ফের হিংসা মাথাচাড়া দিল অশান্ত মণিপুরে, এবার গুলি চালাল সেনাও
Manipur Violence: বৃহস্পতিবার মণিপুরের বিষ্ণপুরে ফের হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। এবার নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে হিংসায় জড়িয়ে পড়ল মেইতেই সম্প্রদায়।
হিংসা, রক্ত, মৃত্যু, দ্বেষ! এরই নাম কি মণিপুর। এক হিংসা শেষ হয় না, নতুন করে মাথাচাড়া দেয় হিংসা। রক্তের নদী বয়ে যায়, সারি সারি মৃতদেহের উপরে তৈরি হয় গণকবরের পরিকল্পনা। সেই নিয়ে আবার শুরু হয় কোন্দল। আবার হিংসা, আবার রক্ত, আবার মৃতদেহের পাহাড়। মণিপুরে মৃত্যু আর কোনও বড় কথা নয়। হিংসা নয়, মেয়েদের উপর অকথ্য অত্যাচার সেখানে খুব সাধারণ ঘটনা। অন্তত গত মাস চারেক ধরে উত্তর-পূর্বের এই ছোট্ট রাজ্যটির দিকে তাকালে তেমনই মালুম হয়।
গত মে মাস থেকে জাতিহিংসায় ছারখার মণিপুর। তুই না মুই- দ্বন্দ্বে রাজ্যের শান্তিশৃঙ্খলা মাথায় তুলেছে মেইতেই ও কুকি, মণিপুরের এই দুই গোষ্ঠি। কুকিরা সেখানে সংখ্যালঘু। তাই তাদের মাথা মাড়িয়ে বেড়ে উঠতে চায় মেইতেই সম্প্রদায়। মাটি ছাড়তে নারাজ কুকিরাও। প্রত্যাঘাত ফিরিয়ে দেয়। কুকি বাড়ি জ্বললে জ্বলে মেইতেই পরিবারও। এই বাড়ির মেয়েকে টেনে হিঁচড়ে গণধর্ষণ করলে প্রত্যুত্তরে ধর্ষণ উপহার দিয়ে আসে অন্য সম্প্রদায়। হিংসা বাড়ে, মৃত্যু বাড়ে। এরই মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায় মণিপুরের মেয়েদের নগ্ন করে প্যারেড করানোর 'ছোট্ট' ঘটনা। ছোট আর ছোট থাকে না তখন। টনক নড়ে সরকারের, শীর্ষ আদালতের। মণিপুর প্রসঙ্গে একদিনের জন্য উত্তাল হয়ে ওঠে দেশ, রাজ্য, রাজনীতি। ব্যাস, ওই এক আধদিন। তারপর রাজা ফের যায় মৃগয়ায়। ভুলে যায়, তার দেশের ছোট্ট এক রাজ্য জ্বলছে, পুড়ছে। ছারখার হয়ে যাচ্ছে জাতি হিংসার নামে।
আরও পড়ুন: কী দিন চেয়েছিলেন আর কী পেলেন মণিপুরের সেই নগ্নিকারা?
গত কয়েকমাসে চরমে উঠেছে মণিপুরের পরিস্থিতি। জাতিহিংসার নামে মারাত্মক অত্যাচার চলেছে মেয়েদের উপরে। আর নারী হিংসার সময় এইসব মেইতেই, কুকি না দেখলেও চলে। নারী শরীর মানেই ইচ্ছামতো 'সবক' শেখানোর জায়গা। আর তা আজ থেকে নয়। কৌরবসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ থেকে ২০০৪ সালে অসম রাইফেলসের সেনাদের হাতে মনোরমার নৃশংস গণধর্ষণ ও খুন। এতটুকু বদলায়নি সমাজ। মণিপুরের পরিস্থিতি দেখে, শুনে, পড়ে স্তম্ভিত দেশ। চিন্তাশীলদের ভ্রূ কুচকোলেও প্রশাসন নির্বিকার, সরকারও। এরই মধ্যে ফের নতুন করে হিংসা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল মণিপুরে। ময়দানে নামল নিরাপত্তাবাহিনী। চলল গুলি, ঝরল রক্ত। এককথায় যুদ্ধক্ষেত্রের রূপ নিল 'মায়েদের দেশ' মণিপুর।
বৃহস্পতিবার মণিপুরের বিষ্ণপুরে ফের হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। যে হিংসার শিকড় আসলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়ে গিয়েছে রাজ্যের শিকড়ে শিকড়ে। এবার নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে হিংসায় জড়িয়ে পড়ল মেইতেই সম্প্রদায়। একটা সময় আফস্পা বিরোধিতায় গর্জে উঠেছিল মণিপুর। যে আইন প্রশাসনের হাতে তুলে দেয় এমন ক্ষমতা, যেখানে কোনও প্রশ্ন ছাড়াই বন্দুকের নল কাড়তে পারে নির্বিকারে প্রাণ। কেড়েওছে। সরকার বদলেছে, নেতা বদলেছে, একাধিক বার জারি হয়েছে রাষ্ট্রপতি শাসন, তবু পরিস্থিতি বদলায়নি মণিপুরে। আর ফের আরও একবার নিরাপত্তা বাহিনীর বন্দুক তাক মণিপুরের উপরে। বৃহস্পতিবার বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে ভারী গুলিবৃষ্টি করতে হল নিরাপত্তাবাহিনীকে। এ দিনের ঘটনায় জখম অন্তত ১৭। এখানেই শেষ নয়। বিষ্ণুপুর জেলার নারানসেনার দ্বিতীয় আইআরবি থেকে ৩০০টির বেশি অস্ত্রশস্ত্র লুঠ করা হয়েছে।আর এ ঘটনা খুব ভালো দিকে নিয়ে যাচ্ছে না মণিপুরকে। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করছেন, ফের রাষ্ট্রপতি শাসনের দিকে চলে যাবে না তো মণিপুর!
স্বাভাবিক ভাবেই এই ঘটনার ইম্ফল পূর্ব ও পশ্চিমে ফের জারি করা হয়েছে কার্ফু। জারি ১৪৪ ধারা। গত মে মাস থেকে ছড়িয়ে পড়া হিংসায় প্রাণ গিয়েছে অসংখ্য মানুষের। সেখানে কুকি জনজাতির মানুষ যেমন রয়েছেন, রয়েছেন মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষও। হিংসান্মোত্ত মণিপুর ছেড়ে পালিয়েছেন অসংখ্য বাসিন্দা। হাসপাতালের মর্গে জমেছে লাশের ভিড়। পরিস্থিতি এমন যে সেই মৃতদেরগুলিকে শনাক্ত করার লোকেরও অভাব এখন মণিপুরে। সেই বেওয়ারিশ লাশেদের সৎকারের জন্য কোনও পদক্ষেপ করেনি সরকার বা প্রশাসন। এর জন্য দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি পর্যন্ত লেখা হয়েছিল মণিপুরের একদল মানবাধিকার দলের তরফে। তবে সেই চিঠির পাতা উল্টে দেখেনি কেন্দ্রীয় সরকার। এই পরিস্থিতিতে কুকি সম্প্রদায়ের ৩৫ জনের দেহ গণকবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলে বেঁকে বসেন বাসিন্দারা। তাঁরা জানান, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলতে চান কুকি সম্প্রদায়ের তরফে সদস্যদল। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফের হিংসা মাথাচাড়া দেয় চূড়াচাঁদপুর ও বিষ্ণুপুর জেলায়।
অবশ্য তার আঁচ শুরু হয়ে গিয়েছিল আগে থেকেই। বুধবার ইম্ফল পশ্চিম জেলার পরিত্যক্ত বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। যদিও বড় কোনও ক্ষয়ক্ষতির খবর নেই। এদিকে, মণিপুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তাল রাজনীতি। সংসদে বিষয়টি তুলে কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থানের তীব্র নিন্দা করেন বিরোধীরা। ইতিমধ্যেই মণিপুর সমস্যার সমাধানে কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপের ব্যপারে জানতে চেয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তবে অন্ধকার কাটছে না মণিপুরে।
আরও পড়ুন: একদিকে রাস্তায় হাঁটছেন নগ্ন মেয়ে, অন্যপ্রান্তে ২ আদিবাসী তরুণীর গণধর্ষণ, চলছেটা কী মণিপুরে?
সেই মে মাস থেকে মণিপুর জুড়ে লাগাতার হিংসায় এখনও পর্যন্ত মৃত্য়ু হয়েছে কমপক্ষে ১৫০ জনের। ইম্ফলের মর্গে পচছে অজ্ঞাতপরিচয় ১১৮টি মৃতদেহ। তাদের শনাক্ত করার লোক পর্যন্ত নেই রাজ্যটিতে। সৎকার তো দূরের। কারণ জাতিহিংসায় জেরবার মণিপুর ছেড়ে পালিয়েছেন দলে দলে মানুষ। তাঁদের কেউ কুকি, কেউ বা মেইতেই। তুলনামূলক ভাবে সংখ্যালঘুদের সংখ্যাই বেশি। বিভিন্ন পড়শি রাজ্যে গিয়ে ভিড় করছেন তাঁরা। মণিপুর কি ক্রমশ মৃতমানুষের দেশ হয়ে উঠছে! হাসপাতালের মর্গ বোধহয় তেমন কথাই বলছে। বধ্যভূমি মণিপুরে শান্তি কবে ফিরবে জানা নেই, তবে সেনাবাহিনীর এই হস্তক্ষেপের পরে অশান্ত মণিপুরে অশান্তি যে আরও বাড়তে চলেছে, সেই আশঙ্কা বোধহয় খুব একটা অমূলক নয়।