শুধু দেশের মানুষ নয়, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন ভারতে থাকা বিদেশিরাও
ভারতের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার এই যুদ্ধে কেবল ভারতীয়রা নয়, শামিল হয়েছিলেন কিছু ভারতপ্রেমী বিদেশিও।
স্বাধীনতার ৭৫ বছর। এই ৭৫ যেমন বর্তমান ভারতের উদযাপন, তেমনই ইতিহাসকে ফিরে দেখা। দীর্ঘ ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতাবাদের হাত থেকে ভারতীয়দের শাপমুক্তি। অজস্র মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা। ভারতের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার এই যুদ্ধে কেবল ভারতীয়রা নয়, শামিল হয়েছিলেন কিছু ভারতপ্রেমী বিদেশিও। তাঁদের মধ্যে একজন আইরিশ, চারজন ব্রিটিশ এবং দু'জন আমেরিকান, যাঁরা ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ে আগাগোড়া পাশে থেকেছেন। স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বর্ষে আজ আমরা স্মরণ করব সেইসব মহান ভারতপ্রেমিক বিদেশিদের।
অ্যানি বেসান্ত
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেওয়া বিদেশিদের মধ্যে সবার আগেই আসে অ্যানি বেসান্তের নাম। জন্মসূত্রে আইরিশ অ্যানি ভারতে আসেন ১৮৯৩ সালে। ইতিহাসের কী অদ্ভুত সমাপতন! ঠিক সেই বছরই মহাত্মা গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকা পাড়ি দিচ্ছেন লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে। ভারতে আসার পর সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার আগে অবধি অ্যানি বেসান্ত নারীশিক্ষার অগ্রগতি নিয়ে কাজ করেছেন। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির ক্ষেত্রেও তিনি অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণের পর নিজের আগের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি গড়ে তোলেন হোমরুল আন্দোলন। গান্ধী জাতীয় কংগ্রেসে যোগদানের পর বেসান্ত ও গান্ধীর মধ্যে এক গভীর রাজনৈতিক সখ্য গড়ে ওঠে। ১৯১৭ সালে অ্যানি বেসান্ত ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ অ্যানি বেসান্ত কে নিয়ে লিখছেন, "একদিন তিনি ভারতীয় হওয়ার পথ বেছে নিয়েছিলেন, আজ তিনি সত্যিই সব অর্থে ভারতীয়।" যদিও ইতিহাস সব অর্থে তাঁর সঠিক মূল্যায়ন করেনি।
আরও পড়ুন: ভারত ছাড়াও এই পাঁচটি দেশে ১৫ অগাস্ট পালিত হয় স্বাধীনতা দিবস
মাদেইলিন স্লাদে
স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িত বিদেশিদের নিয়ে আলোচনায় আর একজনের নাম আসবেই। তিনি মাদেইলিন স্লাদে। ফরাসি দার্শনিক রমা রঁলার মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে লেখা বই পড়ে গান্ধীর অহিংস রাজনীতির প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন স্লাদে। এরপর তিনি নিজেই সরাসরি যোগাযোগ করেন মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে। স্বয়ং গান্ধীর ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯২৫ সালে সবরমতী আশ্রমে আসেন স্লাদে। এরপর জীবনের বাকি ৩৪ বছর ভারতের সেবাতেই কাটিয়েছেন তিনি। গান্ধী তাঁকে কন্যার স্বীকৃতি দিয়ে নামকরণ করেছিলেন মীরা বেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বহুবার কারাবরণ করেছেন স্লাদে। ১৯৩২-'৩৩-এ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও আমেরিকায় ভারতের দুরবস্থার তথ্য পৌঁছে দিতে গিয়ে ব্রিটিশ সরকারের হাতে গ্রেফতার হন তিনি। এরপর ১৯৪২-এ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় মহাত্মা ও তাঁর স্ত্রী কস্তুরবা গান্ধীর সঙ্গে আগা খান প্যালেসে কারাবন্দি হন স্লাদে।
ভারতের স্বাধীনতা লাভের পরে দেশ ছাড়েন স্লাদে। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর শিল্পায়ন নীতির সঙ্গে গান্ধীর স্বনির্ভর গ্রামীণ ভারতের স্বপ্নকে মেলাতে পারেননি তিনি। ১৯৮১ সালে মারা যাওয়ার ঠিক আগের বছর স্লাদেকে পদ্মভূষণ পদকে সম্মানিত করে ভারত সরকার।
স্যামুয়েল স্টোকস
আমেরিকার ধনী পরিবারের সন্তান স্যামুয়েল স্টোকস ১৯০৪ সালে ভারতে এসেছিলেন কুষ্ঠ রোগীদের সেবা করার কাজে। কিন্তু ১৯১৯-এর জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড স্টোকসের জীবনটাকে আমূল বদলে দিল। তিনি সরাসরি যোগ দিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে। এরপর গান্ধীজির অনুপ্রেরণায় অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করলেন স্টোকস। দেশদ্রোহিতার দায়ে লাহোর জেলে ছয় মাস বন্দি করা হলো তাঁকে। এই জেলে থাকাকালীন সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে স্টোকসের নাতনি আশা শর্মা লিখছেন, "তখন জেলে ভারতীয় এবং ইউরোপীয়দের জন্য আলাদা ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বিদেশিদের জন্য বরাদ্দ বিশেষ সুবিধে নিতে তিনি অস্বীকার করেন। এমনই ছিল তাঁর ভারতপ্রেম।" তিনি নিজেকে মনেপ্রাণে একজন ভারতীয় ভাবতেন। পড়তেন খাদির পোশাক, বিয়ে করেছিলেন এক ভারতীয় মহিলাকে, এমনকী, হিন্দু হয়ে নিজের নাম বদলে হয়েছিলেন সত্যানন্দ।
বি. জি. হর্নিম্যান
যেসব বিদেশি অত্যাচারী ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে চোখে চোখ রেখে সাংবাদিকতা চালিয়ে যাওয়ার অভ্যেস তৈরি করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সামনের সারিতেই আছেন বি. জি. হর্নিম্যান। বম্বে থেকে হর্নিম্যানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো 'বম্বে ক্রনিকল', যেখানে ব্রিটিশ সরকারের জনবিরোধী নীতির তীব্র সমালোচনা করা হতো। হর্নিম্যানই জালিয়ানওয়ালাবাগ কভারেজের সময় ব্রিটিশ সরকারের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা অস্বীকার করেন। শুধু তাই নয়, নিজের সংবাদপত্রে লালা গোবর্ধন দাস নামে সেদিনের ঘটনার এক স্বাক্ষীর বয়ানও প্রকাশ করেন তিনি। যখন ইংরেজ সরকারের হান্টার কমিটি জালিওয়ানওয়ালাবাগ হত্যা মামলায় জেনারেল ডায়ারকে নিরপরাধ ঘোষণা করে, তখন এর তীব্র প্রতিবাদ করে হর্নিম্যান লেখেন, "ব্রিটিশ সরকার কী করে এতগুলো মানুষের মৃত্যুর দায়কে অস্বীকার করতে পারে? যেখানে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় কোনও আগাম সতর্কতা ছাড়া এতগুলো মানুষের ওপর গুলি চালানো হলো। এই দায় ইংরেজদেরই।"
ইংরেজ সরকারের বিরোধিতা করার জন্য ১৯২৫ সালে তাঁকে ব্রিটেনে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি নিজের জেদে আবার ভারতে আসেন এবং প্রেস অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া তৈরি করেন।
ফিলিপ স্প্র্যাট
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য ফিলিপ ১৯২৬ সালে ভারতে আসেন ভারতে সদ্য-প্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠনের দায়িত্ব নিয়ে। ১৯২৭ সালে শ্রমিক সংগঠনগুলিকে নিয়ে কাজ করবার সময়ে 'ভারত ও চীন' শিরোনামে একটি লেখার জন্যে তাঁকে জেলবন্দি করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। বি. আর. আম্বেদকর স্বয়ং ফিলিপের হয়ে মামলাটি লড়েন।
ফিলিপের নাম জড়ায় মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায়। পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টির কাজ করতে গিয়ে ১২ বছরের জেল হয় তাঁর। কিন্তু তার আগেই ১৯৩৪-এ তিনি কারামুক্ত হন।
শেষ জীবনে ফিলিপের বামপন্থী মতাদর্শে বিপুল বদল আসে। তিনি একটি পুঁজিবাদী পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। শেষ বয়সে গিয়ে অতি-বাম এবং অতি-ডান, দুই পন্থার প্রতিই তিনি আস্থা হারিয়ে ফেলেন।
ক্যাথলিন মেরি হেইলম্যান
মহাত্মা গান্ধীর আরেক মানসকন্যা মেরি হেইলম্যান ভারতে আসেন ১৯৩০ সালে। গান্ধী তাঁর নামকরণ করেন সরলা। উদয়পুরের এক স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নেন তিনি। এরপর ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গরিব, দুঃস্থ, শোষিত মেয়েদের উন্নতির স্বার্থে গড়ে তোলেন কস্তুরবা মহিলা উত্থান মন্ডল। ১৯৮২ সালে এই গান্ধীবাদী ভারতপ্রেমী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
রিচার্ড কেইথান
আমেরিকার সন্তান রিচার্ড একটি মিশনারি প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করতে ভারতে আসেন। কিন্তু মিশনারিদের কাজ তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। এরপর তিনি গান্ধীর মতাদর্শ অনুসারে জনসেবা ও স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। তামিলনাড়ুতেই তিনি জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন। সেখানেই এক মিশনারি হাসপাতালে ১৯৮৪ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।