বঙ্গভঙ্গ বিরোধী কলকাতা সাক্ষী দেশের প্রথম জাতীয় পতাকার

১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। রণক্লান্ত ভারতবাসী পেল বহু আকাঙ্খিত মুক্তির স্বাদ।দেড়শো বছর ধরে ইংরেজ কর্তৃক পদদলিত হবার পর স্বাধীনতার সূর্যে উদ্ভাসিত হলো দিগন্ত। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বেই ১৯৪৭ সালের ২২ জুলাই গণপরিষদের বৈঠকে স্বীকৃতি দেওয়া হলো ভারতের জাতীয় পতাকাকে, যে পতাকা পক্ষান্তরে ছিল বহু যুদ্ধের সাক্ষী বহু বলিদানের নেপথ্য নায়ক।

পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তার ' কলের কলকাতা ' রচনায় লিখেছিলেন ,জাপানি বোমাতে নিস্পৃহ থাকা কলকাতা ঘাড় গুঁজে থাকা আপিস যাও আর বাড়ি ফেরোর কলকাতা হঠাৎ হঠাৎ ক্ষেপে ওঠে ইংরেজদের বিরুদ্ধে,প্রচন্ড রাগে ফেটে পড়ে,গর্জন করে ওঠে বন্দে মাতরম ধ্বনিতে। আক্ষরিক অর্থে বুড়ো কলকাতা তার বুকের গভীরে জমিয়ে রাখে হাজারো ইতিহাস,যার অনেকটাই প্রতিস্পর্ধা আর প্রতিবাদের।

সালটা ১৮৮৩,সময়টা উত্তাল।কলকাতা তখনও ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের রাজধানী।সমগ্র ভারতে স্বাধীনতার আগুন জ্বলছে পুরোদমে।ব্রিটিশ সরকারের শাসন আর শোষণের গ্রাফ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী।প্রতি মুহূর্তে তারা যেনো বুঝিয়ে দিতে উদগ্রীব তারা শাসক ভারতবর্ষ শাসিত।সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ' কলের কলকাতা ' - তেই তুলে ধরছেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক খণ্ডচিত্র - " ধর্মতলার চৌমাথা থেকে দূরে দেখা গেল একটা মিছিল।লাল,সবুজ আর তিনরঙা নিশান গিঁট দিয়ে বাঁধা।এগিয়ে এল মিছিল।যাবে দক্ষিণে।"

সুভাষ মুখোপাধ্যায় আরও লিখছেন, "মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মিনিটে একজন করে বুলেট বেঁধা লোক আসছে।কাউকে কাউকে হাসপাতালে না নামিয়ে সোজা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মর্গে।যাদের আত্মীয়স্বজন আছে,তাদের ঘিরে আকাশবাতাস জুড়ে বুকফাটা চিৎকার উঠেছে।"

এই লেখা থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে ইংরেজদের শাসন এবং শোষণের চিত্রটি।কিন্তু এরই পাশাপাশি আরও একটি ছবি কি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় না যে ইংরেজদের শত অত্যাচারও ভারতবাসীর স্বাধীনতা আন্দোলনকে বিন্দুমাত্র স্তিমিত করতে পারেনি।অন্যদিকে ঠিক এই সময়ই এক বাঙালি স্থান করে নিলেন ইতিহাসের পাতায়,সৌজন্যে তার তৈরি পতাকা। শ্রীশচন্দ্র বসু ছিলেন ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল সোসাইটির সদস্য।তার হাত ধরেই তৈরি হলো ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকা। যদিও সূর্যের প্রতীক দেওয়া সেই পতাকা পরবর্তীকালে প্রচারের আড়ালে চলে যায় কিন্তু এর পূর্বে ভারতের সর্বজনস্বীকৃত কোনো পতাকার খোঁজ পাওয়া যায় না। এমনকী সিপাহী বিদ্রোহ হয় দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের সবুজ জাফরের পতাকাকে সঙ্গী করেই।

এরপর চলে যাওয়া যাক ১৯০৫ সালে। বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় উদ্বেল আপামর ভারতীয়।লর্ড কার্জনের একটি সিদ্ধান্ত যেনো ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সেদিন ঘৃতাহুতি করেছিল।রাস্তায় নামলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। রাখির বাঁধনে বাঁধলেন আট থেকে আশি সক্কলকে।এই সময়েই ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বিভিন্ন গুপ্ত সংগঠনগুলি।সেই সময় পার্সিবাগান অঞ্চলে যুগান্তর গোষ্ঠীর বিপ্লবী তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো।শ্রীশ চন্দ্র বসু পরবর্তী প্রজন্মের হাতে যে জয়পতাকা বহনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাই সুচারুভাবে বহন করেছিলেন যুগান্তর গোষ্ঠীর সদস্যরা।তারাও একসময় সিদ্ধান্তে এলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিপূর্ণতা অর্জন এবং সমস্ত বিপ্লবী সংগঠনগুলিকে এক ছাতার তলায় আনতে অবিলম্বে প্রয়োজন একটি জাতীয় পতাকার।সেইমতো পতাকার নীল নকশা তৈরীর গুরুভার অর্পিত হলো অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটির সম্পাদক শচীন্দ্র প্রসাদ বসু এবং সুকুমার মিত্রের হাতে।

১৯০৬ সালের ৭ই আগস্ট।কর্মব্যস্ত কলকাতা তখন সবে একটা নতুন কর্মমুখর দিন উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক সেই সময় কলকাতার গ্রীয়ার পার্কে উত্তোলিত হল এই জাতীয় পতাকা।ব্যারিস্টার প্রমথনাথ বসু উত্তোলন করেছিলেন পতাকাটি যার ব্লু প্রিন্ট তৈরি হয় দুই বাঙালির হাতেই।একজন শচীন্দ্র প্রসাদ বসু অন্যজন সুকুমার মিত্র।

স্বাধীনতা সমতা এবং সৌভ্রাতৃত্ব এই ছিল কলকাতার বুকে উত্তোলিত জাতীয় পতাকার মূল বিষয়। ফরাসী জাতীয় পতাকার আদলে তৈরি এই পতাকাটি পরবর্তীতে পরিচিতি পায় ' ক্যালকাটা ফ্ল্যাগ ' নামে।

কে ভি সিং জানান, অনুভূমিক এই পতাকায় ছিল সবুজ হলুদ এবং লাল এই তিনটি রঙের আধিক্য।হলুদ অংশে লেখা থাকত ' বন্দেমাতরম ' সবুজ অংশে ছিল আটটি পদ্ম আবার লাল রঙের বামদিকে ছিল সূর্য ডানদিকে ছিল চাঁদ - তারা যা ছিল হিন্দু মুসলিমের সৌভাতৃত্বের প্রতীক। আশ্চর্যের কথা ১৯০৬ সালে যে কলকাতায় হিন্দু - মুসলিমরা সৌহার্দ্যের ভিত্তিতে নির্মিত হচ্ছে ভারতের জাতীয় পতাকা ১৯৪৬ সালে সেই কলকাতায় রক্তরাঙা হয়ে উঠছে সাম্প্রদায়িকতার রক্তে। রাজনীতি কত বিচিত্র! 

১৯০৭ সালের ২২এ আগস্ট জার্মানির মাটিতে ক্যালকাটা ফ্ল্যাগের অনুসরণে আরও একটি পতাকার আবির্ভাব ঘটে মাদাম ভিবাজির হাতে।এরপর এল সেই বহু প্রতীক্ষিত ১৯২৯ এর ৩১এ ডিসেম্বর।এই দিনই ভারতের জাতীয় কংগ্রেস স্বীকৃতি দেয় ' ক্যালকাটা ফ্ল্যাগকে।'

এভাবেই কল্লোলিনী তিলোত্তমা শোনায় প্রতিস্পর্ধা আর শাসকের চোখে চোখ রেখে প্রতিবাদ করার গল্প।একটি পতাকা কলকাতার মাটিতেই জন্ম দিয়েছিল এক ইতিহাসের। কিন্তু শুধুই কি ইতিহাস? নাকি সে রূপকথার গল্প? ঠাকুরমার ঝুলি উপুড় করে যে গল্প শুনিয়েছে শহর কলকাতা। আত্মবিস্মৃতিতে আচ্ছন্ন বাঙালি কি সেই ইতিহাসকে মনে রেখেছে?

তথ্যসূত্র - ' কলের কলকাতা ' - সুভাষ মুখোপাধ্যায়

কলকাতার সাতকাহন

More Articles