স্বাধীনতার পর এই প্রথম! দেশের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই হল না একজন মুসলিম সাংসদেরও
Modi Cabinate 3.O: তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। শপথ নিয়েছেন ৩০ পূর্ণমন্ত্রী এবং ৪১ প্রতিমন্ত্রী। সেই তালিকায় কতজন খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ, ওবিসি, দলিত কিংবা আদিবাসী?
পাঁচ বছর আগের কথা। সংসদ ভবনে জোটের বৈঠকে এসে সংবিধানে মাথা ঠেকানোর পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, 'সব কা সাথ, সব কা বিকাশ, সব কা বিশ্বাস'। সে বার প্রথম 'সব কা বিশ্বাস' আগের অংশের সঙ্গে যোগ করেছিলেন তিনি। এর অর্থ ছিল - সংখ্যালঘুদের বিশ্বাস অর্জন। কিন্তু তারপরও দেশকে ফের টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আস্তাকুঁড়ে। শেষ দশ বছরে আইন-আদালতকেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির হাতিয়ার করা হয়েছে। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে বোঝা গেল, হিন্দুত্ববাদী ভাবধারার বাইরে থাকা বৃহত্তর হিন্দু সমাজ এবং অন্য ধর্মের মানুষও একপেশে রাজনীতির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। ফলত হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি এবার বিফলেই গেল। এ বার একক ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি বিজেপি। ফলস্বরূপ পদ্মশিবিরকে সরকার গড়তে অনেকটাই ভরসা করতে হয়েছিল শরিক দলগুলির উপরে। এনডিএ-র ছোট বড় প্রায় সব শরিক দলেরই ঠাঁই হল মন্ত্রিসভায়। রবিবার তৃতীয় এনডিএ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হয়েছে। তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। তাঁর সঙ্গে শপথ নিয়েছেন ৩০ জন পূর্ণমন্ত্রী এবং ৪১ জন প্রতিমন্ত্রী। সেই তালিকায় কতজন খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ, ওবিসি, দলিত কিংবা আদিবাসী? শুধুই কি ভোটের ময়দানেই মুসলিম বিরোধিতা, নাকি প্রার্থী নির্বাচনেও প্রাধান্য পেয়েছে সেই ধর্মীয় মেরুকরণই?
আসলে গণতন্ত্রে বৈচিত্র্য ও সমাজের সব শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব গুরুত্বপূর্ণ হলেও বিজেপি সরকার সেই জায়গাটাই ধুয়ে মুছে সাফ করে দিতে চেয়েছে গত কয়েক বছরে। তার জন্যই সংবিধান পরিবর্তনেরও পরিকল্পনা করেছিল দল। বিজেপিতে ২৪০ জন বা এনডিএ জোটে ২৯৩ জনের মধ্যে মুসলিম সাংসদের সংখ্যা শূন্য। এনডিএ-তে ৩৩.২% ব্রাহ্মন-রাজপুতদের মতো উচ্চবর্ণ এবং ১৫.৭% অন্যান্য উচ্চবর্ণের সাংসদ হয়েছেন। উচ্চবর্ণের মোট ২১ জন সাংসদ হয়েছেন। ওবিসিদের থেকে রয়েছেন ২৬.২%, দলিতদের থেকে ১৩.৩%, এবং আদিবাসীদের থেকে ১০.৮% জনপ্রতিনিধি। মোট ২ জন বৌদ্ধ, ২ জন শিখ এবং ১ জন খ্রিস্টান সাংসদ হয়েছেন। এনডিএ সরকারের জোটে একজনও মুসলিম সাংসদ নেই।
আরও পড়ুন: মোদির মন্ত্রিসভা ৩.০ তৈরি! মন্ত্রিত্বে কারা? পদ খোয়ালেন কারা?
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, দেশে হিন্দু জনসংখ্যা প্রায় ৮০%। তাঁদের মধ্যে তথাকথিত উচ্চবর্ণ ২৬%, দলিত ২২.২%, আদিবাসী ৯% এবং ওবিসি প্রায় ৪৩%। এখানেই প্রশ্ন ওঠে, তাহলে 'সব কা সাথ, সব কা বিকাশ, সব কা বিশ্বাস'-র স্লোগান আসলে কতটা যুক্তিযুক্ত ছিল? কিন্তু নির্বাচনের ফল দেখলেই বোঝা যায়, প্রধানমন্ত্রীর বিষময় ভাষণ, হিজাব নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত, মসজিদে মাইক বন্ধ, সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা, সংরক্ষণের বিরোধীতা, সংবিধান পরিবর্তনের দাবির মতো ঘৃণার রাজনীতিতে সায় দেয়নি দেশবাসী।
২০২৪-র লোকসভা নির্বাচনে মোট ৭৮ জন মুসলিম প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তার মধ্যে ২৪ জন মুসলমান জনপ্রতিনিধি লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছেন। ২৪জনের মধ্যে ২১জন জনপ্রতিনিধিই বিরোধী জোট ইন্ডিয়ার। কংগ্রেস থেকে ৯ জন, তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) থেকে ৫ জন, সমাজবাদী পার্টি থেকে (এসপি) থেকে ৪ জন, ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগ (আইইউএমএল) থেকে একজন, এবং ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) থেকে ২ জন সাংসদ হয়েছেন। এছাড়াও এআইএমআইএম-এর ১ জন মুসলিম সাংসদ রয়েছেন। এই দলেরই সংসদ আসাদুদ্দিন ওয়াইসি। এছাড়া বারামুল্লা থেকে নির্দল লড়ে জিতেছেন ইঞ্জিনিয়ার রশিদ। এবং লাদাখ থেকে নির্বাচিত হয়েছেন মহম্মদ হানিফা।
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, ৬৫টি লোকসভা আসনে মুসলিমদের মোট জনসংখ্যা কমপক্ষে ২৫%। লক্ষদ্বীপে মুসলমান জনসংখ্যা সর্বাধিক। ২০১৯ সালে এক চতুর্থাংশেরও কম মুসলিম জনসংখ্যার এলাকা থেকে ৭ জন মুসলিম সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। সে বছর প্রধান দলগুলোয় ১১৫জনকে প্রার্থী করা হয়েছিল। তার মধ্যে জয়ী হয়েছিলেন ১৬ জন। ২০১৯-র নির্বাচনে এই ৬৫টি আসনের মধ্যে ১৯ জন মুসলিম সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই বছর ১৯ থেকে বেড়ে হয়েছে ২২। দেখা গেছে, যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা ৪%-এরও কম, সেখান থেকেও ২ জন মুসলিম সাংসদ জয়ী হয়েছেন। উত্তরপ্রদেশের গাজিপুরে মুসলিম জনসংখ্যা ১০.১৭ % , সেখানে সমাজবাদী পার্টির (এসপি) আফজল আনসারি জয় পান। একইভাবে তামিলনাড়ুর রামানাথপুরামে মুসলিম জনসংখ্যা ১১.৮৪% সেখানেও আইআইএমএলের নবস্কানি জয়ী হয়েছেন। ফলত মুসলিমদের প্রার্থী করলে তারা যে জিতবে না এমনটা নয়। তবে কি লোকসভা ভোটে হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি করতে গিয়েই উদ্দেশ্যমূলক ভাবে প্রার্থী নির্বাচন করেছিল বিজেপি? প্রশ্ন ওঠে বৈকি।
সম্প্রতি ওয়াশিংটনের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক পিউ রিসার্চ সেন্টারের রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে। যেখানে দেখা গেছে, ২০২০ সাল অর্থাৎ কোভিড কালে ধর্ম নিয়ে সামাজিক শত্রুতার সূচকে ১৯৮টি দেশের মধ্যে ভারতের নাম ছিল শীর্ষে। আমেরিকা ভিত্তিক সংস্থা 'কাউন্সিল অন মাইনরিটি রাইটস ইন ইন্ডিয়া'-র সাম্প্রতিক রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, ২০২২-এ ভারতে সংখ্যা লঘুদের উপর সংগঠিত ঘৃণামূলক অপরাধের ২৯৪টি মামলা দায়ের হয়েছে। তার মধ্যে ১৯২টি মুসলমানদের বিরুদ্ধে। খ্রিষ্টান ও শিখদের বিরুদ্ধে অপরাধের ঘটনার সংখ্যা ৯৫ এবং ৭টি। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক অপরাধের ঘটনাগুলি একটি নির্দিষ্ট দল শাসিত রাজ্যে একই প্যাটার্নে সংঘটিত হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ঘটনায় নজরদারির কাজ করে আসা মার্কিন সংস্থা 'ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম' টানা চারবার ভারত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ করারও সুপারিশও করা হয়েছে রিপোর্টে। যে সকল প্রশাসনিক আধিকারিক এবং এজেন্সির লোকজন ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ঘটনায় অভিযুক্ত, তাদের বিরুদ্ধে আমেরিকায় প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা জারিরও দাবি করা হয়েছে। তাদের মার্কিন ভিসা না দেওয়ার ব্যবস্থা করারও দাবি করা হয়েছে প্রশাসনের কাছে। তাদের আমেরিকায় কোনও সম্পদ থাকলে তা-ও বাজেয়াপ্ত করার দাবি উঠেছে। দেশের বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগে উঠলেও দেশপ্রেমের অন্ধ ধ্বজাধারীদের কোনও কিছুই আসে যায় না। বিপদ হল, ক্ষমতাসীন জোটে এইবার একজনও মুসলিম জনপ্রতিনিধি নেই। সম্প্রদায়ের জীবনদুর্দশা সামনে আনতে অবশ্যই তাদের প্রতিনিধিত্ব প্রয়োজন হয়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, দেশের শান্তির কথা, গণহত্যার কথা বললে জেলে যেতে হয়। ভারতে ক্ষমতাসীনরা গর্বের সঙ্গে এই দ্বিচারিতা করেই চলেছে।
আরও পড়ুন: ভুল সংশোধন নাকি নয়া কৌশল! ক্ষমতায় বসেই কৃষকদের ভাবনা কেন ভাবছেন মোদি?
উল্লেখ্য, সিএএ-তে অন্য সম্প্রদায়ের উল্লেখ থাকলেও বাদ পড়েছেন কেবল মুসলিমরা। দেশবাসীর কানে ধর্মীয় বিভেদ-বিদ্বেষের বিষ ঢেলে গিয়েছেন দেশের দণ্ডমুন্ডের কর্তারা। প্রধান দলগুলি গত দু'বছরের তুলনায় ২০২৪ সালে কম মুসলিমকে প্রার্থী করেছিল। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, দেশে মুসলিম জনসংখ্যা ১৪% হলেও, মুসলিম সাংসদের অনুপাত ৫%-এরও নীচে নেমে গেছে। ২০২৪-এ মুসলিম সাংসদের অনুপাত ৪.৪২%। এটি সর্বকালের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। ১৯৮০ সালে এই অনুপাত ছিল - ৯.০৪% (৪৯ জন) এবং ১৯৮৪ সালে ছিল ৮.৩% (৪৫ জন)। ২০১৪ সালে বিজেপি একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেলেও দলে মুসলিম সাংসদ ছিল। কিন্তু এ বার বিজেপির জোট এনডিএ-তেও মুসলিম সাংসদের সংখ্যা শূন্য। স্বাধীনতার পর দেশে প্রথমবার মন্ত্রিসভায় একজনও মুসলিম সাংসদ নেই। মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিশেষ সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে যা যা বিদ্বেষ ছড়িয়ে গেছেন, এও কি তারই অংশ? ভোটের ফলেই দেখা গেছে অর্ধেকের বেশি দেশবাসীকে নিজের পক্ষে টানতে পারেনি বিজেপি। এইবার কি তবে ক্ষমতাসীনরাই ধর্মীয় মেরুকরণ ইতি টানবে? তবে কি বলা যায়, সব আলো এখনও নিভে যায়নি? এখনও আশা আছে কিছুটা?