বিভেদ ভুলেই ইফতারি স্বাদে মজেছে গোটা কলকাতা, হালিম থেকে শরবত, কোথায় মেলে সেরা খাবার?

Iftar food for Ramadan 2023 : কলুটোলার দিক থেকে জাকারিয়া স্ট্রিট, নাখোদা মসজিদের পাড়ায় পাড়ায়, পার্কসার্কাস কিংবা নিউ মার্কেট, এই সময় মম করে খাবারের গন্ধে। আর সেই গন্ধ ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে আরও... কোথায় রয়েছে সেরা...

সকালের শুরু থেকে নির্জলা উপবাস, অতঃপর সূর্যাস্তের পর খাওয়াদাওয়া। সারা বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটাই প্রথা টানা এক মাসের জন্য। মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে পবিত্র মাস হল রমজান। মক্কায় চাঁদ দেখার সময় ধরে পালিত হয় এই উৎসব। মূলত চাঁদের বিভিন্ন পর্যায়ের উপর ভিত্তি করে ইসলামিক ক্যালেন্ডার গণনা করা হয়। সেই মতোই শুরু হয় এই রমজান মাস। রমজান কথাটি এসেছে 'রামিদা' থেকে, এর অর্থ প্রচণ্ড গরম। গ্রীষ্মের প্রবল তাপদাহের মধ্যে এই নির্জলা উপবাস করাকে সংযম হিসেবেই মানেন ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা। তাই এই রমজান মাসকে আত্ম-শৃঙ্খলা এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণের পরীক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা তাকওয়া অর্থাৎ শুভ চেতনা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে বলে মনে করেন তাঁরা। গুরুতর অসুস্থ, বৃদ্ধ, গর্ভবতী মহিলা ছাড়া প্রাপ্তবয়স্ক সব মুসলিমেরই রমজান মাসে রোজা বা উপবাস রাখার নিয়ম। আর এই রোজা ভাঙার সময় যে খাওয়া দাওয়া করা হয় তাকেই বলা হয় ইফতার।

বিভেদের মাঝে মহা মিলনের তত্ত্ব মেলে এই বাংলাতেও। তাই দুর্গাপুজো, কালীপুজোর মতো একই রকম সাজো সাজো রব ঈদ, মহরমেও। ব্যস্ত শহরের বুকে এক টুকরো অন্যরকম আমেজ। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলেই ম ম করে খাবারের গন্ধে। নাখোদা মসজিদ সংলগ্ন জ়াকারিয়া স্ট্রিট, কলুটোলা অথবা নিউ মার্কেট থেকে শুরু করে পার্ক সার্কাস, রাজাবাজার, মেটিয়াবুরুজের বিভিন্ন রাস্তা এই সময়ে সেজে ওঠে ইফতারি খাবারের পসরায়। মুসলিমদের পাশাপাশি হিন্দুদের অনেকেই এই স্বাদের মায়া ত্যাগ করতে পারেন না বিশেষ। রকমারি এই স্বাদ-সম্ভারও জাতধর্মের বেড়া ডিঙিয়ে সর্বস্তরের মানুষের কাছে সমান আদরের হয়ে ওঠে।

হরেক রকম ফল, খেঁজুর, কাজু, কিসমিস প্রভৃতি ড্রাই ফ্রুট, অঙ্কুরিত ছোলা, নানা রকম পকোড়া, স্যালাডের আয়োজনের পাশাপাশি তিলোত্তমার রাজপথে থাকে শীতল সরবতের স্নিগ্ধতাও। উঠতি গরমের সঙ্গে মোকাবিলায় এটাই মোক্ষম দাওয়াই। এমনিতেই খাবারের স্বাদযশে দেশের অন্যান্য জায়গাকে বলে বলে গোল দিতে পারে কলকাতা। খাদ্যপ্রেমী বাঙালির অবশ্য তাতে ষোলো আনাই দায়। হলপ করে বলা যায়, হালিম, লচ্চা সিমোই, কাবাব, ফিরনি থেকে ফালুদা, সবেতেই ছক্কা হাঁকাতে ওস্তাদ এই কলকাতা শহর। কলুটোলার দিক থেকে জাকারিয়া স্ট্রিট, নাখোদা মসজিদের পাড়ায় পাড়ায়, পার্কসার্কাস কিংবা নিউ মার্কেট, এই সময় ম ম করে খাবারের গন্ধে। আর সেই গন্ধ ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে আরও। তাই আজকাল কেবল মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলেই নয়, কলকাতার অমুসলিম এলাকাতেও ইফতারি খাবারের রমরমা।

আরও পড়ুন - ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ স্কুল কলেজেও যে প্রশ্নের সামনে ভারতের পড়ুয়ারা

আসুন একবার ঢু মারা যাক কলকাতার বিশেষ বিশেষ কিছু ইফতারি খাবারের ঠেকে।

ইফতারের ফল -:

ইফতারের খাবার হিসেবে সবচাইতে জনপ্রিয় হল টাটকা তাজা ফল। বসন্ত শেষে গরমের শুরু এই সময়, ফলে মরশুমি ফলে ঠাসা বাজার। বেদনা, আঙুর, তরমুজ থেকে শুরু করে পেয়ারা, কলা, মুসম্বি লেবু, টানা একমাসের রোজা পালনে শরীর চাঙ্গা রাখতে খুবই জরুরি এইসব ফল। কলকাতার বড়বাজার সংলগ্ন মেছুয়া বাজার হল সবথেকে বড় ফলের পট্টি। এমনিতেই সারা বছর এখানে হরেক রকম ফল মেলে। খুচরো অথবা পাইকারি সব প্রকারেই। তাছাড়া আশেপাশেই মুসলিম এলাকা ফলে, ইফতারি ফলের জোগানও এখানে সবচাইতে বেশি।

ইফতারের শরবত -:

একেই এই সময় বাতাসের পারদ ঊর্ধ্বমুখী ফলে গরমের সঙ্গে মোকাবিলা করতে জবাব নেই শরবতের। আর কলকাতার শরবতের সেরা ঠিকানা বলতেই প্রথমে মনে আসে প্যারামাউন্ট এর কথা। কলেজস্ট্রিটের গলিতে এক চিলতে খাস শরবতের ঠেক এটাই। স্বাদে এবং ঐতিহ্য চিরন্তন পরম্পরা রক্ষায় প্যারামাউন্টের জবাব নেই। এছাড়াও এই সময় পার্ক সার্কাস, মেটিয়াবুরুজ অথবা জাকারিয়া স্ট্রিট সংলগ্ন মুসলিম অধুস্মিত অঞ্চলে ছোট বড় শরবতের পসরা বসে। আর এ ব্যাপারে লাল রুহআবজা শরবত তো একেবারেই সেরা। বরফ জলে ঠান্ডা লাল শরবত শান্তি দেয় একটানা নির্জলা উপবাসের। সঙ্গে থাকে খাসের শরবতও।

বখরখানি ও রমজান স্ন্যাক্স -:

কলুটোলা থেকে বলাই দত্ত স্ট্রিট ধরে ডাইনে বেঁকে জাকারিয়ার মুখে এগোতেই স্পেশাল বাখরখানির ঠিকানা। ৮০ টাকার শুকনো, ফুরফুরে, প্রকাণ্ড গোলাকার দুধে ভিজিয়ে ব্রেকফাস্টের মাওয়াঠাসা রুটি। টানা ১০ দিন পর্যন্ত তাজা থাকে এই বাখরখানি। তবে শুধুই বখরখানি নয়, রমজানের স্ন্যাক্স হিসেবে স্পেশ্যাল খাস্তা বিস্কুট পাকিজা, মাকুটি বা মাংসের ঝোল দিয়ে খাওয়ার মিষ্টি রুটি শিরমল, দিলশাদ কবাবির খিরি কাবাব, সুতি কাবাব অথবা কলুটোলার চিকেনের পেয়ারে কবাব, এইসবের চাহিদাও কিছু কম নয়। যদিও শুধু বছরে এই একটা মাস নয়, খাবারের জনপ্রিয়তা এতটাই তুঙ্গে যে বর্তমানে বছরভর এখানে মেলে এইসব। রমজান মাসে কেবল তার চাহিদা বেড়ে যায় কয়েক গুণ! এছাড়াও ইফতারি পদে যোগ দেয় মাংসের কুচিভরা সামোসা অর্থাৎ বাংলায় যাকে বলে সিঙ্গাড়া, দইবড়া, দুধেল সরের প্রলেপ জড়ানো রমজানি শাহি টুকরা ইত্যাদি। এমনকী পকোড়া অথবা খাস বাঙালি পদ ঘুগনির চাহিদাও থাকে তুঙ্গে।

কলকাতার বিরিয়ানি -:

ভিন রাজ্য থেকে এসেছে ঠিকই, তবে কলকাতার শহর অথবা পার্শ্ববর্তী শহরতলীর পথ ঘাটের দিকে চোখ রাখলে এই পদকে মোটেই আর ভিন রাজ্যের মনে হয় না। লাল রঙের শালুতে ঢাকা মস্ত বড় হাঁড়ির চল এখন পথে-ঘাটে সর্বত্র। হায়দ্রাবাদ, দিল্লির স্বাদকে কয়েক গোল দেয় কলকাতার বিরিয়ানি। সারাবছরই এর চাহিদা তুঙ্গে। অনলাইন ফুড ডেলিভারি অ্যাপের কল্যাণে তা আরও বেড়েছে বর্তমান সময়ে। রমজানের মরসুমে জাকারিয়া স্ট্রিট হোক অথবা কলকাতার জনপ্রিয় আমিনিয়া, আরসালান কিংবা সিরাজ, বিরিয়ানির স্বাদে জাত ধর্মের ভেদাভেদ এমনিতেই ঘুচে যেতে বাধ্য।

আরও পড়ুন - জল, খাবার কিচ্ছু নয়! টানা একমাস কঠোর নিয়ম, রমজান মাসের তাৎপর্য জানুন

ফিরনি -:

ফিরনিতেই জমে যায় শেষপাত। আর্সেলান, আমিনিয়া থেকে শুরু করে জাকারিয়া স্ট্রিটের বেনামী কোনও দোকান, ইফতারি স্বাদ আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিতে ফিরনির যোগান সর্বত্রই। আর তার ওপর যদি হয় বিশেষ ফ্লেভার, তবে তো জমে ক্ষীর রমজান মাসের ফিরনির স্বাদ।

হালিম -:

কয়েক বছর আগেও হালিম কাকে বলে তা জানত না গ্রামবাংলার সাধারণ মুসলিম পরিবার। অথচ এই বিশেষ পদের জন্যই এখন বছরভর রমজানের অপেক্ষায় থাকে গোটা কলকাতা শহর। শহরতলীতেও এখন ছড়িয়ে গিয়েছে এই স্বাদ। নানা ধরনের ডালের মিশেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাংস ফুটিয়ে যে থকথকে ‘সুপ’ তৈরি হয়, সেটিই হল হালিম। আগে স্রেফ শহরের মুসলিম অধ্যুষিত বা কিছু পাঁচমিশেলি মহল্লায় হালিমের দেখা মিলত। এখন অবশ্য হাতিবাগান, নাগেরবাজার, অজয়নগরের মতো অ-মুসলিম প্রধান এলাকাতেও হালিমের রমরমা।

অর্থাৎ গোটা ছবিটা একসঙ্গে পরপর সাজালে একটা কথা খুব সহজেই বোঝা যায় যে কলকাতা শহরের আলাদা করে কোনও এলাকাকে আর মুসলিম এলাকা বলা চলে না। অন্তত খাবারের দুনিয়াতে জাতপাতের এই বিভেদ নিয়ে কেউই খুব একটা তোয়াক্কা করে না। ফলত খাস হিন্দু পরিবারের অনেকেই চেখে দেখেন রমজানের বিশেষ স্বাদ। অফিস কলিগ অথবা বন্ধুদের ইফতার পার্টিতে যোগও দেন। আর তাই অচিরেই কলুটোলা, জাকারিয়া স্ট্রিট, মেটিয়াবুরুজ অথবা পার্ক সার্কাস ছাড়িয়ে ইফতারের স্বাদ ছড়িয়ে পড়ে কলকাতার অন্যত্রও। আবারও বিভেদের মাঝে মিলনটুকুই জিতে যায়।

More Articles