নেপথ্যে নেহরু! কীভাবে তৈরি হলো ল্যাকমে? অনেকেরই অজানা এই আশ্চর্য কাহিনি
Lakshmi and Lakme Relation : ফরাসি কোম্পানি রবের পিজে আর রেনোয়া-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে টাটা শুরু করেন ল্যাকমে।
ভারতে বিদেশি কসমেটিকস বা প্রসাধনী আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা বসে পাঁচের দশকে। দেশের বিদেশি মুদ্রা দেশেই রাখার উপায়ে এমন সিদ্ধান্ত। এদিকে হায় হায় রব উঠল উচ্চবিত্ত শহুরে মহিলামহলে। বিদেশি স্নো-পাউডার-এসেন্সে অভ্যস্ত, ভারতীয় শৃঙ্গারভূষণে আসক্ত দিল্লির নারীবাহিনী বিদেশ মন্ত্রকের সামনে বিক্ষোভ করছে দেখে নেহরু প্রশ্ন করেন, ভারতীয় কসমেটিকস কোম্পানি শুরু করা যায় না? ইন্দিরা এই বিক্ষোভ সমর্থন করেছিলেন, কারণ তাঁর মতে, সমস্যা বিদেশি দ্রব্যের প্রতি অন্ধ আসক্তির নয়, দেশজ কোম্পানির প্রসাধনী বাজারে মজুত থাকলেই বিদেশি সাজ সরঞ্জামের দুঃখ ভোলা যাবে।
নেহরু পরামর্শ করেন শিল্পপতি জে আর ডি টাটার সঙ্গে। 'Owned by all women of India' আদর্শে এমন এক কোম্পানির পরিকল্পনা শুরু হয় যার জন্য প্রয়োজনীয় সব রকম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় ভারত সরকার। ফরাসি কোম্পানি রবের পিজে আর রেনোয়া-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে টাটা শুরু করেন ল্যাকমে। প্যারিসে তখন অপেরা হাউজে চলছে 'ল্যাকমে'। রেনোয়া-টিমের কোনও সদস্য সেই অপেরা দেখে এসে ভারতীয় প্রসাধনী কোম্পানির নাম প্রস্তাব করেন - ল্যাকমে। লক্ষ্মীর ফরাসি নাম ল্যাকমে।
আরও পড়ুন- ওহে শান্ত লক্ষ্মীটি! এবার ওঠো, লড়ো, স্বপ্ন দেখো…
রূপ গুণের প্রতিমূর্তি, সামাজিক রোলমডেল, বাণিজ্যের দেবী, ভারতীয় ব্যাবসা- কসমেটিকস কোম্পানির এমন জুতসই নাম আর হয় না। দেশজ ঐতিহ্যও থাকল, যোগ হল ফরাসি কেত, নামে বিদেশি সুবাস। ল্যাকমের ল্যাভেন্ডার ট্যাল্কের বিজ্ঞাপনী পোস্টারে লেখা হয় 'A perfume so French... ask any Frenchman', অর্থাৎ বিদেশি স্নো-পাউডারের বদলে দেশি মালেও বিদেশি নাম এবং স্বীকৃতি। একচেটিয়া ব্যবসা শুরু হলো, যা এখনও চলছে। মায়ের ড্রেসিংটেবিলে ল্যাকমে লিপস্টিকের শেড দেখে বুঝেছিলাম রঙের নাম হয় এনরিচ শাইন বা ব্রাউন সুগার, নম্বর হয় ডব্লিউ-এম-১০। ততদিনে আর কোনও ফ্রেঞ্চম্যানকে জিগেস করে ল্যাকমের গুণগত বিচার দরকার নেই। ল্যাকমে হর ঘর কি কাহানি।
কলেজে পড়ি, ল্যাকমের লিপস্টিক কিনতে গেলে নতুন নতুন ব্র্যান্ডের নাম বলে দোকানি। কিন্তু মগজে ঢুকে গেছে মায়ের ড্রেসিংটেবিল। লিপস্টিক মানে ল্যাকমে। ভারতীয় চামড়ার রঙ ও বৈশিষ্ট্য বিচারে বানানো হয়েছে এইসব প্রসাধনী। এগুলিই আমাদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ এমন এক পরম্পরায় জারিত আমার সাজবেলার ইতিকথা।
'ল্যাকমে' নামকরণের অন্তরালে হয়তো অপরীকরণ থেকে আত্মীকরণের একটা যাত্রাপথ ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারত, ভারতীয় ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে 'ল্যাকমে'-কে?
আরও পড়ুন- মফসসলের অলক্ষ্মী-ছাপ
ফরাসি অপেরা ল্যাকমে-র মূল বিষয়বস্তু এক ভারতীয় নারীর সঙ্গে ব্রিটিশ সৈনিকের প্রেম, শেষে সেই মেয়ের আত্মহত্যা এবং মেয়ের মৃত্যুর বিচার চেয়ে বাবা নীলকণ্ঠের বদলা। অপেরার স্টেজ ভারতীয় আদলে গড়া, বলা উচিত কলোনিয়াল চোখে দেখা ভারতের রহস্যময় গ্রাম্য পিছিয়ে পড়া চরিত্রে গড়া। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের একচোখা বিভেদ দেখাল অপেরার দৃশ্যপট, অভিনেতাদের পোশাক। মা লক্ষ্মীর আদলে গড়া প্রধান চরিত্র, তার থেকেই অপেরার নাম। অপেরার ল্যাকমে প্রথম দিকে femme-fatale অর্থাৎ ওরিয়েন্টাল নারীর স্বভাব বৈশিষ্ট্যে বিদেশি পথকে বশীকরণ করেছে। নাটকের শেষার্ধে ল্যাকমে femme-fragile, নম্র, অসহায়, ত্যাগের পথে এক পা বাড়িয়েই রয়েছে, নিজেকে বলি দিতে সদা প্রস্তুত। এমন নারীর প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আজীবন রুখে দাঁড়ায় তার রক্ষাকর্তা, সে নিজে নয়। ভারতীয় পুরুষ (নাটকে ল্যাকমের বাবা নীলকণ্ঠ) সবেতেই রাগ দেখায়, শিবের প্রতিমূর্তি। ফরাসি ওরিয়েন্টালিস্ট তেয়োডোর পাভি ১৮৩৯ সালে ভারতভ্রমণ করেন। মাদ্রাজ, বম্বে, পুনে, কলকাতা, পণ্ডিচেরি ঘুরে পাভি ভারত দেখাশোনা বোঝাপড়া নিয়ে Scenes et recits des pays d’outre-mer” (Scenes & Stories from Overseas countries) ছোটগল্পের সিরিজ লেখেন। এর মধ্যে একটি গল্প অবলম্বনে লেও দেবিল ও ফিলিপ জিল ল্যাকমে অপেরা প্রযোজনা করেন।
উনিশ শতকের ফরাসি সংস্কৃতবিদ কেন ভারত-ব্রিটেন প্রেম নিয়ে গল্প লিখছেন এ বিষয়ে নানা মুনির নানা স্বরের মধ্যে জোর গলায় যা শোনা যায় তা ফরাসি-ইংরেজ রেষারেষির আরেক মুখ। উনিশ শতক ফ্রান্সে ভারতবর্ষ নিয়ে একপ্রকার অবসেশন শুরু হয়। ছোট করে উপনিবেশ শুরু করে যে জমি ইংরেজদের ছেড়ে দিতে হয়েছে তার প্রতি প্রবলতর টান অনুভব করে ফরাসি মন। বিদ্বজ্জনের বিশ্লেষণ বলছে, আঙুরফল টক মানসিকতা ধরা পড়েছিল পাভির গল্পগুচ্ছে। ল্যাকমে গল্পে নায়িকা আসলে ভারতবর্ষের প্রতীক, ইংরেজ যার মোহিনী রূপে আকর্ষিত হয়ে রূপ-রস-ধন-সম্পত্তি জয় করার চেষ্টায় ভারতবর্ষকে ধীরে ধীরে ঠেলে দেয় আত্মহননের পথে। যে অন্যায়ের বিচার চেয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে একদিন শুরু হবে স্বাধীনতার লড়াই। প্রতিশোধ নেবে ভারত।
এই প্রতীকী গল্পের ভিতর লুকিয়ে আছে ঔপনিবেশিক ঈর্ষা। এক কলোনিয়াল শক্তির বিরুদ্ধে অপর শক্তির ব্যর্থতার হা-হুতাশ। প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে প্রেমিকা হারানোর আস্ফালন। মাঝখান থেকে প্রেমিকাটি দুই পক্ষের হাতে পোর্সেলিনের দামী, সুক্ষ্ম পুতুল লোফালুফির প্রপ ছাড়া অন্য কোনও স্বীকৃতি পায় না। ফরাসি লক্ষ্মীর ভাগ্যেও তাই জুটেছিল। সেই নামের সঙ্গে জুড়ে থাকা সমস্ত স্টিরিওটাইপের শেকল ভেঙে নতুন দেশের স্বাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের 'ল্যাকমে' নামকরণের মধ্যে হয়তো নিজের এজেন্সি নিজের দখলে নিয়ে femme-fragile ভারতের তকমা থেকে বিশ্ব বাণিজ্যের কালো ঘোড়া হয়ে ওঠার পথচলা শুরু।