চিতাভস্ম কিনতে শোরগোল পড়ে কলকাতায়! কানাইলালের ফাঁসি যেভাবে শিক্ষা দিয়েছিল ইংরেজদের
Freedom Fighter Kanailal Dutta Death: কোর্টে কানাইলালকে জিজ্ঞাসা করা হল, পিস্তল কোথায় পেয়েছিলে? উত্তরে বললেন,"ক্ষুদিরামের আত্মা পিস্তল দিয়ে গেছে।"
১৯০৮ সালের ১১ অগাস্ট। জেলের ভিতরে গড়া হয়েছিল ১৫ ফুট উঁচু এক ফাঁসির মঞ্চ। দুই দিকে ছিল ২টি খুঁটি। তার উপর একটি মোটা লোহার রড ছিল আড়াআড়িভাবে লাগানো। সেই রডের মাঝখানে মোটা একগাছি দড়ি বাঁধা। তার শেষ প্রান্তে মরণ-ফাঁস। ক্ষুদিরামকে সেই মঞ্চে নিয়ে এসেছিলেন ব্রিটিশ সরকারের চার পুলিশ। ক্ষুদিরাম ছিলেন তাঁদের সামনে। ফাঁসির আগে উপস্থিত আইনজীবীদের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেছিলেন ক্ষুদিরাম। তারপর পিছমোড়া করে বাঁধা হয় দুই হাত। গলায় ফাঁসির দড়ি পরানো মাত্র জল্লাদকে ক্ষুদিরাম প্রশ্ন করেছিলেন, "ফাঁসির দড়িতে মোম দেওয়া হয় কেন?" এই ছিল শহিদের জীবনের শেষ কথা।
ক্ষুদিরাম বসু প্রথম বাঙালি বিপ্লবী, ব্রিটিশের ফাঁসিকাঠে যাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। ১৯০৮-এর ১১ অগাস্ট তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। সেই থেকে ১৯৪৪ এর ২৪ অগাস্ট পর্যন্ত মোট ৪১ জন বাঙালি বিপ্লবীকে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়াতে হয়েছে। এঁদের মধ্যে যাঁর কথা আলাদ করে না বললেই নয় তিনি কানাইলাল দত্ত। সেই সময় পরপর ফাঁসি দেওয়া হয় মুজফ্ফরপুর, আলিপুর, মেদিনীপুর, বরিশাল, ঢাকা, চট্টগ্রাম সিলেট, আম্বালা, বালেশ্বর, মাদ্রাজ এবং দিল্লি জেলে।
ক্ষুদিরামের পরে পরেই ফাঁসির দড়ি গলায় পরেন কানাইলাল দত্ত। আলিপুর বোমা মামলায় অভিযুক্ত সত্যন্দ্রনাথ বসু ও কানাইলাল দত্ত জেলের ভেতর বিশ্বাসঘাতক নরেন গোঁসাইকে খুন করেছিলেন। অভিযুক্ত ২ জনেরই ফাঁসি ঘোষণা হয়েছিল। সত্যেন্দ্রর ফাঁসি হয় ১৯০৮ সালের ২১ অথবা ২৩ নভেম্বর। তখন তাঁর বয়স ছাব্বিশ।
ফাঁসিতে প্রাণ দেওয়া দ্বিতীয় বাঙালি বিপ্লবী কানাইলাল। ১৯০৮ সালের ১০ নভেম্বর। আলিপুর জেলের ফাঁসির মঞ্চে হাজির হয়েছেন সেই তরুণ। হাত বেঁধে বধ্যভূমিতে দাঁড়ানোর পর কালো কাপড়ে মুখ ঢাকতে এগিয়ে এলেন জল্লাদ। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল তরুণের গলা। এ কী করছে! এরকমভাবে ‘মুখ কালো করে’ তো মরতে পারবেন না তিনি। জল্লাদকে বললেন এই কাপড় সরিয়ে রাখতে। এগিয়ে গেলেন সাপের ফণার মতো ঝুলে থাকা দড়িটির দিকে। আহ, শান্তি! দেশদ্রোহীকে শেষ করে এবার মৃত্যুকে বরণ করে নেবেন। ব্রিটিশ পুলিশের চোখের দিকে চোখ রাখলেন কানাইলাল দত্ত। মৃত্যুভয় নেই, সেখানে জ্বলছে আগুন। বিপ্লবের আগুন। লিভার টানলেন জল্লাদ।
আরও পড়ুন- ব্রিটিশকে বোকা বানিয়ে ছদ্মবেশে বিদেশ পাড়ি! বিজ্ঞানে-বিপ্লবে বিস্মৃতপ্রায় শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ
কানাইলালের খবর তখন গোটা কলকাতায় ছড়িয়ে গেছে। একে বঙ্গভঙ্গের জ্বালা, তার উপর এমন বীর বিপ্লবীর ফাঁসি। আর এর মাত্র কয়েক মাস আগেই ফাঁসি হয়েছে ক্ষুদিরাম বসুর। লাখ লাখ মানুষ নেমে এসেছিলেন রাস্তায়। আলিপুর জেল থেকে বের করা হল কানাইলাল দত্তের মরদেহ। শববাহী খাটটি একবার অন্তত ছুঁয়ে দেখতে চায় বাঙালি। জেলের ভেতর বসে রাজসাক্ষীকে হত্যা করা, ব্রিটিশের চোখে চোখ রেখে লড়াই করে যাওয়া— মুখের কথা নাকি! কেওড়াতলা মহাশ্মশানও সেদিন লোকে লোকারণ্য। সবার মুখে একটাই কথা— "কানাই দত্তের জয় হোক"! তারপরেই ঘটে এক অভাবনীয় ঘটনা। দাহকার্য শেষ হওয়ার পর কানাইলালের চিতাভস্ম নেওয়ার জন্য রীতিমতো লড়াই শুরু হয়ে যায়। টাকা দিয়ে লোকজন কিনে নিয়ে যায় সেই ভস্ম। সেখানে ঠিক কতটা কানাইলালের দেহাবশেষ ছিল, তা নিয়ে পরে অনেকেই সন্দেহপ্রকাশ করেছেন। অত ভস্ম একজন মানুষকে দাহ করার পর থাকে নাকি! কিন্তু মানুষের মধ্যে দেশাত্মবোধ, স্বাধীনতার চেতনা এমন পর্যায় পৌঁছে গিয়েছিল যে, কোনওকিছুর খেয়াল করেনি কেউ।
সেদিন তাঁর শবদেহ নিয়ে কলকাতা শহরের বুকে এক জনপ্লাবনের সাক্ষী থেকেছে পুলিশ। পথে লক্ষ লক্ষ মানুষ। তাঁর একে অপরকে ধাক্কা দিয়ে একবার অন্তত শববাহী খাট ছুঁতে চান। চারিদিক "জয় হোক কানাই" ধ্বনিতে আন্দোলিত। আধ ছ'টাক চিতাভস্মের জন্য কোনও কোনও অত্যুৎসাহী পাঁচ টাকা পর্যন্ত দিয়েছিলেন। পুলিশের পদস্থ কর্মচারী এফ সি ড্যালি বলেছিলেন, "কানাইলাল দত্তের চিতাভস্ম বলে কলকাতায় যা বিক্রি হয়েছিল, অনুমান করা হচ্ছে তা চিতাভস্মের প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে পঞ্চাশ গুণ বেশ।"
ইতিহাসের পাতায় এ নিছক কোনও অধ্যায় নয়— কানাইলাল দত্ত নানা রূপে বাংলার বুকে উপস্থিত হয়েছেন। চন্দননগরে নিজের মামার বাড়িতে জন্ম তাঁর, ১৮৮৭ সালে। যেদিন জন্মেছিলেন, সেটি ছিল জন্মাষ্টমীর পুণ্য তিথি। সাধ করে দত্তবাড়ির পরের প্রজন্মের ছেলেটির নাম রাখা হল কানাইলাল। বাবা চুনীলাল সরকারি কাজের সূত্রে ছিলেন বম্বেতে (মুম্বই); সেখানেই ছোটবেলায় চলে যান কানাই। পরবর্তীকালে ১৯০৩ সালে চন্দননগরে ফিরে ভর্তি হন দুপ্লে কলেজে। সেই সময় এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিই তাঁর জীবনে মস্ত প্রভাব ফেলে। যার মূলে ছিলেন এখানকারই এক অধ্যাপক চারুচন্দ্র রায়। তাঁর কাছ থেকেই বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন কানাইলাল। ধীরে ধীরে বাংলার বিপ্লবের মানচিত্রে ঢুকে পড়েন তিনি। নরমপন্থী নন, শুরু থেকেই তিনি ছিলেন লড়াইয়ের পক্ষে। ইংরেজদের তাড়াতে গেলে বন্দুক-বোমা ছাড়া গতি নেই। তাঁদের মনে ভয় ঢোকাতে হবে, দেখিয়ে দিতে হবে ভারতীয়দের শক্তি, বিশ্বাস করতেন কানাই।
আরও পড়ুন- ‘বন্দে মাতরম’ বলে উঠলেন পুলিশের গাড়িতে, কেমন ছিল ক্ষুদিরামের জীবনের শেষ কয়েক ঘণ্টা?
যুগান্তরে যোগ দেওয়ার পর একবার কেবল ম্যালেরিয়া কাবু করেছিল তাঁকে। নয়তো হার মানার ছেলেই নন কানাইলাল। পুরী থেকে সুস্থ হয়ে কলকাতায় ফেরার পর আবার শুরু করেন বিপ্লবের কাজ। হেমচন্দ্র দাসের কাছে শিখছেন বোমা তৈরির কৌশল। এমন সময় লর্ড কার্জন বাংলার উপর দিয়ে ছুরি চালালেন। ভাগ করে দিলেন পুরো প্রদেশটাকে যাতে বাঙালিদের শিরদাঁড়া ভেঙে পড়ে। এখনও মুখ বন্ধ করে থাকবে মানুষ? দল বেঁধে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল মানুষ। এই সময় কানাইলাল দত্তদের আড্ডা ছিল ১৫ নম্বর গোপীমোহন দত্ত লেনের বাড়িতে। হঠাৎই সেই বাড়িতে পা পড়ল পুলিশের। বন্দুক, বোমা বাজেয়াপ্ত তো হলই, সেইসঙ্গে গ্রেফতার হলেন কানাইলাল দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত-সহ আরও বেশ কিছু বিপ্লবী। শুরু হল বিখ্যাত আলিপুর বোমা মামলা। বাবার পরামর্শে ব্রিটিশদের হয়ে রাজসাক্ষী হয়েছিলেন নরেন গোঁসাই। ১ সেপ্টেম্বর নরেনকে হত্যা করে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি দিলেন কানাইলাল ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু। এর অপরাধে মৃত্যুদণ্ড।
১০ নভেম্বর ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশদের প্রতি কানাইলাল ছুঁড়ে দিয়েছিলেন কটাক্ষ। মরতে ভয় পান নাকি কানাইলাল! এমনকী আইনি সাহায্যও নেননি। উচ্চতর আদালতে আবেদনের প্রসঙ্গ তোলা হলে বলেছিলেন, "দেয়ার শ্যাল বি নো অ্যাপিল"। পরে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছিলেন, যাওয়ার আগে Shall আর Will-এর ব্যবহারটা কানাই বুঝিয়ে দিয়ে গেল! কোর্টে কানাইলালকে জিজ্ঞাসা করা হল, পিস্তল কোথায় পেয়েছিলে? উত্তরে বললেন,"ক্ষুদিরামের আত্মা পিস্তল দিয়ে গেছে।" শোনা যায় কাঁঠালের মধ্যে পিস্তল আনানো হয়েছিল।
মৃত্যুর পরেও যাতে তাঁর বিপ্লবী জীবন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভূমিকা পালন করতে পারে তাই তিনি শেষ ইচ্ছা হিসেবে বলেছিলেন, "আমার মৃতদেহ নিয়ে যেন শোক না করা হয়, যেন শোভাযাত্রা হয়।" ১০ নভেম্বর সেন্ট্রাল জেল থেকে কেওড়াতলা মহাশ্মশান পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য! বীরের শবদেহের শোভাযাত্রায় পা মেলায় শহর কলকাতা। বিপ্লবীকে ফাঁসি দিয়ে যে বিপ্লবকে হত্যা করা যায় না তার প্রমাণ পেয়েছিল ব্রিটিশ শাসকরা।