটিভকে সেই দিকেই এগিয়ে নিয়ে যাবেন। এটাকে বলে চৌর্যবৃত্তি। ন্যারেটর দর্শকদের ইমোশন চুরি করছেন। স্পষ্ট করে বলছেন না যে, আমার তোমাদের ইমোশন চাই। যেহেতু স্পষ্ট করে বলছেন না, তাই এত প্লট হোলের আশ্রয়। আরে ভদ্রলোক কি পারেন না যত্ন নিয়ে চিত্রনাট্য সাজাতে? প্রমাণ তো করে দিয়েছেন 'অপুর পাঁচালী'-তে, 'শব্দ'-তে, 'ছোটোদের ছবি'-তে, 'সিনেমাওয়ালা'-তে। কিন্তু ওঁর এখন দর্শকদের নয়নবারি চাই।
এককালের প্রোথিতযশা পরিচালকদের এই দুর্দশা দেখে মন খারাপ হয়। সম্প্রতি অপর্ণা সেনের 'দ্য রেপিস্ট' দেখেও একই অনুভূতি হলো। বক্তব্যই স্পষ্ট নয়। কী বলতে চাইছেন, কেন বলতে চাইছেন, সব গুলিয়ে ফেলেছেন। আর কত ফাঁকি! সিউডো-লিবারেলদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েও কোনও এক অজানা কারণে তারা ছবির শেষে শ্রেষ্ঠ মানুষে পরিণত হয়ে যাচ্ছে, কোনও অন্তর্দ্বন্দ্বের সম্মুখীন না হয়েই। আরও কত অজস্র ফাঁকি!
কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় 'লক্ষ্মী ছেলে'-তে যা বলতে চেয়েছেন, তার জন্য তিনি কুর্নিশ প্রাপ্য। কিন্তু যেভাবে বলতে চেয়েছেন, তাতে ফাঁকি থেকে গেছে। সত্যজিতের প্রথম দিকের 'দেবী' ও শেষের দিকের 'গণশত্রু' পাশাপাশি রেখে বিচার করলেও দেখা যাবে যে, 'দেবী'-তে সত্যজিৎ অনেক বেশি নিউট্রাল। অনেক বেশি বাস্তবে দাঁড়িয়ে। সেই ছবিতে কারও পক্ষ নেননি তিনি। সবাইকে ক্রিটিসাইজ করেছেন। এমনকী, শিক্ষিত ছেলে উমাপ্রসাদের মধ্যেও যে অন্য স্তরের সংস্কার লুকিয়ে আছে, তাও তিনি দেখিয়েছিলেন। কিন্তু 'গণশত্রু'-তে এসে ছবিতে বক্তব্য অনেক সহজ হয়ে যায়। ছবি শেষও হয় অনেক অনায়াসে। সেখানে সত্যজিৎ যেন বেশি ঝুঁকি নিতে রাজি নন। কেমন একটা বাধো-বাধো ভাব। তবে সেখানে হয়তো বয়সজনিত কারণেই ফাঁকি এসে গিয়েছিল। কিন্তু কৌশিকের এখনও সময় আছে। অনেক বেশি সাহসী, সৎ, নিষ্ঠাবান হওয়া উচিত ছিল 'লক্ষ্মী ছেলে'-তে। তবেই ছবিটা আরও বেশি মনে রাখার মতো ছবি হতে পারত। তার বদলে ছবিটা শুরু থেকে শেষ অবধি আরোপিত হয়ে রইল।