এই ট্রেনে চড়তে টিকিট লাগে না! চোখ ধাঁধানো যে পথে চলে দেশের একমাত্র 'ফ্রি ট্রেন'!

Bhakra Nangal Railway: প্রাথমিকভাবে এই স্পেশাল ট্রেনে দশটি বগি থাকলেও এখন বাকি রয়েছে মাত্র তিনটি বগি। এই ট্রেন খুব একটা বেশি জোরে চলে না, কিন্তু তাও প্রতিদিন ৮০০ জন মানুষ এই ট্রেনের মাধ্যমে সফর করেন।

ভারতে প্রায় সাড়ে ১২ লক্ষ মানুষ ট্রেনের মাধ্যমে যাতায়াত করেন এবং নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছান। ভারতের প্রায় প্রত্যেকটি কোণে ভারতীয় রেলওয়ের নেটওয়ার্ক রয়েছে। শুধু গন্তব্যে পৌঁছনোই নয়, প্রতিদিন এই রেলওয়ের মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষ নিজেদের রুটি রুজির জোগাড় করে থাকেন। ট্রেনের হকার থেকে শুরু করে, কম্পার্টমেন্টের বিক্রেতা, সকলেরই আয় ভারতীয় রেলওয়ের মুখাপেক্ষী। ভারতীয় রেলের মতো সস্তা যাতায়াতের মাধ্যম হয়তো দেশে আর কিছুই নেই। খুব কম টাকায় ট্রেন সফর সম্ভব, ন্যূনতম টাকার টিকিট কেটেই নিজের গন্তব্যের কাছে পৌঁছে যাওয়া সহজতম পরিবহনের মাধ্যম। কিন্তু আপনি কি জানেন, ভারতে এমন একটি ট্রেন রয়েছে, যাতে সফর করতে আপনাকে কোনও খরচ করতে হয় না! হ্যাঁ, ভারতে এমন একটি ট্রেন রয়েছে, যাতে যাতায়াত করা একেবারেই ফ্রি। অর্থাৎ আপনি যদি চান তাহলে এই ট্রেনে বিনা পয়সায় উঠতে পারেন। এই ট্রেনে না কোনও টিকিট চেকার থাকেন আর না তো এই ট্রেনে উঠতে কেউ বাধা দেন। আর এই ট্রেন যে নতুন নতুন সার্ভিস দেওয়া শুরু করেছে তেমনও নয়। বিগত ৭৪ বছর ধরে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ এই ট্রেনের মাধ্যমে যাতায়াত করে থাকেন। তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক ভারতের একমাত্র ফ্রি ট্রেনের হাল হকিকত।

পঞ্জাব এবং হিমাচল প্রদেশের সীমান্ত দিয়ে চলাচল করে ট্রেন

ভারতীয় রেলের এই বিখ্যাত ট্রেনটির নাম 'ভাকরা-নাঙ্গাল ট্রেন'। এই ট্রেন পঞ্জাব এবং হিমাচল প্রদেশের সীমান্ত দিয়ে চলাচল করে থাকে। অনেকেই হয়তো ভাকরা-নাঙ্গাল বাঁধের ব্যাপারে জানেন। সেই বাঁধের সঙ্গে এই ট্রেনের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। ভাকরা বিয়াস ম্যানেজমেন্ট বোর্ড (BBMB) দ্বারা নাঙ্গাল এবং ভাকরার মধ্যে এই ট্রেন চালানো হয়ে থাকে। যদি আপনি বিশ্ববিখ্যাত ভাকরা-নাঙ্গাল বাঁধ কখনও দেখতে যান, তাহলে আপনি এই ট্রেনে বিনামূল্যে সফর করতে পারবেন।

ভারতীয় রেলের ওয়েবসাইট অনুসারে, ১৯৪৮ সালে এই ট্রেনের যাত্রা শুরু হয়, যে সময় ভাকরা-নাঙ্গাল বাঁধের নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই সময় এই দুই এলাকার মধ্যে যাত্রী পরিবহনের জন্যই এই ট্রেনের যাত্রা শুরু করা হয়। আসলে সেই সময় ভাকরা এবং নাঙ্গালের মধ্যে পরিবহনের কোনও মাধ্যম ছিল না। তাই সেই সময় এই ট্রেনের প্রয়োজন পড়ে এবং সেই কারণেই ভারতীয় রেল এই ট্রেনের রুটটি চালু করে। বাঁধের মেশিনারি এবং মানুষজনের যাতায়াতের জন্যই প্রাথমিকভাবে এই ট্রেনের যাত্রা শুরু হয়। তারপর ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় ভারতীয় রেলওয়ে এই সার্ভিস চালিয়ে যায়।

প্রথমে চলত স্টিম ইঞ্জিনে

এই ট্রেন যে সময় চালু হয়েছে, সেই সময়ে স্টিম ইঞ্জিনের প্রচলন ছিল ব্যাপক। সেই কারণে, প্রথম পাঁচ বছর এই ট্রেন সম্পূর্ণরূপে স্টিম ইঞ্জিনের মাধ্যমে চালানো হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালে, আমেরিকা থেকে তিনটি ডিজেল ইঞ্জিন নিয়ে আসা হয়। এরপর সেই ডিজেল ইঞ্জিন ওই ট্রেনে যোগ করে ট্রেনটিকে ডিজেলের মাধ্যমে চালানো শুরু হয়। এগুলির মধ্যে একটি ইঞ্জিন এই মুহূর্তে খারাপ হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে দু'টি ইঞ্জিন চালু থাকার কারণে এখন এই রুটে কেবলমাত্র দু'টি ট্রেন চালানো হয়।

প্রতিদিন ৮০০ যাত্রীর সফর

১৯৫৩ সালে ভারতীয় রেলওয়ে এই ট্রেন ইঞ্জিনের পাঁচটি মডেল নিয়ে এসেছিল। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এই ট্রেন একই রকম ভাবে চলছে। ৬০ বছর পুরনো ইঞ্জিন দিয়ে এই এখনও এই ট্রেন চালানো হয়। পুরনো হয়ে গেলেও এই ট্রেন এখনও পরিষেবা দিয়ে চলেছে সকলকে এবং এটাই এই ট্রেনের সব থেকে ভালো বিষয়। শিবালিক পার্বত্য এলাকার উপর দিয়ে এই ট্রেন চলাচল করে। তাই এই ট্রেনের যাত্রীসংখ্যা মোটামুটি ভালোই। এই ট্রেনের আসনগুলি ঔপনিবেশিক আমলের কথা মনে করিয়ে দেবে। ট্রেনের প্রতিটি কোচ অনন্য এবং এই সমস্ত কোচ তৈরি হয়েছিল করাচিতে। প্রাথমিকভাবে এই স্পেশাল ট্রেনে দশটি বগি থাকলেও এখন বাকি রয়েছে মাত্র তিনটি বগি। এই ট্রেন খুব একটা বেশি জোরে চলে না, কিন্তু তাও প্রতিদিন ৮০০ জন মানুষ এই ট্রেনের মাধ্যমে সফর করেন। ডিজেলের মাধ্যমে চলার কারণে, এই ট্রেন চালানোর জন্য ভারতীয় রেলকে একটু বেশি খরচও করতে হয়। প্রতি ঘণ্টায় ১৮ থেকে ২০ লিটার পর্যন্ত ডিজেল খরচ করে ভাকরা নাঙ্গাল রেলওয়ে। একটি সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় ভাকরা-নাঙ্গাল রেলওয়ের ড্রাইভার আত্মারাম জানান, এই ট্রেনের রুটে তিনটি টানেল রয়েছে এবং সর্বমোট ছয়টি স্টেশন রয়েছে। প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে এই ট্রেন চালানো হয়। এই ট্রেন খুব একটা বেশি দেরিও করে না।

আরও পড়ুন- বিখ্যাত এই বাঙালির চিঠিতেই ভারতে এল রেল? যে তথ‍্য অনেকেরই অজানা

কোন সময় ছাড়ে ট্রেন?

প্রতিবেদন অনুযায়ী, সকাল ৭:০৫ নাগাদ এই ট্রেনটি নাগাল্যান্ড রেলওয়ে স্টেশন থেকে ছাড়ে এবং সকাল ৮:২০-তে এটি ভাকরা রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছায়। ওই একই দিনে আবার দুপুর ৩:০৫ নাগাদ নাঙ্গাল রেলওয়ে স্টেশন থেকে ছেড়ে বিকেল ৪:২০ নাগাদ এটি ভাকরা রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছয়।

গৌরব এবং ঐতিহ্যের জন্য জনপ্রিয়

এই ট্রেনে সাধারণত এই অঞ্চলের বহু গ্রামের মানুষ সফর করে থাকেন। তার পাশাপাশিই ভাকরা-নাঙ্গাল প্রজেক্টের কর্মচারী, স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, বেশ কিছু পর্যটক এই ট্রেনের মাধ্যমে সফর করে থাকেন। ২০১১ সালে ভাকরা-নাঙ্গাল পরিযোজনের ম্যানেজমেন্ট সমিতি আর্থিক ক্ষতির কারণে এই বিশেষ ট্রেনটির যাত্রা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে, পরবর্তীকালে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এই ট্রেনটি আসলে যাত্রীদের সুবিধার জন্য নয়, বরং গৌরব এবং ঐতিহ্যের জন্য বেশি জনপ্রিয়। তাই এই ট্রেনের যাত্রা বন্ধ করা কখনই ঠিক সিদ্ধান্ত হবে না। তাই এখনও পর্যন্ত এই ট্রেনের যাত্রা রয়েছে অব্যাহত।

আরও পড়ুন- কোথাও সাজানো বাগান, কোথাও চোখ ধাঁধায় স্থাপত্য! এক নজরে পৃথিবীর সেরা রেল স্টেশনগুলি

বেশ কিছু সিনেমার শুটিংও হয়েছে

ঔপনিবেশিক ভারতের ঐতিহ্য বহন করার পাশাপাশি এই ট্রেনের যাত্রাপথ অত্যন্ত সুন্দর। সেই কারণে বহু হিন্দি এবং আঞ্চলিক সিনেমার শুটিং হয়েছে এই ভাকরা-নাঙ্গাল ট্রেনে। রাজেশ খান্নার সিনেমা চালতা-পুরজার কিছু দৃশ্যের শুটিংয়ের জন্য এই ট্রেন ব্যবহার করা হয়েছিল। তবে হ্যাঁ এই ট্রেন কিন্তু ব্রিটিশ ভারতের ধনী এবং দরিদ্রের বিভাজন স্পষ্ট ভাবে দেখায়। এই ট্রেনে সাধারণত সফর করে থাকেন হেলপার, ফিটার, পাম্প অপারেটর, পেইন্টার, এবং বাঁধে কাজ করা মানুষরা। উচ্চবিত্ত মানুষরা কিন্তু এই ট্রেন ব্যবহার করেন না। তাদের জন্য BBMB বিশেষ বাস এবং জিপ পরিষেবা প্রদান করে থাকে।

কাঠ দিয়ে তৈরি হয়েছে কোচ

এই ট্রেন দেখতে অত্যন্ত সুন্দর এবং এই ট্রেনের ইঞ্জিন পুরনো দিনের ভারতের কথা মনে করিয়ে দেবেই। ১৯২৩ সালে করচিতে এই ট্রেনের কোচ তৈরি করা হয়েছিল। এই ট্রেনে কিন্তু গদিযুক্ত আসন মিলবে না। পুরো কাঠ দিয়ে তৈরি হয়েছে এই ট্রেনের প্রত্যেকটি কোচ এবং সিট। প্রথমে এই ট্রেনে দশটি কোচ ছিল, কিন্তু এখন মাত্র তিনটি বগি রয়েছে। এগুলির মধ্যে একটি কোচ পর্যটকদের জন্য এবং একটি কোচ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। সাধারণ কোচ হিসেবে একটি কোচ রাখা হয়েছে। বিশেষত, ভাকরা বাঁধ তৈরি করার ইতিহাস এবং কীভাবে এই বাঁধ মানুষকে সাহায্য করছে, তা পর্যটকদের কাছে উপস্থাপন করার জন্যই এই ট্রেন চালানো হয়। যদি কোনওদিন ভাকরা বাঁধ দেখতে যান, তাহলে অবশ্যই একবার এই ট্রেনে সফর করবেন।

More Articles