হোমার থেকে শেক্সপীয়র, কালের যাত্রায় চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে যে বিখ্যাত বইগুলি
Famous Books Lost Completely : বহু পুরনো সেই বইগুলির মূল পাণ্ডুলিপিই এখন আর পাওয়া যাবে না। এরকমই কিছু বইয়ের দিকে একবার ফিরে দেখা যাক…
পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস কী? একেকজনের কাছে এর একেকরকম উত্তর। কেউ বলবেন টাকা, কারও কাছে হয়তো অন্য কোনও জিনিস। কেউ আবার গাড়ি, বাইকের সৌখিন। কিন্তু বইপোকাদের কাছে ওই দুই মলাটের পৃথিবীই আসল স্বর্গ। অজস্র বই, তার নানা বিষয়, নানা ফর্ম – সবকিছু মিলিয়ে বিশ্বজুড়ে বইয়ের পাহাড় তৈরি হয়েছে। আজ থেকে তো নয়, সেই মিশরীয় সভ্যতার প্যাপিরাসের পুঁথি থেকে বইয়ের গল্প চলে আসছে। ছাপাখানা আবিষ্কার হওয়ার পর তা রীতিমতো বিপ্লবে পরিণত হল। বিশ্বজুড়ে কত মহান সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, কবি এসেছেন, একের পর এক অবিস্মরণীয় বই লিখে ঋদ্ধ করেছেন আমাদের। বিশ্বের পুরনো লাইব্রেরিগুলোতে গেলে সেই ইতিহাসের গন্ধ যেন নাকে এসে ঝাপটা দেয়। বইপোকাদের কাছে সেটাই সব।
কিন্তু কালের স্রোতে কত কিছুই তো হারিয়ে যায়। মানুষের স্মৃতিও তো ক্ষণিকের। আর সভ্যতার হিসেব দেখলে কত হাজার বছর পেরিয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে যেমন অজস্র, হাজার হাজার বই লেখা হয়েছে, তেমনই বিখ্যাত কিছু বই হারিয়েও গিয়েছে। বহু পুরনো সেই বইগুলির মূল পাণ্ডুলিপিই এখন আর পাওয়া যাবে না। এরকমই কিছু বইয়ের দিকে একবার ফিরে দেখা যাক…
হোমারের ‘মার্গিটেস’
অন্ধ কবি হোমারের রচিত ইলিয়াড আর ওডিসির কথা আমরা সকলেই জানি। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্যগুলির মধ্যে অন্যতম হল এই দুটি বই। সেইসঙ্গে ঐতিহাসিকও বটে। কিন্তু হোমারের প্রথম লেখা ইলিয়াড, ওডিসি নয়। বরং গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল হোমারের এই সাহিত্য নিয়ে কিঞ্চিৎ আলো দেখিয়েছেন। তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, হোমারের প্রথম লেখা বইটি হল ‘মার্গিটেস’। দীর্ঘ এই কবিতার নায়কের নামেই লেখার শিরোনাম। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, এই বইটির আজ আর কোনও হদিশ নেই। খ্রিস্টপূর্বাব্দ আনুমানিক ৭০০-তে লেখা এই কবিতাটির মাত্র একটা দুটো লাইনই আজ অবশিষ্ট আছে। বাকিটা কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে।
বাইবেলের হারিয়ে যাওয়া কাহিনি
খ্রিস্টানদের পবিত্র এই গ্রন্থটিকে নিয়েও রহস্য কম নেই। ওল্ড আর নিউ টেস্টামেন্টের মাঝে লুকিয়ে আছে বাইবেলের অজস্র কাহিনি। তার ভেতরের মিথ নিয়ে আজও চর্চা হয়, সিনেমা বানানো হয়। কিন্তু এই বাইবেলেরই বেশকিছু অধ্যায় কার্যত হাওয়া হয়ে গিয়েছে। মানে, সেসবের বিবরণ আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমন ‘বুক অফ দ্য ব্যাটলস অফ ইয়াহওয়েহ’, ‘বুক অফ দ্য ক্রনিকলস অফ দ্য কিংস অফ জুডাহ’ ইত্যাদি ইত্যাদি। মনে করা হয়, অন্তত ২০টিরও বেশি অধ্যায় চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে। বাইবেলের অন্যান্য জায়গায় সেই অধ্যায়গুলির উল্লেখ থেকেই এই বিষয়টি সামনে এসেছে।
ইনভেন্টিও ফরচুনাটা
১৪-শ শতকের কথা। অক্সফোর্ডের এক সন্ন্যাসী একাই হেঁটে হেঁটে উত্তর মেরুর দিকে যাত্রা শুরু করলেন। তারপর সুমেরু অঞ্চলে গিয়ে উপস্থিত হলেন। এই দীর্ঘ যাত্রার বর্ণনা, সেই সময়ের সুমেরুর ভূপ্রকৃতি, পরিবেশ আর অন্যান্য নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে পরে লিখে ফেললেন একটি বই। নাম ‘ইনভেন্টিও ফরচুনাটা’। সেই সময় ব্রিটিশ রাজসিংহাসনে রয়েছেন রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড। ১৩৬০ খ্রিস্টাব্দের আশেপাশে ওই সন্ন্যাসী রাজাকে তাঁর বইয়ের এক কপি উপহার দেন। বাকি পাঁচ-ছয়টি কপি ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ওই সন্ন্যাসী কে, তাঁর নাম কী, সেসব কিচ্ছু জানা যায়নি। একপ্রকার হঠাৎ করেই সেই বইটি হারিয়ে যায়। আজ পর্যন্ত তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেলে হয়তো সেই সময়ের সুমেরু, প্রকৃতি পরিবেশ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা যেত।
উইলিয়াম শেক্সপীয়রের ‘কার্ডেনিও’
তাঁকে বলা হয় পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ও নাট্যকার। ম্যাকবেথ থেকে হ্যামলেট, শেক্সপীয়রের একের পর এক নাটক আজও বিশ্বজুড়ে মঞ্চস্থ হচ্ছে। আধুনিক সময় দাঁড়িয়ে তাঁর নাটককে কীভাবে উপস্থাপিত করা যায়, সেই ভাবনাও জারি রয়েছে। শেক্সপীয়র নিয়ে যারা বিশেষ করে পড়াশোনা করেন, তাঁরা এই ‘কার্ডেনিও’ নাটকটির ইতিহাস সম্পর্কে জানেন। যদি কোনওভাবে এটি পাওয়া যায়, তাহলে সাহিত্যের জগতে একটা চমৎকার ব্যাপার ঘটবে। কিন্তু আফসোস, শেক্সপীয়রের এই নাটকটি আজ পর্যন্ত কোথাও পাওয়া যায়নি।
১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে রাজা প্রথম জেমসের উপস্থিতিতে শেক্সপীয়রের নাট্যগ্রুপ ‘দ্য কিংস মেন’ প্রথমবার এই নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। তিনিই এটি লিখেছিলেন। পরেরদিকে সাহিত্যের গবেষকরা বলেছিলেন, যদি কোনওভাবে ‘কার্ডেনিও’ নাটকটি উদ্ধার করা যায়, তবে তুলনামূলক সাহিত্যের ইতিহাসে একটা বিরাট ঘটনা ঘটবে। শুধু তাই নয়, স্প্যানিশ আর ব্রিটিশ সাহিত্যের ধারা নিয়েও অনেক নিত্যনতুন তথ্য সামনে আসবে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, এখনও অবধি সেটিকে উদ্ধার করা যায়নি।
জেন অস্টিনের ‘স্যান্ডিটন’
১৮১৭ সালের ১৮ জুলাই। মাত্র ৪২ বছর বয়সে মারা গেলেন কিংবদন্তি সাহিত্যিক জেন অস্টিন। তবে মৃত্যুর পর তাঁর বাড়িতে একটি লেখা পাওয়া যায়। ১১টি অধ্যায় তাতে; বাকি লেখা অসম্পূর্ণ। উপন্যাসের চরিত্রটি স্যান্ডিটনে, সমুদ্রের ধারে ঘুরতে যায়। সেখান থেকে একটু একটু করে এগোয় কাহিনি। কিন্তু সেই উপন্যাসটি শেষ করে যেতে পারেননি জেন অস্টিন। শেষটা কী ভেবেছিলেন তিনি? সেটাই ভেবে কূলকিনারা করতে পারেননি অন্য লেখকরা। অনেকে শেষ করার কথা ভেবেছিলেন; কিন্তু অসম্পূর্ণই রাখা হয় এই বইটি।
লুই স্টিভেনসনের ‘দ্য স্ট্রেঞ্জ কেস অফ ডঃ জেকিল অ্যান্ড মিঃ হাইড’-এর প্রথম ড্রাফট
ডঃ জেকিল আর মিঃ হাইড এখন প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়ে গিয়েছে। অনেক লেখায় অনেক সময় স্টিভেনসনের লেখা এই কাহিনিটির কথা উঠে আসে। এটা নিয়ে গবেষণাও কম হয়নি। আর তখনই সামনে এসেছে একটি বিশেষ তথ্য। মনে করা হয়, প্রথমদিকে নাকি লুই স্টিভেনসন ডঃ জেকিল, মিঃ হাইডকে নিয়ে একটি ড্রাফট লিখেছিলেন। প্রায় ৩০ হাজার শব্দের সেই খসড়াটি তাঁর স্ত্রী ফ্যানি স্টিভেনসনকে পড়তে দেন। সেটি নাকি ভালো লাগেনি ফ্যানির। বেশকিছু জায়গা বলেন লুইকে।
রহস্যটা তারপরে। এমন বিখ্যাত একটি উপন্যাসের প্রথম খসড়াটি হাতে পেলে যে কোনও গবেষকই উৎসাহী হয়ে উঠবেন। কিন্তু অদ্ভুতভাবে সেটা পাওয়া যায়নি। প্রথমে মনে করা হয়েছিল, স্ত্রীর সমালোচনা খোলা মনে গ্রহণ করেন লুই স্টিভেনসন। তারপর ফায়ারপ্লেসের আগুনে সেটি পুড়িয়ে দিয়ে আবার নতুন করে লেখেন। সেটাই ভাবা হয়েছিল। কিন্তু ২০০০ সালে ফ্যানি স্টিভেনসনের লেখা একটি চিঠি থেকে জানা যায়, লুই নাকি সেটা পোড়াননি। বরং ফ্যানি পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। তিনি সত্যিই সেটা করেছিলেন কিনা, তা জানা নেই। আপাতত প্রথম খসড়াটি চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে।