ব্রিটিশ শাসিত কলকাতাতেই প্রথম বইমেলা! পুরোভাগে ছিলেন রবি ঠাকুর, নীলরতন সরকাররা
ভালবাসা - মন্দবাসার শহর কল্লোলিনী তিলোত্তমা। দিনশেষে রাতের নিয়ন আলো গায়ে মেখে প্রতিদিন হাজারো ইতিহাসের সাক্ষী থাকে এই শহর কলকাতা।এখানে ফুটপাত বদল হয় মধ্যরাত্রে।উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম চেনা অজানা মানুষের জটলায় বারংবার নিজেকে খুঁজে ফেরে ' সিটি অফ জয়।' বর্তমান পরিস্থিতিতে অতিমারীর মধ্যে আবারো নতুন এক ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কলকাতাবাসী। আবারও কলকাতা শহরের বুকে শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলা। নতুন বইয়ের আনকোরা গন্ধ নিতেই পাঠকরা ছুটে যাবেন বইমেলা চত্বরে।
কলকাতা। প্রানের শহর কলকাতা। দিনরাত তুমুল ব্যস্ততা গা সওয়া হয়ে যাওয়া ট্রাফিকের জঞ্জাল স্লোগানমুখর মিছিল গঙ্গার ঘাট অথবা ভিক্টোরিয়া কিংবা ময়দানের বুকে নেমে আসা স্মৃতির অলস বিকেলকে সঙ্গী করে বয়স বাড়ে তিলোত্তমার। শীতের তীব্রতা কমে বাতাসে যেন উষ্ণতার আনাগোনা। শীতের নকশা কাটতে কাটতে এতদিন কলকাতার বুকে আগমন হত বইমেলার। এবার অবশ্য বইমেলা আসার আগেই একপ্রকার প্রাণ দিয়েছে শীত। তাতে অবশ্য উৎসাহে ভাটা পড়েনি বাঙালির। ভয় অবশ্য একটা ছিল - কর্নার প্রকোপ আবার বাতিল হবে না তো বই উৎসব? না শেষ পর্যন্ত তা অবশ্য হয়নি। সমস্ত আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে শুরু হয়েছে কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলা।
বইমেলার হাত ধরে যুক্তিবাদী মন হয়ে ওঠে আরো চিন্তাশীল। নতুন বা পুরাতন বইয়ের তত্ত্বতালাশ নিয়ে নতুন আঙ্গিকে হাজির হয় কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলা। অবশ্য শুধুমাত্র বাঙালি বললে ভুল বলা হবে- কলকাতা বইমেলার গল্প তো এখন ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। কলকাতার পুস্তকমেলা এখন আন্তর্জাতিক। ফলে বইমেলার কয়েকটা দিন মেলা চত্বর যেন হয়ে ওঠে সব দেশের সব ধর্মের মিলনক্ষেত্র, ভিড় জমে আট থেকে আশি সমস্ত বইপ্রেমী মানুষদের।
এই গল্পটার শুরু ১৯৬৭ সালে। স্বাধীনতা তখনও যুবক, তখন তার বয়স ত্রিশের কোঠায়। ভারতবাসী দিন গুনছে নতুন ভোরের অপেক্ষায়। স্বাধীনতার স্বপ্নকে পুঁজি করে শুরু হয়েছে নতুন ভারত গঠনের কাজ। যে স্বাধীনতার জন্য বলি প্রদত্ত দেশের লক্ষ লক্ষ তরুণ, যুবক বৃদ্ধ অথবা বৃদ্ধা, সেই স্বাধীনতা এসেছে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার মধ্য দিয়ে। ঘটে গেছে দেশভাগের মত প্রচণ্ড এক অঘটন। সত্যিই কি তাই? নাকি দেশভাগের প্রেক্ষাপট প্রস্তুত ছিল বহু আগে থেকেই? নিজভূমে পরবাসী হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। কাঁটাতার পরোয়া করেনি জন্মভূমির প্রতি মানুষের আবেগের, বিশ্বাস করতে চাইনি জন্মভূমির জন্য বহু রক্তদানের কথাকে। দুই দেশের মানুষের অভিধানের যুক্ত হয়েছে 'জিরো লাইন' 'নোম্যান্স ল্যান্ড'- এর মত বেশ কিছু শব্দ। সীমান্তে বেড়েই চলেছে ভারি বুটের আনাগোনা, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মানুষের আতঙ্ক আর ভয়। বিপদের আশংকা যেন উর্দিধারীদের দিক থেকে আসার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এক ইংরেজ যিনি কোনদিন সেই অর্থে ভারতেই আসেননি, বোঝার চেষ্টাই করেননি ভারতবাসীর চেতনা বা মননের অনুররণকে, তিনিই অবতীর্ণ হলেন ভারতীয়দের ভাগ্যনিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়। সীমান্তবর্তী মানুষেরা কষ্ট পাবেন এ যেন বিধির-বিধান। আর বিধির বিধান যখন তখন তাকে খণ্ডাবে কে? সুতরাং রাডক্লিফ লাইন প্রাচীর তুলে দিলো ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে। দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল একসময়ের হরিহর আত্মা, পরিণত হলো দুই চিরশত্রু দেশে।
দেশভাগের স্মৃতি, তার যন্ত্রণা,মানুষের ছিন্নমূল উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়ার ব্যথা যখন সমগ্র দেশবাসীর মনে টাটকা তখনই পথচলা শুরু করল কলকাতা বইমেলা। ১৯৭৬ সালের ৫-১৪ মার্চ প্রথম আয়োজন করা হলো কলকাতা পুস্তকমেলার। দেশভাগের ক্ষতে প্রলেপ লাগিয়ে সে যেন নতুন করে বাঁচার সময়। বই যে মানুষকে ভাবতে শেখায়, প্রশ্ন করতে শেখায়। ১৯৭৬ সালে যে ছিল শিশু, ছোট্ট ছোট্ট পায়ে সে এখন পৌঁছেছে ছেচল্লিশের দোরগোড়ায়। যে কলকাতা একসময় সাক্ষী ছিল ছেচল্লিশের দাঙ্গার, উত্তর কলকাতার যে গলিগুলো নীরবে দেখে গেছে বহু রক্তপাত, ভাইয়ে ভাইয়ে বিভেদকে- সেই কলকাতা যেন পা রাখলো এক যুগসন্ধিক্ষণে। প্রথম কলকাতা বইমেলার উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাজ্যপাল এ. এল. ডায়াস। বর্তমানে মোহরকুঞ্জ নামে পরিচিত কলকাতার যে জায়গাটি সেখানেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম বইমেলা। যদিও বাধা বিঘ্ন ছিল অনেক, তৎকালীন সময়ের বই প্রকাশক এমনকি অনেক লেখক লেখিকাও এই মেলার সাফল্য সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেন।
সব জল্পনা কল্পনায় একপ্রকার জল ঢেলে বিপুল জনসমাগমের সঙ্গে সাফল্যমন্ডিত হয় কলকাতার বুকে অনুষ্ঠিত প্রথম বইমেলা। অবশ্য এ কথা অস্বীকার করতো উপায় নেই যে সেই সময় আজকের মত বৃহদায়তনের বই মেলা অনুষ্ঠানের কথা ভুলেও ভাবেননি কেউ। ছোট্ট আঙ্গিকে অনুষ্ঠিত হলেও প্রথম বছরেই দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছিল কলকাতা পুস্তকমেলা। এরপর আট বছর পর নতুন একটি পালক যোগ হল কলকাতা পুস্তকমেলার মুকুটে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করল কলকাতা বইমেলা, ১৯৮৪ সালে।২০০৯ সাল নাগাদ নাম পরিবর্তিত হল কলকাতা পুস্তকমেলার - সম্পূর্ণ নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করল সে। নতুন নাম হল - আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলা।
এ পর্যন্ত গল্পটা প্রায় সবারই জানা। কিন্তু সত্যিই কি ১৯৭৬ সালে শুরু হয়েছিল প্রথম বইমেলা? বিতর্কের অবকাশ থেকেই যায়।
সময়টা স্বদেশী যুগের আশেপাশে। সমগ্র ভারতবর্ষে ফুটছে এক নতুন উত্তেজনায়। বিদেশি দ্রব্য বর্জন করে স্বদেশী দ্রব্য গ্রহণ - এই হয়ে উঠেছে সমগ্র ভারতবর্ষের মূলমন্ত্র। রাস্তাঘাটে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বিদেশি পোশাক, অন্যান্য সামগ্রী। সময়টা উত্তাল। স্বদেশী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ভিত নড়ে গেছে ইংরেজ সাম্রাজ্যের। পথে নেমেছেন হাজার হাজার বিপ্লবী। ইংরেজদের অত্যাচারের গ্রাফ তখন ঊর্ধ্বমুখী, স্বদেশী আন্দোলনকে দমাতে অত্যাচার যেন একমাত্র অস্ত্র ব্রিটিশদের। কলকাতাও জড়িয়ে পড়েছিল এই আন্দোলনে। স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়? কলকাতার যুবক সমাজও পথে নেমেছিল স্বদেশী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। দিকে দিকে জ্বলে উঠেছিল বিক্ষোভ প্রতিবাদের আগুন।
১৯০৬ সাল নাগাদ প্রতিষ্ঠা হলো জাতীয় শিক্ষা পরিষদ। ১৯১৮ সালে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের হাত ধরে কলেজ স্ট্রিটের বুকে ঘটে গেল এক অভাবনীয় ঘটনা। কলেজ স্ট্রিট তো বইয়ের আঁতুড়ঘর। আর ঠিক সেখানেই অনুষ্ঠিত হলো কলকাতার প্রথম পুস্তকমেলা। অবশ্য একে ঠিক মেলা বলা যায় কিনা সে নিয়ে অনেকের মতভেদ আছে, মেলার থেকে প্রদর্শনী বলাই ভালো। হ্যাঁ, জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ১৯১৮ সালের এপ্রিল মাসে আয়োজন করল শিল্প প্রদর্শনী এবং একই সাথে পুস্তক প্রদর্শনীর। প্রদর্শনীতে যোগ দিয়েছিলেন বহু নামীদামি প্রকাশক। নীলরতন সরকার, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখের মত ব্যক্তিত্বরা জড়িয়ে ছিলেন কলেজ স্ট্রিটের এই পুস্তক প্রদর্শনীর সঙ্গে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নাকি সাফল্য কামনা করে আশীর্বাদ করেছিলেন প্রদর্শনীর কর্মকর্তাদের।
অর্থাৎ এ কথা বলা চলে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষেই প্রথম পথ চলা শুরু করে বইমেলা। অবশ্য তাতে ব্রিটিশদের অবদান কতটুকু তা জানা যায় না, কিন্তু ভারতীয়রা ছিলেন পুরোভাগে এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই। আজকের বইপ্রেমী কলকাতা কি মনে রেখেছে কলকাতার বুকে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রথম এই বইমেলাকে? যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন স্বয়ং বিশ্বকবি থেকে বিপিনচন্দ্র পালের মতো ব্যক্তিত্ব।