সিনেমা বানাতে লাগে কেবল মহিলা এবং বন্দুক, কেন একথা বলেছিলেন জঁ লুক গোদার

Jean-Luc Goddard: কখনও আপস করেননি নিজের সিনেমা-দর্শনের সঙ্গে।

আধুনিক সিনেমার ইতিহাসে একটা বড় যতিচিহ্ন পড়ল আজ। ৯১ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন সিনেমার রাজপুত্র জঁ লুক গোদার। ফরাসি নবতরঙ্গের অন্যতম প্রাণপুরুষ গোদার সিনেমার ইতিহাসে জন্ম দিয়েছেন নতুন চিত্রভাষা। নিজেই ফর্ম তৈরি করেছেন, নিজেই পরবর্তীকালে নিজের সিনেমায় ভেঙেছেন সেই ফর্ম।

কাইয়ের দু সিনেমা
১৯৩০ সালে ৩ ডিসেম্বর ফ্রান্সে জন্ম গোদারের। মাত্র চার বছর বয়সে যুদ্ধবিধ্বস্ত ফ্রান্স থেকে পরিবারের সঙ্গে সুইৎজারল্যান্ডে চলে যান গোদার। জেনেভা লেকের ধারেই কেটেছে গোদারের শৈশব ও কৈশোর। যুদ্ধ থাকলে যুবক গোদার ফিরে যান প্যারিসে। সেখানে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরে ভর্তি হন। কলেজে পড়াকালীনই সিনেমার প্রতি ভালবাসা ও উৎসাহ তৈরি হয় গোদারের। তরুণ গোদারের সঙ্গে আলাপ হয় প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক ও তাত্ত্বিক আন্দ্রে বেঁজে-র। আন্দ্রে বেঁজে-র পত্রিকা 'কাইয়ের দু সিনেমা'-কে ঘিরে আড্ডা বসত গোদার, ত্রুফো, অ্যাগনেস ভার্দা, ক্লদ শ্যাব্রল, জাক রিভিত্ত-সহ আরও অনেকের, যাঁরাই পরবর্তীকালে হবেন ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের রূপকার। সেই সময় থেকেই সিনেমার নতুন ভাষা নির্মাণের পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন গোদার।

book cover

'কাইয়ের দু সিনেমা' পত্রিকার প্রচ্ছদ

কেরিয়ারের শুরুতে পাঁচের দশকের শেষ দিকে গোদার প্রথমে তৈরি করেন কিছু শর্ট ফিল্ম। ১৯৫৯-এ মুক্তি পাচ্ছে পৃথিবীর চলচ্চিত্র-ইতিহাসের অন্যতম মাইলফলক 'ব্রেথলেস'। একবার সিনেমার প্রসঙ্গে গোদার লিখেছিলেন, "All you need to make a film is a girl and gun." ব্রেথলেসের 'গান অ্যান্ড দি গার্ল'-এর ব্যবহার বদলে দিয়েছিল পৃথিবীর চলচ্চিত্রভাষা। খুব সামান্য আয়োজনে প্যারিসের রাস্তায় রাস্তায় হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরায় শুটিং হয়েছিল 'ব্রেথলেস'-এর। একদিনের মধ্যে লেখা 'ব্রেথলেস'-এর চিত্রনাট্যও খুলে দিয়েছিল বিশ্ব সিনেমার এক নতুন দরজা। ব্রেখটের ভক্ত গোদার ব্রেখটিয়ান ট্রিটমেন্টকে জুড়ে দিয়েছিলেন সিনেমার শরীরে। জন্ম হয়েছিল জাম্পকাটের।

Breathless

'ব্রেথলেস' ছবির একটি দৃশ্য

ফরাসি রাজনীতি ও গোদার
তার পরের ছবি থেকেই তাঁর ছবি একদম সরাসরি রাজনৈতিক। ফরাসি সরকারের অত্যাচারের জীবন্ত দলিল তাঁর 'Le Petit Soldait'। এই ছবিতেই গোদারের ছবিতে আত্মপ্রকাশ করেন বিখ্যাত ফরাসি অভিনেত্রী আনা কারিনা। এই আনা কারিনাই পরবর্তীকালে হয়ে উঠছেন গোদারের ছবির অন্যতম 'মিউজ'‌। সিনেমার যাবতীয় ব্যাকরণকে এক নিমেষে ভেঙে ফেলছেন 'মাই লাইফ টু লিভ' ছবিতে। ছবিতে আনা কারিনার গতিবিধিই হয়ে উঠছে ক্যামেরার গতিবিধির নিয়ন্ত্রক। নন ফিকশন সিনেমার ধাঁচা কে ভেঙে ফেলে 'Vivre Sa Vie' হয়ে উঠছে 'সিনেমা ভেরিতে'-র অন্যতম উদাহরণ। জঁ লুক গোদার ও আনা কারিনার যুগলবন্দি উপহার দিচ্ছে একের পর এক ছক ভাঙা সিনেমা। ১৯৬৪-তে মুক্তি পাচ্ছে 'ব্যান্ড অফ আউটসাইডারস ', ১৯৬৫-তে 'অ্যালফাবিল' এবং পৃথিবীর সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম কাল্ট 'পিয়ের লো ফ্যু'। গোদারের আগের সিনেমাগুলোর মতোই 'পিয়ের লো ফ‍্যু'-তে নায়ক ফার্দিনান্দ ও ম্যারিন সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ফোর্থ ওয়াল ভাঙছেন।

Movie Scene

'পিয়ের লো ফ‍্যু' ছবির একটি দৃশ্য

১৯৬৮ সাল। তখন উত্তাল ফ্রান্স। প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতন্ত্রের দাবিতে উত্তাল ছাত্র আন্দোলন। সেই উত্তাপে সরাসরি বামপন্থী ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন গোদার। ১৯৬৮ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসব বন্ধ করার জন্য একদল সমমনস্ক পরিচালকদের নিয়ে তৈরি করেছিলেন একটি দল। প্যারিসের উত্তাল সময়ে দাঁড়িয়ে গোদার বলেছিলেন, "এই অস্থির সময়ে ছাত্রদের পাশে দাঁড়াতে হবে সিনেমা কে।" প্যারিসের সেই অস্থির সময়কে নিয়েই গোদার তৈরি করছেন তাঁর আরেক বিখ্যাত ছবি 'La Chinoise'.

ভিয়েতনামের ওপর আমেরিকার আক্রমণের নিন্দে করে ১৯৬৭ সালে গোদার, ক্রিস মার্কার, অ্যালা রেনে, অ্যাগনেস ভার্দা-র সঙ্গে মিলে তৈরি করছেন 'ফার ফ্রম ভিয়েতনাম' ডকুমেন্টারি।

জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত নিজের কাজ নিয়ে পরীক্ষা করেছেন গোদার। ২০১৪-য় গোদার তৈরি করছেন 'গুডবাই টু ল্যাঙ্গুয়েজ' যেন এক অর্থে চলচ্চিত্রের বিদায় ঘোষণা করছে। এই চলচ্চিত্রের মুখ্য চরিত্রে উঠে আসছে কুকুর। এই ছবির মাধ্যমে গোদার একদিকে যেমন সিনেমার নতুন ভাষা নিয়ে পরীক্ষা করছেন, তেমনই ছবিতে উঠে আসছে সমকালীন সমাজ ও উত্তরাধুনিক পৃথিবী। স্বৈরতন্ত্রের আগ্রাসী রূপ যেমন উঠে আসছে ছবিতে, তেমনই এই উত্তরাধুনিক পৃথিবীকে কটাক্ষ করেছেন গোদার। এই ছবির জন্য কান চলচ্চিত্র উৎসবে জুরি পুরস্কার পাচ্ছেন গোদার।

জীবনের শেষ ছবি 'ইমেজ বুক' দলিল হয়ে থেকে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির ওপর সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার আগ্রাসনের। আমেরিকা-রাশিয়ার দ্বন্দ্ব এবং সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ সবই যেন প্রামাণ্য চরিত্র হয়ে উঠেছে গোদারের শেষ ছবিতে। ২০১৮ সালে সেই ছবির জন্য কান চলচ্চিত্র উৎসবে 'পাম দি ওর' জেতেন গোদার।

৯০ বছর বয়সে সিনেমায় তাঁর অবদানের জন্য অস্কারের মনোনয়ন পান জঁ লুক গোদার। জীবনের প্রথম দিন থেকে আমেরিকার পুঁজিবাদী আধিপত্যের বিরোধী গোদার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন অস্কার। গোদারের মৃত্যুতে পৃথিবীর সিনেমায় শেষ হলো এক বর্ণময় অধ্যায়।

More Articles