সিনেমাপাগল শৈশবের আশ্চর্য গল্প! অস্কারের দৌড়ে শামিল এই ভারতীয় ছবি কেন দেখবেন

Film Review: ভারত থেকে অস্কারে গেছে 'দ‍্য লাস্ট ফিল্ম শো', কেমন হল এই ছবি?

নয়ের দশকের শুরুর দিক। কেবল লাইন তখনও ঘরে ঘরে ঢুকে পড়েনি। রবিবারের বিকালে বাড়ির বড়রা যখন চেয়ার-টেয়ার টেনে টিভির সামনে এঁটে বসতেন রবিবার বিকেলের বাংলা ছায়াছবি দেখবেন বলে, আমাদের মনটা কেমন হু হু করে উঠত। আমরা জানতাম, অনতিবিলম্বে টিভির পর্দায় যে সাদাকালো ম্যাজিক শুরু হবে, যেখান থেকে কখনও ভেসে আসবে 'এই পথ যদি না শেষ হয়', কখনও 'অন দ্য মেরি গোল্ড রাউন্ড' বা 'তুমি যে আমার' (অন্য সিনেমা যা-ই চলুক, বাঙালির রবিবারের বিকেল তখনও মূলত উত্তম-সুচিত্রার সাম্রাজ্য), সেই জাদুমঞ্চে আমাদের প্রবেশাধিকার নেই। মনের একটা ছোট্ট অংশ জোর করে টেনে আনতে হত হোমওয়ার্কের পাতায়, বাকিটা পড়ে থাকত ওই টিভি-র ঘরে, কখন বাথরুম যাওয়া বা মা-কে ডাকার অজুহাতে দরজার আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে কয়েক মুহূর্ত দেখে নেব 'বড়দের সিনেমা'। আমাদের বরাদ্দ ছিল কলকাতা দূরদর্শনের ছোটদের অনুষ্ঠান 'ছুটি ছুটি'। গরমের ছুটি, পুজোর ছুটিতে ফি-বছর দেখেও পুরোনো হত না সোনার কেল্লা, জয় বাবা ফেলুনাথ, গুগাবাবা। কিন্তু নিষিদ্ধ ছিল বলেই বোধহয় রবিবারের বাংলা ছবির টান ছিল অন্যরকম। রাতের বিছানায় আধোঘুমেও লেগে থাকত দূর থেকে ছুঁতে চাওয়া চলমান দৃশ্যমালা-শব্দ-সংগীতের সম্মোহনের রেশ, হাতে লেগে থাকা দুপুরের মাংসের ঝোলের সুগন্ধের মতো।

প্যান নলিনের ছবি 'দ্য লাস্ট ফিল্ম শো'-র (ছবিটি ২০২৩-এর অস্কার মঞ্চে ভারতের অফিসিয়াল এন্ট্রি) মুখ্য চরিত্র ন'বছরের সময় যখন আধা-শহরের লজঝড়ে সিনেমা হলে সিনেমা দেখে একেবারে মজে গেল সিনেমায়, মনে পড়ছিল আমাদের শৈশব-কৈশোরের সিনেমা-মুগ্ধতার কথা। গুজরাতের কোনও গ্রামীণ রেলস্টেশন চালালা-য় সময়ের বাবার চায়ের দোকান। সময়ের মতো গুটিকতক ছেলের স্টেশনই ঘরবাড়ি, ট্রেন থামলে ওরা দৌড়ে যায় চা-ওয়েফার এটা সেটা নিয়ে। বাবা-মা-র সঙ্গে ট্রেনে চেপে কয়েক স্টেশন পেরিয়ে 'গ্যালাক্সি' হলে সিনেমা দেখল সময়, তারপর সিনেমা আর ছাড়ল না তাকে। স্কুল টপকে রোজ হাজিরা দিতে লাগল গ্যালাক্সিতে। আর পাঁচটা মফসসলি হলের মতোই গ্যালাক্সির সর্বাঙ্গে অযত্ন, মালিন্যের ছাপ। ওই ছোপ ধরা দেওয়াল, খসে পড়া প্লাস্টার, ভাঙা কাঠের চেয়ারই চুম্বকের মতো টানে সময়কে। ঘটনাচক্রে ভাব জমে যায় সিনেমা হলের প্রোজেকশনিস্ট ফজলের সঙ্গে। সময়ের মা রোজ নিপুণ হাতে রকমারি সবজি রেঁধে গুছিয়ে দেয় ছেলের টিফিন বাক্সে, সঙ্গে গুঁজে দেয় একটু আচার, পেঁয়াজশাক। সেই সুস্বাদু রুটি-সবজি খেয়ে পেট ভরায় ফজল, আর হলের প্রোজেকশন রুমে বসে বিনা টিকিটে একের পর এক সিনেমা দেখে সময়।

এখানে অনিবার্যভাবে মনে পড়বে জুসেপ্পে তোর্নাতোরের বহুচর্চিত ছবি 'সিনেমা প্যারাডিসো'-র (১৯৮৮) কথা, সিনেমা-পাগল বাচ্চা ছেলে সালভাতোরে আর হলের প্রোজেকশনিস্ট অ্যালফ্রেডোর বন্ধুত্বের গল্প। সে ছবিতে এই বন্ধুত্বের বৃত্তে ঢুকে পড়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতালি, বিধ্বস্ত সময়। অ্যালফ্রেডো মানুষটি সামান্য প্রোজেকশনিস্ট হলেও তার মনন, অন্তর্দৃষ্টি কিছুদূর পর্যন্ত হয়ে উঠেছিল সালভাতোরের 'ফ্রেন্ড-ফিলোজফার-গাইড'। সিনেমা-প্যাশন আঁকড়ে ধরে সালভাতোরে-কে পরিচালক হওয়ার পথে অনেকখানি ঠেলে দিয়েছিল অ্যালফ্রেডো-ই। লাস্ট ফিল্ম শো-র ফজল তুলনায় বিশেষত্বহীন, নিষ্প্রভ, নেহাতই ছাপোষা সাধারণ মানুষ। বরং এই অসমবয়সি বন্ধুত্বে উজ্জ্বলতর হয়ে থাকে সময়, তার চোখ, অভিব্যক্তি। সময়ের নেতৃত্বে গোটাসাতেক ছেলে উঠেপড়ে লাগে সিনেমা বানাবে বলে।

আরও পড়ুন: নারী-পুরুষের অবদমিত কামনার না-দেখা ছবি! পাকিস্তানের ‘জয়ল‍্যান্ড’ যে কারণে দেখতেই হবে

বিশ্বাসী লোকেরা বলেন, তুমি মন থেকে কিছু চাইলে পাবেই। তা শুধু একাগ্র চাওয়াই নয়, অদম্য জেদ, বুদ্ধি আর পরিশ্রম দিয়ে ওরা এগোয় অনেক দূর। আলোকে বন্দি করা চাই, কীভাবে আলো বন্দি হবে? ট্রেনের কামরায় জানালা বন্ধ করে একটা ফাঁক দিয়ে আসা আলো কাপড়ে ফেলে বাইরের গাছপালা-পাহাড়-জঙ্গলের চলমান ছায়া দেখার কায়দা বের করে ফেলে স্কুল পালানো ছেলের দল। এবার সত্যিকারের সিনেমা চাই। স্টেশনের পার্সেল রুম থেকে সিনেমার রিল চুরি করে ফিল্ম জোগাড় হলো, সে চুরি ধরাও পড়ল একদিন। সময় একা জেল খাটল বন্ধুদের বাঁচিয়ে। সেখানেও ছেলের ধ্যানজ্ঞানজুড়ে রইল শুধু সিনেমা। আরও অনেক জোগাড়যন্ত্র করে এক পোড়ো বাড়ির ঘরে প্রায় সত্যিকারের সিনেমা হলের মতো পর্দায় ফিল্ম চালিয়ে দেখাল সময় আর তার দলবল।

ওদের সিনেমা-প্যাশনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাইরের পৃথিবীটাও বদলে যাচ্ছিল দ্রুত। চালালা-য় ব্রডগেজ লাইন বসানোর নোটিশ এল। বাবুরা বলে দিলেন, চায়ের স্টল তুলে দিতে হবে সময়ের বাবাকে, এই ছোট্ট স্টেশনে আর ট্রেন থামবে না। 'গ্যালাক্সি'-র দেওয়ালে নতুন রংয়ের প্রলেপ পড়ল, এল কম্পিউটারচালিত প্রজেক্টর, ইংরেজি না-জানা ফজলের কাজ গেল। সময়ের চেষ্টায় স্টেশনে একটা কাজ জোটাতে পারল সে। ফিল্ম চুরির জন্য যে সিনেমাপাগল ছেলেগুলো শাস্তি পেয়েছিল, তাদের চোখের সামনে দিয়ে হলের লোহালক্কড় মেশিনে গলিয়েপিটিয়ে তৈরি হলো বাটি-চামচ আর বস্তা বস্তা ফিল্ম এর রিল গলিয়ে নানা রংয়ের চুড়ি তৈরি হলো কারখানায়। সময়ের জলভরা চোখ যেন অতন্দ্র সাক্ষীর মতো সময়ের মোড় ঘুরে যেতে দেখল, দেখল কীভাবে একান্ত প্রিয় জিনিসগুলো 'নেই' হয়ে যায়, আটকানো যায় না, ধরে রাখা যায় না।

এই স্বপ্নভঙ্গকে ঘিরেই ছবির গল্প অন্যরকম হতে পারত। 'সিনেমা প্যারাডিসো'-র আখ্যানকে অতিক্রম করে তৈরি হতে পারত সমকালীন সময়-সমাজ-অর্থনীতির সঙ্গে ভারতের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বসে ফিল্ম বানানোর স্বপ্ন দেখা ছেলের আন্তঃসংলাপ। সিনেমাশিল্পের সঙ্গে অতি-সাধারণ প্রান্তিক জীবনের এই নিবিড় সম্পর্ক আমরা পেয়েছি কিয়েরোস্তামির মাইলস্টোন ছবি 'ক্লোজ আপ'-এ (১৯৯০)। সিনেমা সেখানে এক নিতান্ত সাধারণ মানুষের বাঁচার অবলম্বন হয়ে ওঠে, নিজেকে সিনেমা পরিচালক পরিচয় দিয়ে এক হেরে যাওয়া মানুষ সেখানে ঘুরে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু এই গভীরতায় ঢুকলেন না 'দ‍্য লাস্ট ফিল্ম শো'-র পরিচালক। শহর-গ্রামে ক্যামেরা-মোবাইল এবং ইন্টারনেট ঢুকে পড়ছে তখন, গ্রামীণ জীবনের খোলনলচে পাল্টাচ্ছে। এই বদলটা তেমন ধরা হলো না ছবিতে। ব্রডগেজ লাইন, সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমার অবলুপ্তি, সেলুলয়েডের বিদায়- এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ জিনিসকে চিত্রনাট্য ছুঁয়ে গেল, কিন্তু চরিত্র বা সংলাপগুলো এই ঘটনাপ্রবাহ থেকে রয়ে গেল কিছুটা বিচ্ছিন্ন। শেষটায় সময়ের আপাতকঠোর বাবা জমানো টাকা দিয়ে ওইটুকু ছেলেকে বদোদরায় পড়তে পাঠালেন, প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে মা-বাবা বন্ধু স্কুলের স্যার এর হাত নাড়লেন- সাধারণ দর্শকের চোখে খানিকটা চাপিয়ে দেওয়া 'হ্যাপি এন্ডিং' বলেই মনে হয়। ছবি শুরু হয়েছিল ল্যুমিয়ে ব্রাদার্স সহ সিনেদুনিয়ার পথপ্রদর্শকদের উৎসর্গ করে, শেষের অভিনব শটেও ট্রেনযাত্রী মহিলাদের হাতের রকমারি চুড়ি দেখে সময়ের মনে এল গলানো ফিল্মের কথা। কোনওটা মনমোহন দেশাই তো কোনওটা অমিতাভ বচ্চন-শ্রীদেবী-শাহরুখ খান। স্ক্রিন ফেড আউট করে এই তালিকায় ঢুকে পড়লেন সত্যজিৎ রায়, আন্তোনিওনি, গোদার, তারকোভস্কি প্রমুখ দিকপালরা।

পরিচালক বলেছেন, এ ছবি তাঁর নিজের শৈশবকে মনে করে তৈরি করা। শেষ পর্যন্ত 'দ্য লাস্ট ফিল্ম শো' পরিচালকের এই নিজস্ব মুগ্ধতা আর নস্টালজিয়াকেই বেশি করে তুলে ধরে, কিছুটা গৌণ থেকে যায় সময়ের, সময়-দের লড়াই।

More Articles