ধূমধাম করে প্রথম সমকামী পুরুষের বিয়ে, কলকাতা সাবালক হল?
কলকাতায় সমলিঙ্গের এই বিবাহ কি নিজেকে স্বীকার করার সাহস জোগাবে সত্যিই? তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত শ্রেণির মধ্যে যাঁরা পড়েন না, যেখানে ভালবাসা ও যৌনতা দুইয়ের স্বাধীনতাই অলীক, সেইখানে কি পৌঁছবে অভিষেক-চৈতন্যের সাহসের আলো?
কে কাকে ভালবাসবে, এই নিয়ে রাষ্ট্রের কেন মাথা ব্যথা হবে? নেই তো! কে কাকে ভালবাসবে এই নিয়ে রাষ্ট্র মোটেও চিন্তিত নয়। রাষ্ট্রের কপালে চিন্তার খাদ একমাত্র যৌনতা নিয়েই। আর যেহেতু ভারত কেন, মোটামুটি অধিকাংশ সামাজিকতাতেই প্রেম মানেই বিয়ে আর বিয়ে মানেই যৌনতা, তাই সেখানে রাষ্ট্র ছোট্ট করে ‘ধারা’ বসিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে ধারা তুলে নিয়ে বলে, সমপ্রেম অপরাধ নয়। অথচ বিয়ে করলে, মানে যৌনতার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ঘটলে সেখানে দ্বিচারিতা। বিয়ে ছাড়া যৌনতা সামাজিক অপরাধ, বিয়ে করে সমলিঙ্গে যৌনতা আইনি অপরাধ! তবু, শারীরিক লিঙ্গপরিচয় নির্বিশেষে যাঁরা বিবাহকেই ‘পরিণতি’ ভাবতে অভ্যস্ত, তাঁরা প্রেম ও যৌনতার সামাজিক সিলমোহরকে কোথাও না কোথাও মান্যতা দেনই। আসলে এভাবেই বেড়ে ওঠার মধ্যে আর চিন্তনের মধ্যে প্রথা মিশে রয়েছে। প্রথা ভাঙা বলতে যা বুঝি, আসলে তাও কোথাও প্রথাকেই মান্যতা দেয়। সম্প্রতি কলকাতায় প্রথম সমলিঙ্গের আনুষ্ঠানিক বিয়ে উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি সেই প্রথারই গল্প বলে। ফ্যাশন ডিজাইনার অভিষেক রায় আর তাঁর সঙ্গী চৈতন্য শর্মার বিয়েকে কলকাতার LGBTQ+ সম্প্রদায়ের ‘আশার আলো’ বলে মনে করছেন অনেকেই। আশার নিজস্ব আলো কি সত্যিই প্রথা আর সামাজিক স্বীকৃতির ওপর নির্ভর করে? ভালবাসা কি নিজেই তবে অনন্য নয়? আলো নয়? মশাল নয়?
অভিষেক আর চৈতন্য ভালবেসেছেন। একসঙ্গে থাকার জন্য বিয়ে করতে চেয়েছেন। কিন্তু দুই পুরুষ/মহিলা বিয়ে করলে নিজস্ব সন্তান, উত্তরাধিকার, পিতৃপরিচয় এসব প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে রাষ্ট্র এখনও বিয়েকে আইনত মান্যতা দেয়নি। ৩৭৭ ধারা তুলে নেওয়ার পর সমলিঙ্গের প্রেম এদেশে ‘অপরাধ’ না হলেও, সমলিঙ্গে বিয়ে করে আইনের খাতায় নাম তোলা যাবে না। তবু অভিষেক ও চৈতন্য বিয়ে করেছেন। অভিষেক চৈতন্যের মতো অনেকেই দেশে ধীরে ধীরে সমলিঙ্গের বিয়েকে ‘চোখ সওয়া’ করে তুলতে পেরেছেন। সমলিঙ্গের প্রেমকে আমরা প্রথাভাঙা সম্পর্ক বলেই ডাকি। লিঙ্গচেতনার সম্যক ধারণা থাকলেও, মনে মনে বিষমকামকেই প্রথা বলে ভেবে নিই। কিন্তু প্রেমের প্রথা ভাঙলেও স্বীকৃতিতে আজও বিয়ের প্রতিষ্ঠানেই এসে গোঁত্তা খাচ্ছে সম্পর্ক। প্রতিষ্ঠানের আশ্রয় ছেড়ে কি বেরতে পারছে কাম, সম বা বিষম? সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান, মাল্যদান, সাতপাক, মন্ত্রোচ্চারণ নিয়ম মেনে করেছেন অভিষেক ও চৈতন্য। তবু, পথে-ঘাটে লোকে ঢিল ছুঁড়বে কি না, এই আশঙ্কা তো ছিলই ফ্যাশন ডিজাইনার অভিষেকের।
বছর দু’য়েক আগে ফেসবুকে আলাপ অভিষেক ও চৈতন্যের। কথাবার্তা গড়ায় ভিডিও কলে, ভিডিও কল গড়ায় সাক্ষাতে। অভিষেকের শহর কলকাতায় দু’দিন কাটিয়ে যেতে আসেন ডিজিটাল মার্কেটিং কর্মী চৈতন্য। দু’দিনের ছুটি গড়িয়ে যায় দু’সপ্তাহে! তারপর চৈতন্যের শহরে আমন্ত্রণ অভিষেকের। গত বছরের মার্চে দু’জনেই পাড়ি দেন আগ্রাতে। তাজমহলের সামনে অভিষেককে বিয়ের প্রস্তাব দেন চৈতন্য। ভালবাসার মহলের সামনে এমন হাঁটু মুড়ে বসা কত কত ছবিই তুলেছেন প্রেমিক-প্রেমিকারা। অভিষেক-চৈতন্য আগল ভেঙেছেন। তাজমহলের সামনে ভালবাসার ছবি তুলেছেন, সেই ছবি দিয়েই নিজেদের বিয়ের কার্ডও ছাপিয়েছেন। যদিও বিতর্ক এড়াতে তাজমহলকে মুছে ফেলেছেন দৃশ্যপট থেকে। নিজের অফিসে গত মাসেই ‘প্রাইড মান্থ’ উদযাপন করতে গিয়ে শ’তিনেক মানুষের সামনে অভিষেককে বিয়ের কথা ঘোষণা করেন চৈতন্য।
আরও পড়ুন: আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন! পথ দেখাচ্ছেন ভারতের প্রথম রূপান্তরকামী ড্রোন পাইলট
তবে ভারতে ভালবাসার, পছন্দসই খাবার খাওয়ার, পছন্দসই কথা বলার একখানা যথার্থ শাস্তি রয়েছে। গণপিটুনি। সমলিঙ্গে ভালবেসে মার খেয়ে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা জানে এই প্রজাতন্ত্র। ফলে অভিষেক, চৈতন্য যতই সমাজের ক্রিম স্তরের মানুষ হন না কেন, এই ভয় প্রোথিত ছিলই মনে। তবু, ভালবাসলে সাহস বেড়ে যায়। রথের দিন, ১ জুলাই আশীর্বাদ সেরেছেন তাঁরা। অভিষেক ও চৈতন্যের বিয়ে শুধুই সমলিঙ্গের নয়, দুই সংস্কৃতিরও। বাঙালি আর মারোয়াড়ি পরিবারের এই বিয়ে, তাও সমলিঙ্গে, তা বিশেষ উল্লেখের দাবি তো রাখেই। অভিষেক রায় জানিয়েছেন, এই বিয়ে যাতে বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের জন্য স্মরণীয় হয়ে থেকে যায়, সেটাই চেয়েছেন তাঁরা। তবে নিঃসন্দেহে কলকাতায় সমলিঙ্গের এই প্রথম বিয়েতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন পুরোহিত। পুরোহিত জানেন, হয়তো এই বছর অনেক দুর্গাপুজোয় পৌরহিত্যের সুযোগ হারাবেন, পরিচিত বৃত্তে সমালোচনার সম্মুখীন হবেন, তবুও রাজি হয়েছেন তিনি।
প্রথার পথে গেলে প্রথা মেনেই যেতে হবে, ফলে বিয়েকে ঘটমান করতে প্রয়োজন পুরোহিতের। পারিবারিক পুরোহিতকে নিজের অন্য পুরুষকে বিয়ের কথা প্রথমে বলতে পারেননি অভিষেক। তাঁর এক তুতো ভাই এক পুরুষকে বিয়ে করতে চান, এই বলেই পুরোহিতের কাছে কথাটা পাড়েন তিনি। বাকিটা সত্যিই চমকে দেওয়ার মতো। 'বিয়ে দুই মনের মিলন' বলে বিশ্বাস করেন ওই পুরোহিত। ফলে মনের কোনও লিঙ্গ নেই। যে কোনও লিঙ্গেই বিয়ে দেওয়া সম্ভব। ভরসা সাহস বাড়ায়। ফলে কোনও তুতো ভাইয়ের আড়াল নয়, নিজের লিঙ্গপরিচয় আর বিয়ের ইচ্ছের কথা পুরোহিতকে সরাসরিই জানান অভিষেক। এই সিদ্ধান্তকে ‘প্রগতিশীল’ বলেই মনে করেন অভিষেক-চৈতন্যের বিয়ের পুরোহিত। জানান, পড়াশোনা করা মানুষ এগিয়ে এলে অনেকেই সাহস করে এগিয়ে আসবেন।
নিজেদের লিঙ্গপরিচয়কে সামাজিক ব্যাঙ্গর ছিটে থেকে বছরের পর বছর লুকিয়ে রাখাটাই সাহস। সমস্ত বন্ধুমহলে নির্ভরযোগ্য কোনও মানুষকে খুঁজে নিজের কথা বলতে না পেরে চেপে যাওয়াটাই সাহস। পরিবার থেকে একঘরে হয়ে যাওয়ার ভয়কে নিজের মধ্যে রেখেও স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়াটাই সাহস। এত প্রাচীর গড়েও তারপর যারা স্বীকার করতে পারেন নিজেকে, তাঁদের কাছে সেটাই সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। নিজেকে নিজে স্বীকার করার জয়ের স্বাদ সবচেয়ে সাহসের। এই সাহসের রাষ্ট্র, পরিবার কারও পৃষ্ঠপোষতার তোয়াক্কা না করারই কথা। তবু একসঙ্গে থাকতে গেলে সাহসের পাশাপাশি আইনের দরকার পড়ে। দরকার পড়ে মন্ত্রের, আচারের। অভিষেক চৈতন্যের বিয়েতে পুরোহিত সমস্ত মন্ত্রোচ্চারণ করতে ও করাতে পারেননি, সেগুলির লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনের কারণে। কন্যা ও সিঁদুর কোনওটাই দান করাতে পারেননি লিঙ্গভেদের কারণে। যে প্রথার মধ্যে, আচারের মধ্যে লিঙ্গ ও যৌন আচরণ এত স্পষ্ট, তবু কেন ফিরে আসা সেই প্রতিষ্ঠানের কাছে?
কলকাতায় সমলিঙ্গের এই বিবাহ কি নিজেকে স্বীকার করার সাহস জোগাবে সত্যিই? তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত শ্রেণির মধ্যে যাঁরা পড়েন না, যেখানে ভালবাসা ও যৌনতা দুইয়ের স্বাধীনতাই অলীক, সেইখানে কি পৌঁছবে অভিষেক-চৈতন্যের সাহসের আলো? পৌঁছলেও, প্রথাভাঙা প্রেম কি রাষ্ট্র আর সমাজের স্বীকৃতি আকাঙ্ক্ষা মুক্ত হবে কোনওদিনও? এ প্রশ্নও সহজ নয়, এর উত্তরও বাতাসে বয় না। শুধু নিজেকে জয় করলে প্রশ্নগুলো ঝাপসা হয়ে হেতু হারায়। ভালবাসা নিজে এক অনন্য আলো হয়ে ওঠে।