সব ধর্মেই লালসার শিকার নারী! রঞ্জন ঘোষের 'মহিষাসুরমর্দ্দিনী' যে সত্যি তুলে ধরে
Film Review: কেমন হলো রঞ্জন ঘোষের 'মহিষাসুরমর্দ্দিনী' (২০২২)?
রাবণের কবল থেকে রাম তাঁর স্ত্রী সীতাকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিলেন, একথা তো আমরা সকলেই জানি। তবে তা কি কেবলই রামের পত্নীপ্রেমের কারণে, না কি পৌরুষের অহংবোধকে চরিতার্থ করার জন্য করা হয়েছিল? নয়তো কেন সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে? রামও কেন চাইবেন, সীতা তাঁর 'সতীত্ব' প্রমাণ করে দেখাক? কখনও ভেবে দেখেছেন কি, দ্রৌপদীর পাঁচ স্বামী থাকার কারণে ভরা সভায় তাঁর বস্ত্রহরণ করে মান-সম্মান সব ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হলো, অথচ কৃষ্ণ সারাজীবন অগুনতি নারীর সঙ্গ করে এসেছেন, বাড়িতে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও কাননবনে গিয়ে অন্যের সঙ্গে মধুচন্দ্রিমায় মেতেছেন, অথচ কেউ কখনও কৃষ্ণকে প্রশ্ন পর্যন্ত করেনি, তাঁর দিকে আঙুল পর্যন্ত ওঠায়নি। বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে বিনয়-বাদল-দীনেশের নাম সবার মুখে মুখে, অথচ সমান ভূমিকায় থাকা বিপ্লবী বীণা দাসের খোঁজ কেউ রাখে না। আমরা কুমারী পুজো করি, আবার এই আমরাই রাতের অন্ধকারে কুমারী-ধর্ষণে মাতি, পেট্রল ঢেলে জ্বালিয়ে দিই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বর্তমানে কেবলই এক লবজবিশেষ, অথচ তার কত স্তর, কত কদর্যতা! এই ব্যবস্থা গড়ে তোলায় পুরুষের পাশাপাশি নারীরও সমান ভূমিকা থাকে। ইতিহাসের কত যে সাবটেক্সট ঢাকা পড়ে যায় মেনস্ট্রিম কথনের প্রাবল্যে!
রঞ্জন ঘোষ তাঁর 'মহিষাসুরমর্দ্দিনী' (২০২২) ছবিতে এমন সব জটিল বিষয়কে কেন্দ্রে রেখে গ্রামবাংলার এক প্রাচীন বাড়ির দরদালানে পঞ্চমীর রাতে কয়েকটিমাত্র চরিত্রকে ঢাল বানিয়ে এক অন্যরকম কেস স্টাডিতে মেতেছেন।
আরও পড়ুন: বাবরি ধ্বংসের প্রেক্ষাপটে অমর বন্ধুত্বের গল্প! কেন দেখতে হবে ‘দোস্তজী’
ছবি শুরু হচ্ছে নাম না-জানা এক বছরদশেকের মেয়েকে দিয়ে। সে পালাচ্ছে দুই হিন্দু ডোমের লালসা থেকে বাঁচতে। পালাতে পালাতে গোরস্থানে চলে আসে, সেখানে দুই মুসলিম কবর-খনকের মুখোমুখি হয়। মেয়েটির দুই দিকে দুই ধর্মের প্রতিনিধি নিজস্ব ঘৃণ্য মানসিকতা নিয়ে দাঁড়িয়ে, মাঝে একটি মেয়ে সংকটবহুল মুখে দর্শকদের দিকে চেয়ে। মেয়েটির ভবিতব্য আপাতত অজানা রেখে রঞ্জনবাবু আমাদেরকে এক প্রাচীন বাড়িতে নিয়ে আসেন। ষষ্ঠীর আগের রাত। সেই বাড়ি একজন মহিলা নভোশ্চরের (ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত), দিনকয়েক বাদে সে রাশিয়ায় ট্রেনিং নিতে যাবে, সামনে অগাধ এক সুন্দর ভবিষ্যৎ তার অপেক্ষায়। তার বাড়িতে চারটি নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়ে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকছে কয়েকমাস যাবৎ। এই চার ছেলেমেয়ে ও তাদের 'ম্যাম'-কে প্রেক্ষিতে রেখে সেই সন্ধেতে অনেক ঘটনা ঘটে, যাতে ধরা থাকে আদি থেকে অনন্ত অবধি বয়ে চলা যাবতীয় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-অপরাধ-কষ্ট-হতাশা ও অপ্রাপ্তির কালচে পরশ।
ছবিটার আদল চিরাচরিত থিয়েটারের ফরম্যাটে গড়া। যেভাবে আমরা বিভিন্ন অঙ্ক ও দৃশ্যে বিভক্ত থিয়েটার প্রত্যক্ষ করি, এই ছবিটিও সেইভাবেই অঙ্ক হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে, যে কারণে থিয়েটারের স্বাদ শেষ অবধি পাওয়া যায়। যে ক্যানভাসটাকে ছবিটা ধরতে চেয়েছে, তার জন্য এই আঙ্গিকের একান্ত দরকার ছিল। আবার এই কারণেই ছবিটা আর পাঁচটা ছবির থেকে একেবারে ভিন্ন অবস্থানে পৌঁছে যেতে পেরেছে। এরকম টেমপ্লেট আগে কোনও ছবিতে ব্যবহার করা হয়নি। একদম নতুন এক টেমপ্লেট, যাতে হয়তো ভবিষ্যতেও কাজ হবে না। চলচ্চিত্রে থিয়েটারের কৌশলের এমন অপূর্ব আত্তীকরণ, যেখানে মূল উদ্দেশ্য সম্পূর্ণরূপে সাধিত হচ্ছে― জুড়ি মেলা ভার।
গোটা ছবির চারটি ভাগ যেন চারটি যুগের প্রতিনিধিত্ব করে। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি। ছবির শুরুর দিকটা তাই খুব শান্ত, ছিমছাম। ছবি যত এগোয়, তত উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে। অবশেষে ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে অস্থির হয়ে যায় আর অপ্রত্যাশিত এক চমকে দর্শক চমকে ওঠে ও ভাবতে শুরু করে।
রঞ্জনবাবুর স্ক্রিনপ্লে ছবিটিকে যে উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পেরেছে, সেখানে আরও কয়েকজনের ইন্ধন আছে, সেসবের উল্লেখ না করলেই নয়। শুভদীপ দে অদ্ভুত সুন্দর ক্যামেরার কাজ করেছেন, অন্ধকারে মোমের আলোয় ওরকম ছোট একটুখানি পরিসরে যে 'প্রিসিশন'-এর দরকার ছিল, তিনি সেটা দিতে পেরেছেন বলেই বিভিন্ন ফ্রেমের দ্যোতনা দর্শকদের নাড়িয়ে দিতে পারে ক্ষেত্রবিশেষে। এডিটর অমিত পালের কাজ খুব মসৃণ ও পরিণত। কালারিস্ট পিভি মণিকুমারের মেলবন্ধনে ছবির পরিসর নিটোল হতে পেরেছে। অসীম অধিকারী দারুণভাবে আর্ট ডিপার্টমেন্ট সামলেছেন। রঞ্জন, শুভদীপ ও অমিতের প্রোডাকশন ডিজাইন যেমন বাহুল্যবর্জিত, তেমনই ছবির পরিধি অনুযায়ী মেদহীন। অভীক চট্টোপাধ্যায়ের সাউন্ড ডিজাইনের প্রশংসা না করে থাকা যায় না, কেন না ছবিটা যেহেতু অধিকাংশ সময়ে কেবলই ওই দরদালানে আবদ্ধ থাকে, তাই শব্দ এখানে অনেক বড় ভূমিকা রাখে। কত সূক্ষ্মতা ধরা পড়েছে তাঁর কাজে! সামান্য টিকটিকির টিকটিক আওয়াজও যে এই ছবিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা প্রত্যক্ষ করে চমকে যেতে হয়। সেই সঙ্গেই বলতে হয় অভিজিৎ কুন্ডু ও তার টিমের মিউজিকের কথা। ক্লাইম্যাক্সের একটি বিশেষ অংশে বিজিএম অন্য এক মাত্রা যোগ করে।
তবে এই ছবির মূল সম্পদ চরিত্রাভিনেতারা। প্রথমেই ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর কথা বলি। 'মহিষাসুরমর্দ্দিনী'-তে রঞ্জন ঘোষ সুনিপুণভাবে তাঁকে ব্যবহার করেছেন। খুব কম কথা বলা একজন মহিলা, যে নিজেও নিজের সংকীর্ণতা নিয়ে দ্বিধান্বিত। পরিণত অভিব্যক্তিই এখানে তাঁর একমাত্র হাতিয়ার এবং বলাই যায়, তিনি অত্যন্ত যত্ন নিয়ে কাজটা করেছেন। এর আগেও রঞ্জনের 'আহা রে' ছবিতে ঋতুপর্ণা একদম অন্যরকম এক চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তবে 'মহিষাসুরমর্দ্দিনী'-তে যাকে দেখে প্রায় ছিটকে গেছি, তিনি হলেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। কী ভয়াবহ অভিনয়-প্রতিভা ভদ্রলোকের! ক্লাইম্যাক্সের একটু আগে একটি বিশেষ দৃশ্যে সিঙ্গেল শটে স্মৃতিরোমন্থন ও ক্রমশ বদলাতে থাকা অভিব্যক্তি দেখে চমক জাগতে বাধ্য। পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় বেশ ভালো, বিশেষত দীর্ঘ ডায়লগ চমৎকারভাবে বলতে পারেন, যা দর্শকের ভাবনার সঙ্গে সংগতি বজায় রাখে। পৌলমী দাসের চরিত্রটির পরিসর সামান্য সময়ের জন্য হলেও তিনি অসম্ভব ভালো অভিনয় করেছেন। কৌশিক করেরও স্ক্রিনটাইম কম, তবে যেটুকু সময় ছিলেন, দুর্দান্ত কাজ করেছেন। কষ্টটা ফুটে বেরিয়েছে যথাযথভাবে। এই ছবিতে তরুণ প্রজন্মের প্রায়-অভিজ্ঞতাহীন চারটি ছেলেমেয়ের কাজ দেখেও বেশ ভালো লাগল। আরিয়ন ঘোষ, অভ্যুদয় দে, অরুণিমা হালদার ও শ্রীতমা দে খুব মন দিয়ে কাজ করেছেন, কোথাও তাদের অভিনয় উচ্চকিত লাগেনি। এদের মধ্যে শ্রীতমা ও আরিয়নের কাজ ব্যক্তিগতভাবে দুর্দান্ত লেগেছে।
রঞ্জন ঘোষ এর আগে 'হৃদমাঝারে' (২০১৪), 'রংবেরঙের কড়ি' (২০১৭) ও 'আহা রে' (২০১৯) বানিয়েছেন। চতুর্থ ছবি 'মহিষাসুরমর্দ্দিনী' এখনও অবধি তাঁর শ্রেষ্ঠ ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ, একথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে। বাংলা ছবিতে এই মানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা খুব একটা হয় না, গতানুগতিক টেমপ্লেটের বাইরে বেরিয়ে অন্যভাবে ভাবতে কেউ খুব একটা চান না। এখানকার প্রোডিউসররাও সাহস দেখাতে ভয় পান, এই কারণেই এই ছবির প্রোডিউসর পবন কানোরিয়াকে এমন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে অত্যন্ত ধন্যবাদ জানাই। পবনবাবুর উৎসাহেই রঞ্জনবাবু এরকম সাহসী সিনেটেক্সট গড়তে পেরেছেন। এর আগেও সুমন মুখোপাধ্যায়ের 'কাঙাল মালসাট' (২০১৩), 'অসমাপ্ত' (২০১৭) ও 'নজরবন্ধ' (২০২০), বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর 'টোপ' (২০১৬), সুদীপ্ত রায়ের 'কিয়া অ্যান্ড কসমস' (২০১৮), অরিজিৎ বিশ্বাসের 'সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে' (২০১৯) ও সায়ন্তন মুখার্জির 'ঝরা পালক' (২০২২)-এর মতো ছবি তাঁরই কল্যাণে তৈরি হতে পেরেছে। বর্তমানে বাংলা ফিল্ম বাজারে এরকম নিঃস্বার্থ প্রযোজক পাওয়া সত্যিই অবাক করার মতো ব্যাপার।
ব্যাপারটা হলো, 'মহিষাসুরমর্দ্দিনী'-তে মাইথোলজির এত লেয়ার যোগ করা হয়েছে যে, যাঁরা বুঝতে পারবেন, তাঁদের খুবই ভালো লাগবে এই ছবি। তবে যাঁরা বুঝতে পারবেন না, তাঁদের কাছে এই ছবি বেশ সমস্যাজনক বলে মনে হতে পারে। ছবিটাকে বুঝতে এন্ড ক্রেডিটের পুরোটা মন দিয়ে দেখবেন ও শুনবেন। সব উত্তর ওখানে দেওয়া আছে।
অবশেষে এটাই বলার, ছবিটা ভাবায় অনেক। ভয় ধরায়। উৎকণ্ঠিত করে তোলে। সিনেমাটা হলে গিয়ে দেখার জন্যই বানানো, ক্যানভাসটা কেবলই বড় পর্দায় ধরা পড়বে ঠিকভাবে। সমাজে নারীর অবস্থান, পুরুষের ভূমিকা, যুগের পর যুগ ধরে হয়ে চলা বঞ্চনা, শোষণ, ব্যক্তিগত রাজনীতি, আপন দ্বিধা, সংশয় ও আগামী দিনের এক ঝলক আশাকে নিরপেক্ষভাবে ধরার এক অভিনব প্রচেষ্টা। 'মহিষাসুরমর্দ্দিনী' ছবিটা আমাদের গতে বাঁধা পুরাণ, লোককথা, ইতিহাস, মহাকাব্য, ধর্ম ও সামাজিক ইতিহাসের অন্য এক সাবঅল্টার্ন টেক্সট, যা নিরপেক্ষভাবে বলাটা খুব প্রয়োজন ছিল। রঞ্জন ঘোষ পেরেছেন।