জন্ম থেকেই ছিল 'ইংরেজ ঠেঙানোর শখ'! এই বাঙালি বিপ্লবী আজ বিস্মৃতপ্রায়
Siliguri Corridor: পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে অসমের সংযোগ তৈরির এক পরিকল্পনা করেছিলেন সেই বিপ্লবী।
যদি এখনই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হয় সামরিক দিক থেকে ভারতের কোন কোন অঞ্চল বিপদসংকুল? অনেকেরই মাথায় প্রথমেই আসবে লাইন অব কন্ট্রোল, মানে ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত অথবা লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলের নাম। তবে আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও রয়েছে এমন এক সংবেদনশীল অঞ্চল যার গুরুত্ব পূর্বে উল্লেখিত এলাকাগুলির থেকে কোনও অংশে কম নয়। সর্বনিম্ন, মাত্র ২০ কিমি প্রস্থের শিলিগুড়ি করিডোরের কথাই হচ্ছে। আকৃতির কারণে একে চিকেন'স নেক নামেও অভিহিত করা হয়। আপাত নিরীহ অথচ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এই করিডোরের মাধ্যমেই উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বাকি ভারতের সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়। এর দুইপাশে নেপাল ও বাংলাদেশ এবং উত্তরে ভুটান অর্থাৎ মোট তিনটি বিদেশি রাষ্ট্রের উপস্থিতি রয়েছে। শত্রুর নজর থেকে এই করিডোরকে বাঁচাতে সেনাবাহিনীর দাপটও এই অঞ্চলে বেশি। এছাড়াও মায়ানমারের সঙ্গে ৪৮৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ের কালাদান রোড প্রজেক্টের মাধ্যমে মিজোরামের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে বিকল্প পথেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে এক অধুনা বিস্মৃত বাঙালি বিপ্লবীই রয়েছেন এ গল্পের গোড়ায়। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে অসমের সংযোগ তৈরির এক পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। সেই পরিকল্পনা দিনের আলোর মুখ দেখলে চিকেন'স নেক সমস্যার হয়তো সৃষ্টিই হতো না।
বিস্মৃত সেই বিপ্লবী হলেন সুনীল কুমার গুহ। অবিভক্ত বাংলার রংপুর জেলায় জন্ম। এই বাঙালি বিপ্লবী তাঁর জন্মতারিখ সম্পর্কে একেবারে নিখুঁত তথ্য না দিলেও এইটুকু নিশ্চিত করে বলে গিয়েছেন যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সেই দিনটি এক অন্যতম বিশেষ দিন। সেদিনই নাকি জার্মানদের হাতে ইংরেজরা বেশ ভালোরকম বিপর্যস্ত হয়েছিল। নিজের লেখা গ্রন্থে তিনি রসিকতা করে এও লিখেছেন, একদম ছোটবেলায় যখন তিনি স্বাধীনতার অর্থও ভালোভাবে বুঝতে শেখেননি তখন থেকেই তাঁর মধ্যে যে প্রবল 'ইংরেজ ঠেঙানোর' শখ অন্তর্নিহিত রয়েছে সেটিও নাকি ওই ইংরেজদের নাকাল হওয়ার তিথিতে জন্মানোর ফলেই সম্ভব হয়েছে। পরিণত বয়সে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদানকালীন কংগ্রেসের সংস্পর্শে থাকলেও দেশের 'শত্রু' ব্রিটিশদের সঙ্গে নরমপন্থী আন্দোলনের মাধ্যমে 'আপোস' করাকে তিনি কোনওদিনই বিশেষ সুনজরে দেখেননি। সুনীল লিখেছেন,
"ইংরেজকে দেশ থেকে তাড়াবও,আবার তাদের সঙ্গে একটু প্রেম করব, তার বিপদে সহানুভূতি জানাব, তার দুঃসময়ের সুযোগ নেব না- এ সব যেন কেমন কেমন লাগত- যেন একটু ঢং ঢং মতো... ইংরেজকে তাড়াতে হয় ঠেঙা দাও, তাকে বিপদে ফেল, তার বিপদের সুযোগ নিয়ে তাকে লাথি মার। ক্ষমতায় না কুলোয় তার শত্রুর সাথে মিতালি কর, নিজে শক্তি সঞ্চয় কর, তারপর ইংরেজের দুর্যোগকে নিজের সুযোগ জেনে একবার মার জোয়ান হেঁইও বলে লাগাও ধাক্কা।"
তিনি মনে করতেন এটিই স্বাধীনতা অর্জনের সনাতন পথ। শঙ্করাচার্য ও স্বামী বিবেকানন্দের দেখিয়ে দেওয়া পথকে পাথেয় করেছিলেন সুনীল। তমগুণে আচ্ছন্ন জাতিকে রজোগুণের পথে নিয়ে গেলেই উন্নতি সম্ভব! ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে স্বামীজির দেখানো এই পথের উপর সে সময়ের অন্যান্য বিপ্লবীদের মতো তিনিও প্রবলভাবে ভরসা রাখতেন। নিজের ভালোমন্দের ভাবনা ছেড়ে ভারতবর্ষের মুক্তি, ভারতবর্ষের মঙ্গল তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।স্বাধীনতার প্রাক্কালে ভারত ভেঙে দুইপ্রান্তে দুই ভূখণ্ড যখন পাকিস্তানে যাবে এমনটা নিশ্চিত, ঠিক সেই সময়ে তিনি দেশভাগের ক্ষত যতখানি কম করা যায় তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। দেশ যেহেতু ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হচ্ছে তাই রংপুর জেলা মুসলমান প্রধান হওয়ায় সেটি যে পূর্ববঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হবে তাই স্বাভাবিক। তাঁর জন্মস্থান পাকিস্তানের অংশ হবে এ মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। সেই সময় বাংলা থেকে অসম যাওয়ার জন্য যে রেলপথ ছিল বড় ভরসা, তার কিছু অংশ রংপুরের মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল। মনে রাখতে হবে, কোচবিহার তখন ছিল দেশিয় রাজ্য। সেই সময়ে অসমের সঙ্গে বাকি ভারতের সরাসরি যোগাযোগের আর কোনও রাস্তা ছিল না। পূর্ববঙ্গের অংশ হতে চলা চট্টগ্রাম বন্দর বা ব্রহ্মপুত্র নদের জলপথে যোগাযোগেরও কোনও উপায় ছিল না।
আরও পড়ুন- বাংলা ভুলেছে তাঁকে, অথচ তিনি না থাকলে তৈরিই হতো না পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্র!
এমতাবস্থায় তিনি রংপুরের মধ্যে দিয়ে যাওয়া সেই রেললাইনের উত্তরের রংপুর ও দিনাজপুরের কিছু মুসলিম প্রধান থানা পশ্চিমবঙ্গের ভাগে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করেই এই দুরূহ সমস্যা সমাধানের শেষ চেষ্টা করতে উদ্যত হলেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতি আস্থা রাখা দেশ ধর্মের ভিত্তিতে দেশ বিভাজনের পরেও কোনওদিন অন্য ধর্মকে দূরে ঠেলে দেবে না, বিশ্বাস ছিল বিপ্লবী সুনীলের। তাছাড়া, তিনি লক্ষ্য করলেন, দেশভাগের পরেও কয়েক কোটি মুসলিম ভারতবর্ষেই রয়ে গেলেন। তাই বাংলা-অসম রেলপথের উত্তরের কয়েকটি মুসলিম প্রধান থানা ভারতে থেকে গেলেও তাতে কারও আপত্তি থাকতেই পারে না। তার থেকেও বড় কথা, দেশের অঙ্গছেদ কোনওদিনই সঠিক কাজ বলে বিবেচিত হতে পারে না। এই কাজকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রয়োজনীয় মানচিত্র ও সংখ্যাতত্বের কাগজ নিয়ে প্রথমেই তিনি এলেন কলকাতায়। দেখা করলেন তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সুরেন ঘোষ, আচার্য কৃপালনীর মতো মানুষদের সঙ্গে। তাঁর প্রস্তাব প্রশংসিত হলো ঠিকই, তবে তাঁকে এই বিষয়ে আশার আলো কেউই দেখাতে পারলেন না। সুরেন ঘোষ তাঁকে পরামর্শ দিলেন, এই বিষয়ে অসমে গিয়ে সেখানকার প্রাদেশিক সরকারকে এই প্রস্তাব দিলে হয়তো কাজের কাজ হতে পারে। গুয়াহাটি গেলেন সুনীল। সেখানে পৌঁছে বহু বিশিষ্টজনের সামনে প্রস্তাবটি পেশ করলেন। শিলংয়ে গিয়ে দেখা করলেন অসমের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী গোপীনাথ বরদলৈর সঙ্গে। বরদলৈ তাঁর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় নথি নিয়ে তাঁকে কথা দেন অতি গুরুত্বপূর্ণ এই প্রস্তাবটি তিনি দিল্লিতে উত্থাপন করবেন। সুনীল অবশ্য থামলেন না। জনমত গঠনের লক্ষ্যে ঘুরে বেড়ালেন অসমের জেলায় জেলায়।
অসমের নানা প্রান্তে যত সংগঠন রয়েছে তাদের দ্বারা বা নিজেই সচেষ্ট হয়ে তাদের নামে রেললাইনটি ধরে সীমানা নির্ধারণের দাবি জানিয়ে কংগ্রেসের নেতাদের ও বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটনের কাছে টেলিগ্রাম পাঠাতে লাগলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি বরদলৈর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলেন দিল্লিতে বিষয়টি উত্থাপন করা হলেও এ বাস্তবের মুখ দেখবে না। সম্ভাব্য সীমানা দিল্লিতে আগে থেকেই নির্ধারণ করা হয়ে গিয়েছে। ভারতের বহির্বিশ্বের বাণিজ্যে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে যে অসমের স্থান পশ্চিমবঙ্গের পরেই, সেই জায়গার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের ব্যবস্থা না রেখে সীমানা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে থাকা তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি।
কুখ্যাত দেশভাগের পালাও সাঙ্গ হলো। নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে চাইলেন না সুনীল। কষ্ট করেই তিনি রয়ে গেলেন পাকিস্তানে। ছোট ছোট শিশুদের পড়ানোরর উদ্দেশ্যে নিজের বাড়িতেই একটি স্কুল গড়লেন। আর যুগের পর যুগ, চিকেন নেক হয়ে রইল নিরাপত্তার কাঁটা। সে কাঁটা উগরানোও গেল না, গেলাও সম্ভব হলো না।
তথ্যসূত্র:
স্বাধীনতার আবোল তাবোল- সুনীল কুমার গুহ, যুগানুশীলন সাহিত্য সংঘ