রক্তধোয়া দিন, মনে পড়লে শিউরে উঠি আজও
Bangladesh Quota Protest: ১৭ জুলাইয়ের ঘটনা পড়ুয়া-বিক্ষোভকারী, সকলের মনে গভীর একটি দাগ ফেলেছিল। স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের ভিতর ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠেছিল। ১৮ তারিখ শাট ডাউনে তারই প্রতিক্রিয়া দেখতে পেয়েছে দেশ।
গত ৫ জুন। কোটা পদ্ধতি বহাল রাখার পক্ষে রায় দিল হাইকোর্ট। আর তার পর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে পড়ুয়াদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ, উত্তেজনা দেখা দিতে লাগল। ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা শাহবাগে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখায়, যা কার্যত পরিণত হল এক সংগঠিত প্রতিবাদে। পরবর্তীকালে সেই বিক্ষোভ-প্রতিবাদে যোগ দিতে লাগল অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ। ততক্ষণ পর্যন্ত অবশ্য কেউ কল্পনাও করেনি যে আমরা, পড়ুয়ারা রক্তস্নাত হয়ে সারা দেশে আগুন জ্বালিয়ে দেব।
১৩ জুলাই পর্যন্ত বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণই ছিল। সরকার যে কোনও সময়ই যে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, আমাদের রুখতে চলতে পারে দমন-পীড়ন, এমন আশঙ্কা ছিল। তবে সত্যি কথা বলতে রাজধানীতে পুলিশি বর্বরতার কোনও ঘটনা তখনও শোনা যায়নি। ১৩ তারিখই শাহবাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের বিরোধিতায় বিক্ষোভ দেখায় 'মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ'। তার পরেও কোনও পক্ষের আন্দোলনই হিংসার জায়গায় পৌঁছয়নি। ২০১৮ সালেই যখন হাইকোর্ট কোটা প্রথার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তখন প্রকাশ্যেই কোটা বহাল রাখার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় বাংলাদেশ জুড়ে শুরু হয়েছিল কোটাবিক্ষোভের প্রথম ঢেউ। এমনকী দেশ জুড়ে বাংলা অবরোধের রব ওঠে। তবে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ হাসিনার দাবির বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ জারি করলে আন্দোলনের ঢেউ স্তিমিত হয়ে আসে। বাংলা অবরোধের ডাকও প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। যদিও সরকারের উপর যে পুরোপুরি ভরসা ছিল পড়ুয়াদের, তা নয়। তার পরেও বিক্ষোভ থেকে সরে আসার পথই বেছে নিয়েছিলেন তাঁরা।
আরও পড়ুন: অগণিত মৃত্যু, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস! শাসক-বিরোধী সংঘর্ষে কতটা ক্ষয়ক্ষতি বাংলাদেশে?
তবে এবার আর এত সহজে ঝড় থামল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার 'রাজাকার' মন্তব্যের পরে ১৪ জুলাই পড়ুয়াদের বিক্ষোভ আরও তীব্র রূপ ধারণ করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর স্থানীয় 'মিলিশিয়া' হিসেবে কাজ করেছিল যারা, সেই দেশদ্রোহী এবং যুদ্ধাপরাধীদের ঘৃণ্য দল 'রাজাকার' বলে পড়ুয়াদের অভিহিত করেন প্রধানমন্ত্রী। মুহূর্তের মধ্যেই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের তৈরি করা বাধা ভেদ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তায় ও ক্যাম্পাসে জোয়ার নামে ছাত্রদের। স্লোগান ওঠে— “আমি কে? তুমি কে? রাজাকার, রাজাকার। কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার ! স্বৈরাচার" — সেই সব স্লোগানের রব কাঁপিয়ে দেয় চারপাশের হাওয়া। কোটা সংস্কারের দাবির পাশাপাশি এবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ারও দাবি জানান শিক্ষার্থীরা।
বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা কোনওদিনই সামাজিক ন্যায়ের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়নি। বরং আদতে তা ছিল সরকারকে দুর্নীতি এবং ভোটের কাজে সহায়তা করার জন্যই। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ সংরক্ষণ বরাদ্দ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য। ২৬ শতাংশ ছিল সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে। অর্থাৎ ৫৬% আসনই সংরক্ষিত বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে। বাকি ৪৪ শতাংশ আসনে কামড়াকামড়ি করতে হত বাংলাদেশের মেধাবীদের। যার বিরুদ্ধেই এই প্রতিবাদ। শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদ করেছে। ২০১৮ সালে এই একই ইস্যুতে যখন প্রতিবাদ শুরু হয় দেশ জুড়ে, সে সময় সরকার সিভিল সার্ভিস নিয়োগে সমস্ত কোটা তুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল।
১৫ জুলাই বিক্ষোভ আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। প্রধানমন্ত্রীর অবিবেচক মন্তব্য যেন সেই ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলেছিল। তা সত্ত্বেও পড়ুয়ারা শান্তিপূর্ণ ভাবেই প্রতিবাদের চেষ্টায় ছিল। আওয়ামী সরকারের মদতপুষ্ট ছাত্রলীগ (বাংলাদেশ ছাত্র লীগ) পড়ুয়াদের বিক্ষোভকে স্তব্ধ করতে উঠেপড়ে লাগে। রাজু ভাস্কর্যের কাছে পড়ুয়াদের বিক্ষোভে বাধা দেওয়ার চেষ্টা হয়। এর আগেও একাধিক বার শান্তিপূর্ণ অবস্থান বিক্ষোভে অশান্তি তৈরি করার চেষ্টা করেছে তারা। তবে এই প্রথমবার তারা বেছে নিয়েছিল ভয়াবহ হিংসার পথ। নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের উপরে ধাতব রড, ব্লেড, লাঠির মতো অস্ত্র নিয়ে চড়াও হয় তারা। শুধু তাই নয়, ভাড়াটে গুন্ডাদের পর্যন্ত নিয়ে আসা হয় তার জন্য। এই পরিস্থিতিতে বিক্ষোভকারীদের সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে এবং শেষমেশ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এই গোটা সময়টা পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। না, পুরোপুরি নীরব নয়। কারণ বিক্ষোভকারী পড়ুয়াদের উপরে নির্মম মারধর করে ছাত্রলীগকে মদত দিয়েছে প্রশাসন। সেদিনে সেই বিভীষিকাময় বিকেল লাল হয়েছিল ছাত্রদের রক্তে। ছেলেমেয়ে, শিশু-নাবালক কোনও বাদবিচার না করেই বেধড়ক মারধর করা হয়। পড়ুয়ারা নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টায় ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড, শহীদুল্লাহ হল, একুশে হল, কার্জন হল, সলিমুল্লাহ হল ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কোনও মতে আশ্রয় নেয়। তবে সেখানেও বাঁচেনি প্রাণ। হাসপাতাল থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি জায়গাতেই হামলা চালায় ছাত্রলীগ। শেষপর্যন্ত আত্মরক্ষার স্বার্থে ইট-পাটকেল নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাধ্য হয় পড়ুয়ারাও। আর সেই প্রতিরোধের মুখে ছাত্রলীগ বিস্ফোরক ও ছোট অস্ত্র ব্যবহার শুরু করে। এমনকী পুলিশও ছাত্রলীগকে এ কাজে সাহায্য করে। সম্ভবত দেশের প্রশাসনের নির্দেশ ছিল তেমনটাই। তবে হার মানেননি পড়ুয়ারা। সমস্ত বাধা, সমস্ত প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে, নিজের অবস্থানে অটল ছিলেন আন্দোলনকারীরা। আর গোটা রাত জুড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে চলতে থাকে এক ভয়াবহ তাণ্ডব।
১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছে, তার পরে সারাদেশ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামে বাংলাদেশের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। আওয়ামী সরকারও তার সহযোগী সংস্থার কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানায়। ১৬ জুলাই স্থবির হয়ে যায় দেশ। বিক্ষোভকারীরা অবশ্য পথে নামে ফের। তবে তাঁরা এখন প্রস্তুত। হেলমেটের পাশাপাশি যে যার মতো লাঠি ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম নিয়ে রাস্তায় নামে তারা। শহর যেন যুদ্ধক্ষেত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা শহিদ মিনারে বিক্ষোভ দেখান, যেখানে একদিন আগেই ঘটে গিয়েছে ভয়াবহ নৃশংসতা। কিন্তু দেশের বাদবাকি অংশের জন্য কিন্তু তা প্রযোজ্য ছিল না। এরই মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় পুলিশের বর্বরতা ও ছাত্রলীগের হামলায় নিহত ও আহত হওয়ার খবর আসতে থাকে মুহুর্মুহু। ১৬ জুলাই বিক্ষোভ শেষ হওয়ার পর পুলিশের হাতে ৬ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়। রংপুরের ছাত্র আবু সঈদকে অন্যায় ভাবে দু-দু'বার গুলি করে পুলিশ। সেই মৃত্যু কার্যত কাঁপিয়ে দিয়েছিল দেশকে।
১৬ জুলাই রাত থেকে ১৭ জুলাই ভোর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে হিংসা চলতে থাকে। ছেড়ে কথা বলেনি পড়ুয়ারাও। তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ছাত্রলীগের নৃশংসতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাকে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭টি হল থেকে ছাত্রলীগের সদস্যদের বের করে দেয়। আর এই বিপর্যয়ের পরেই সরকার সারাদেশের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। পড়ুয়ারা অবশ্য সেই ঘোষণা মানতে অস্বীকার করে। হল খোলা রাখার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাংলোর সামনে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করে আন্দোলনকারীরা। আর তার জবাবে উপাচার্য কী করেন? সুরক্ষা সংক্রান্ত ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবকে ফোন করেন। যদিও তা-ও টলাতে পারেনি পড়ুয়াদের মনোবল। ক্যাম্পাসে ব্যাপক পুলিশ মোতায়েন সত্ত্বেও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ চালিয়ে যায় তারা। ১৬ জুলাই নিহতদের মৃত্যুর প্রতিবাদে শোকমিছিল বেরোয়। বিকেল চারটের দিকে মিছিলটি রাজু ভাস্কর্যের দিকে অগ্রসর হতে না হতেই হঠাৎই সাউন্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণ, কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেটের শব্দ কানে আসে। পড়ুয়াদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে লাঠিচার্জ শুরু করে পুলিশ। ছত্রভঙ্গ হয় ছাত্রদের মিছিল, এবং অনেকেই আহত হন।
সেই ভয়ঙ্কর দিনের কথা মনে করে বিকেল ৩টের দিকে ক্যাম্পাসে পৌঁছই এবং ছাত্রলীগমুক্ত নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে পোস্টারিংয়ে যোগ দিই বন্ধুদের সঙ্গে। সে সময় কানে আসে, সরকারি মদতপুষ্ট গুন্ডাদল যুবলীগ শাহবাগ দখল করছে এবং ক্যাম্পাসের সমস্ত প্রবেশপথ অবরুদ্ধ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হঠাৎই রাজু ভাস্কর্যের কাছ থেকে সাতটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই। বুঝতে পারি ততক্ষণে আমাদের সকলের মোবাইল ডেটা জ্যাম। এমনকী মোবাইল নেটওয়ার্কও পাওয়াও কঠিন। ফলে আর কোথায় কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। একটা অস্বস্তিবোধ আমাদের গ্রাস করছিল। কেমন যেন মনে হচ্ছিল আজ কিছু একটা হবে। আমরা তবু শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পথেই ছিলাম। তবে যুবলীগের হামলার ভয়েই আত্মরক্ষার স্বার্থে লাঠিসোঁটা বের করতে বাধ্য হই। কিন্তু কোনও ভাবেই পুলিশ বা প্রশাসনের প্রতি কোনও প্রকার বিদ্বেষ ভাব দেখানোর কোনও উদ্দেশ্য আমাদের ছিল না। মিছিল শুরু হওয়ার পর রাস্তা তৈরি করে দিয়েছিল পুলিশই। আপাতদৃষ্টিতে ততক্ষণ সবকিছু শান্তিপূর্ণই ছিল। কিন্তু সেই চোরা অস্বস্তিকে আতঙ্কে পরিণত হতে দেরি হল না। হঠাৎ করেই পুলিশ কোনও রকম উস্কানি ছাড়াই সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে শুরু করে। মিছিলের সময় আমি কয়েক জন সিনিয়র দাদাদিদিদের সঙ্গ ছিলাম। মিছিলের একেবারে সামনের প্রান্তে শোনা যায় প্রথম গ্রেনেড ফাটার শব্দ। অন্যটি ফাটে মিছিলের শেষে। আমি ছিলাম মিছিলের একেবারে শেষের দিকে। আমার থেকে হাত খানেক দূরে পাঁচটি গ্রেনেড ফাটতে দেখি। আতঙ্কে সবাই যে যার মতো পালাতে শুরু করে। তার সঙ্গে ছিল কাঁদানে গ্যাস। সেই কাঁদানে গ্যাসের থেকে বাঁচতে আগুন জ্বালায় অনেকে। ভিড় ছত্রভঙ্গ হওয়ার পরেও পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে থাকে এবং গ্রেনেড বিস্ফোরণ জারি থাকে। সেদিন আমি সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ওইখানেই ছিলাম এবং কম করে হলেও তিরিশটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই। পুলিশি বর্বরতা শেষ হয় অনেক পরে। তার পরে আমরা পালানোর সাহস পাই। সেদিন আমি শুধু পুলিশি বর্বরতার ভয়াবহতাই দেখিনি, দেখেছি কীভাবে শত শত পড়ুয়া ভয়ে-আতঙ্কে হল ও ক্যাম্পাস ছেড়ে পালাচ্ছে। তাদের অনেকেই নিজের জিনিসপত্রটুকুও সঙ্গে নিতে পারেনি। তবে সেই হতাশা এবং অসহায়বোধ বুঝে ওঠার আগেই পুলিশ বিক্ষোভকারীদের উপর ফের মারধর শুরু করে। ছাত্ররা তাদের অবস্থানে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই ধেয়ে আসে কাঁদানে গ্যাস। সঙ্গে ছিল বন্দুক এবং গ্রেনেডের ভয়। পুলিশ নিশ্চিত করে যাতে কোনও ভাবেই কোনও প্রতিরোধ গড়ে না উঠতে পারে। গোটা দেশ জুড়েই ছবিটা ছিল একই। যার প্রতিবাদে আন্দোলনকারীরা ১৮ই জুলাই থেকে সারা দেশে শাটডাউনের ডাক দেয়।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের কোটা ব্যবস্থা ঠিক কী? কেন এর বিরোধিতায় প্রাণ হারালেন পড়ুয়ারা?
১৭ জুলাইয়ের ঘটনা পড়ুয়া-বিক্ষোভকারী, সকলের মনে গভীর একটি দাগ ফেলেছিল। স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের ভিতর ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠেছিল। ১৮ তারিখ শাট ডাউনে তারই প্রতিক্রিয়া দেখতে পেয়েছে দেশ। সেদিনও পড়ুয়ারা তাদের ক্যাম্পাসের সামনে শান্তিপূর্ণভাবেই বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল। কিন্তু পুলিশ ফের তাঁদের উপরে হামলা চালায়। আওয়ামী সরকারের মদতপুষ্ট ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও ভাড়াটেরা তো ছিলই। ফলে গোটা দেশটাই যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হল। দুপুর নাগাদ ব্যাপক হতাহতের খবর আসতে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া ও সংবাদ মাধ্যমে। আমি নিজে ঢাকার একাধিক জায়গায় মারপিট হতে দেখেছি। সেসব জায়গার পরিস্থিতি কার্যত ছিল ভয়াবহ। সাধারণ মানুষ বিক্ষোভরত ছাত্রদের জন্য খাদ্য, জল এগিয়ে দিয়েছে, জুগিয়েছিল আশ্রয়, কিন্তু সরকার অটল ছিল তাদের বিক্ষোভদমনে। ক্রমে বাংলাদেশের লড়াই ছড়িয়ে যেতে লাগল সারা বিশ্ব জুড়ে। এই পরিস্থিতিতে রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ দেশের ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয় সরকার। কিন্তু উৎপীড়ন থামে না। বন্দুকের গুলি, বিস্ফোরণ এবং বাতাসে যন্ত্রণার চিৎকার সারা রাত বাংলাদেশের বাতাস মথিত করে রাখে। স্বজন-বান্ধব, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না মানুষ, কেউ কারওর খবর পাচ্ছে না। হাসপাতাল এবং থানায় মরিয়া হয়ে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে খুঁজছে পরিবার। ১৮ জুলাইয়ের সেই পরিস্থিতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।
১৯ তারিখ জুম্মার নমাজের পর সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক দলগুলো রাজপথে নেমে আসে। তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যায়। গুলি চলে তাঁদের উপরেও। চলে মারধর। আর তার পরেই কার্ফু জারি করা হয় দেশ জুড়ে। মোতায়েন করা হয় সেনা। এরই মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে কোটা মামলার শুনানি ২১ জুলাই হবে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে দেড়শো জনেরও বেশি মানুষের প্রাণ চলে গিয়েছে। এখনও অনেকে নিখোঁজ এবং আহত। সরকার আংশিকভাবে কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজি হলেও, শত শত মৃত্যুর ঘটনা বাংলাদেশের মানুষকে ক্ষেপিয়ে দিয়েছে। প্রায় ১৪০ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ ছিল। এত কিছু সত্ত্বেও মানুষের রায় বদলায়নি এবং নাগরিক ও সরকারের মধ্যে সংঘর্ষও অব্যাহত ছিল। একাধিক সূত্র থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী, মৃতের সংখ্যা দু'শোরও বেশি। এবং আহত অন্তত ২৫ হাজার। ততদিনে বিক্ষোভ বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভারত, আমেরিকা, ব্রিটেন, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, কাতার, সৌদি আরব, হাঙ্গেরির মতো দেশে। সেখানেও বাংলাদেশ সরকারের নৃশংসতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানো শুরু হয়। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বিশেষ করে আসিফ মাহমুদ এবং নাহিদ ইসলামকে অপহরণ ও নির্যাতন করা হয়েছে। অনলাইনে খুঁজলেই সেই রিপোর্ট পাওয়া যাবে। এই খবর জনগণের ক্ষোভে আরও ঘি ঢালে। নিহতদের বিচারের দাবিতে ফেটে পড়েন পড়ুয়ারা। তাঁদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে চলবে বলেই জানিয়েছেন তাঁরা। কোটা সংস্কারের দাবি মিটলেও এখনও অশান্ত বাংলাদেশ। কার্যত তার ভবিষ্যৎ এর চেয়েও বেশি অনিশ্চিত।