ছোট্ট চালে নেহরুকে একঘরে করেছিলেন, মোদিদের আসল পূর্বসূরি তিনিই
বিজেপির এযাবৎ নেহেরু-ইস্যুর প্রথম বাহক এই লোহিয়াই। যা যুক্তি-বিতর্কে আলোচিত হলেও প্রকাশ্য সত্যই বটে!
গণতন্ত্রে বিরোধিতা শুভ! শাসকের ভুল ধরিয়ে সমালোচনা, ভিত্তি শক্ত করে মানুষের উন্নয়নের। এই ভারতে, ইংরেজ শাসনাধীন ভারতের তুলনায় ঠিক কতটা শাসক-বিরোধিতা সম্ভব, কতটা সংবাদমাধ্যমের দ্বারা ভুল ধরিয়ে দেওয়া সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে নিরন্তর। উমর খালিদ থেকে শিলাদিত্য, অম্বিকেশ; চিকিৎসক কাফিল থেকে কামদুনির টুম্পা-মৌসুমী। শাসক-সমালোচনা, সরকার-বিরোধিতার পথের ৭৫ বছর আজ অতিক্রান্ত। কিন্তু এই সময় এবং আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগের ভারত কি এক ছিল? সমালোচনা, শাসক-বিরোধিতার আবহে ব্রিটিশ-পরবর্তী নেহরু-যুগে সম্ভব ছিল বিরোধিতা? উত্তর যদি না হয়, তবুও, আবার এর উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, সেই ক্ষেত্রেও যাঁর নাম প্রথমত সামনে আসবে, তিনি হলেন রামমনোহর লোহিয়া।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর কংগ্রেস-অন্দরে বিরোধিতার পরে, স্বাধীনোত্তর ভারতে শাসক সমালোচনায় অগ্রগণ্য ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম এই মুখ। কেটে গিয়েছে সময়। পরিবর্তিত হয়েছে ধারণা। ইতিহাস লেখা হয়েছে নতুনভাবে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে, ইতিহাসের চিরাচরিত দাবি মেনে তিনি রয়েছেন একইভাবে। রয়েছেন বর্তমানের অনুষঙ্গেই! এখনও মুখে মুখে অতি-প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন তিনি। কেন?
তাঁর প্রাসঙ্গিকতার আবহে জড়িয়ে আছে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর নাম। আজও যাঁর নাম উচ্চারিত হয় বর্তমান শাসকের ভাষণে। যাঁর নীতি, সরকারের 'কালো দিক' আলোচিত হয় বর্তমান শাসকের গোলটেবিল বৈঠকে। প্রকাশ্যে সমালোচিত হন তিনি। নেহরু-অস্বস্তি ঠেকাতে আজও ব্যাটন ধরতে হয় ক্রমশ রাজনৈতিক মোক্ষের পথে অগ্রসর হওয়া কংগ্রেসকে। কিন্তু কেন? যে কংগ্রেস দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে পথ দেখাল, যে নেহরু-গান্ধী দেশকে 'স্বাধীন করলেন', আধিপত্যযুক্ত স্বাধীন ভারত থেকে গণপ্রজাতান্ত্রিক ভারতের পথকে সূচিত করলেন যাঁরা- তাঁদেরও কালো দিক! সমালোচিত তাঁরাও!
আরও পড়ুন: অধীন থেকেই স্বাধীন! নেতাজির দুঃস্বপ্ন সত্যি হয়েছিল গান্ধী-নেহরুর হাত ধরে?
একদা, দেশের সামগ্রিকতায় একাধিপত্য বিস্তারের কেন্দ্রবিন্দু পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু সরকারের বিরোধিতায়, নিজস্ব দলীয় কোন্দলের ফলপ্রসূ গঠিত হয়েছিল 'জনসংঘ'। যে প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই মূলত, নেহরু-মিথ সম্পর্কে সরব হতে দেখা যায় অনেককেই। অর্থাৎ, যে নেহরু ১৯৪৭-এর আগে থেকে শুরু করে স্বাধীনোত্তর ভারতের শাসনব্যবস্থায় একছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন, তাঁকেই ছয়ের দশকের প্রথম দিকে পড়তে হল সমালোচনার মুখে। পরবর্তীতে ইন্দিরা-রাজের জরুরি অবস্থা এবং বিরোধীদের কণ্ঠরোধের অভিযোগ নেহরুর বিরুদ্ধে না উঠলেও তাঁর সরকার চালানোর সঙ্গে দেশের প্রতিটি স্তরের মানুষের যোগাযোগ স্থাপন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন কেউ কেউ। আর এখানেই উল্লেখযোগ্যভাবে উঠে আসে রামমনোহর লোহিয়ার নাম।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং জওহরলাল নেহরুর বিরোধ, নেতাজি অন্তর্ধানের পর লোহিয়ার নেহরু-বিরোধ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্য মাত্রা দান করে। যেখানে নেহরুর শাসনকাল এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধিতায় প্রতিষ্ঠিত আকস্মিক 'জনসংঘ'-র প্রতিষ্ঠার অনেক আগে থেকে মূলত পাঁচ-ছয়ের দশক থেকেই নেহরুর একাধিক কার্যক্রমের বিরোধিতায় সরব হন রামমনোহর লোহিয়া। বাবার গান্ধী-প্রীতি, কংগ্রেস-যোগ, স্বাধীনতা আন্দোলন, বিদেশ থেকে ফিরে 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী এই কংগ্রেস নেতা দলেরই নেতার বিরুদ্ধে সরব হন। যা পরবর্তীকালে, জনসংঘ এবং নেহরু-বিরোধী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা পালন করেছে বলেই মেনে নেওয়া হয়।
ঠিক কী নিয়ে সরব ছিলেন লোহিয়া? নেহরু এবং তাঁর সরকার চালানোর ভাষায় ইংরেজির আধিক্য। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরকারের কাজের ভাষাগত ফারাক এবং এলিট ক্লাসের সরকার, এই বিতর্কে প্রথমেই ধাক্কা খেতে হয় নেহরুকে। প্রধানত, মানুষ সরকার-প্রধানের ভাষা বুঝতে পারছে না, এই নিয়েই সলতে পাকে নেহরু-বিরোধিতার প্রদীপে। এর থেকেই নেহরু-মিথের, নেহরু-মিথ্যার দিকে রূপান্তরিত হওয়ার সূচনা করেন লোহিয়ারা। যেখানে সাধারণ মানুষের সরকার, সাধারণের জন্য সরকার এবং নেহরু শাসনের সেই সাধারণের ধর্তব্যে সরকারের না আসা নিয়েই সরব হন লোহিয়া। মূলত, ছয়ের দশকের মধ্যবর্তী পর্যায় থেকে লোহিয়ার নেহরু-বিরোধিতার সুর চড়তে থাকে। যা ইন্ধন পায় বিজেপির পূর্বসূরি জনসংঘের প্রতিষ্ঠায়।
লোহিয়া মূলত স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে নেতাজির পরে স্বাধীনোত্তর ভারতে নেহরুর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিরোধিতার সূচনা করেন। মূলত, নেহরু এবং তৎকালীন কংগ্রেসকে অভিজাত এবং ইংরেজি ভাষার দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষমতা অর্জন করেছিলেন রামমনোহর লোহিয়ারা।
যেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, অনগ্রসর শ্রেণি-ইস্যু। জাতিগত সংরক্ষণবাদ। এই আবহেই লোহিয়া বাবাসাহেব আম্বেদকরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করেছিলেন বারবার। নেহরু যে জাতিগত সংরক্ষণ এবং ওবিসি ইস্যুতে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন না, এই বিষয়টিও বারবার দেখানোর চেষ্টা হয়। যে কালো অধ্যায় আজও নেহরুর বিরুদ্ধে প্রতিফলিত হয়, কংগ্রেস-বিরোধীদের নির্বাচনী জনসভায়।
নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষতা, নগরবাদ এবং সমাজতান্ত্রিক নানা উদ্যোগ একাধারে জনহিতে নেওয়া হলেও কিছু ক্ষেত্রে তাই-ই 'ভারতের জন্য সঠিক নয় নেহরুর এই নীতি', এমন বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। মূলত, মহিলাদের দাম্পত্য অধিকার-সংক্রান্ত নীতি, হিন্দু কোড বিল, জমিদারি বিলোপ আইন; সমকালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নেহরুর সঠিক রাজনৈতিক, সামাজিক পথ বিস্তার সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। যেখানে অনগ্রসর শ্রেণির সামগ্রিক অবস্থান এবং নেহরুর 'জনতা-বিরোধী নীতি' নিয়ে সরব হতে দেখা গিয়েছিল বিরোধীদের। এখানেই, স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে এক এবং অদ্বিতীয় নেহরু সাম্রাজ্যের প্রথম বিরোধী হয়ে উঠেছিলেন রামমনোহর লোহিয়া। যেখানে দাঁড়িয়ে, জনসংঘের বৃদ্ধি এবং পরবর্তীকালে স্বল্প মেয়াদের সোশ্যালিস্ট পার্টি, যা ১৯৫০-১৯৬০ সময়কালে সমাজতন্ত্রের নামে সর্বাধিক সোচ্চার হয়েছিল নেহরু-বিরোধিতায়। লোহিয়াই প্রথম, যিনি নেহরু এবং তাঁর ক্ষমতাকালের নীতি, আদর্শ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
যে সময় দাঁড়িয়ে মূলত, জাতিগত আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে সচেষ্ট হন ভারতের সমকালীন 'সামাজিক' নেতা। যাঁর মধ্যে সমকালীন বিশ্বের কমিউনিস্ট ভাবমূর্তির একটা প্রভাব ছিল বলেও নিশ্চিত করেন রাজনৈতিক বিশারদরা। যা মূলত নেহরু-রাজে অধরা ছিল, সেখানেও বিরোধে সরব হন লোহিয়া। অর্থাৎ বিজেপি, মোদির নেহরু-বিরোধের অনেক আগেই এই লোহিয়াই সূচনা করেছিলেন নেহরু-বিপক্ষের। রামমনোহর লোহিয়ার লেখা, একাধিক বইয়েও এমনই এক প্রকাশ্য আভাস পাওয়া যায়। যা নেহরু সমালোচনার এক অন্যতম অস্ত্র হিসেবেও পরিগণিত হয় বারবার।
নিজের দল এবং ব্যক্তিত্বকে অস্ত্র করে বাবাসাহেব আম্বেদকরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। ১৯৫৫ সালে তাঁর দলের অধিবেশনে আসার আমন্ত্রণ জানান বাবাসাহেবকে। আমৃত্যু নেহরুর নীতি, কাজের বিরোধিতায় সরব রামমনোহর: প্রজা সোশ্যালিস্ট পার্টি, সংযুক্ত সোশ্যালিস্ট পার্টি গঠনের মাধ্যমে সামনে আসতে থাকেন। যদিও নেহরুর 'রাজনৈতিক ক্রেজ' লোহিয়ার বিরোধিতা-পথে বাধা হলেও সেই সময়ে নেহরুর কঠিন রাজনৈতিক দেওয়ালে ছেদ করতে পেরেছিলেন লোহিয়া।
১৯৬৪ সালের নির্বাচনে রামমনোহরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং নেহরু, লোহিয়ার চিঠি আদানপ্রদান ঐতিহাসিকভাবে এই বিরোধিতার এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষর বহন করে। নেহরুর প্রয়াণের পর, ১৯৬৭ এবং উত্তরপ্রদেশ নির্বাচন, সরকার গঠনের আবহে অ-কংগ্রেসি সরকার প্রতিষ্ঠায় প্রধান ভূমিকা পালন করেন লোহিয়া। মূলত, জনসংঘের নানাজি দেশমুখের সঙ্গে জোট বেঁধে কংগ্রেসকে রাজনৈতিক ধাক্কা দেন তিনি।
কিন্তু কেন এই বিরোধ? বিদেশের পাট চুকিয়ে আসার আগে-পরে থেকেই লোহিয়া, তাঁর বাবার কংগ্রেসি আদর্শ এবং গান্ধী-ভক্তিতে প্রভাবিত ছিলেন। ছোট থেকেই দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি অমোঘ টান ছিল তাঁর। বারবার নেতাজি-সহ একাধিক স্বাধীনতার লড়াইয়ের নেতাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন তিনি। সেখানে দাঁড়িয়ে বিদেশ থেকে ফিরে 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনে বড় ভূমিকা পালন করেন এই যুবক। কিন্তু নেতাজির অনুপস্থিতিতে সমসাময়িক কংগ্রেস এবং নেহরু-প্রভাব ভালভাবে নেননি তিনি। নিজের নীতি-আদর্শ, খানিকটা বাম-প্রভাবিত সামাজিক ভাবনার আবহে লোহিয়ার সঙ্গে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে কংগ্রেসের। বরাবর সাহসী এই নেতা, সমাজতন্ত্র এবং সমাজের সকল গোষ্ঠীর প্রতি দায়বদ্ধতাকে প্রাধান্য দিয়ে ক্রমশ নেহরু আবহ থেকে দূরে সরেছেন। সেখান থেকেই তৈরি হয়েছে বিরোধ। মূলত, নেহেরুর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। অনেকেই দাবি করেন, নেহেরু ঘনিষ্ঠ বৃত্ত এবং সরকারে ভূমিকা পালনের সুযোগ না থাকায় বিগড়ে গিয়েছিলেন তিনি।
নেহরু-বিরোধ এবং কংগ্রেসের কাজকর্মের তীব্র প্রকাশ্য এই প্রতিবাদ কাজে লাগায়, নেহরু-বিরোধিতায় তৈরি জনসংঘ। পরবর্তীকালে সমাজতান্ত্রিক লোহিয়া অচিরেই শুধুই হিন্দুত্ববাদের বৃদ্ধির সহায়ক হিসেবে প্রতিফলিত হন। যা তাঁর আদর্শের সঙ্গে কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠলেও, একথা সত্য বিজেপির এযাবৎ নেহেরু-ইস্যুর প্রথম বাহক এই লোহিয়াই। যা যুক্তি-বিতর্কে আলোচিত হলেও প্রকাশ্য সত্যই বটে!