স্থানীয় থেকে জাতীয় লাফ! মোদির কুসুম বিছানো পথে কাঁটার নাম কেজরি?

AAP in Gujarat Election: গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে ৫ আসন এবং ১২.৯ শতাংশ ভোট পেয়েছে আম আদমির দল। এর সঙ্গেই ৬ শতাংশের বেশি ভোট জুটেছে গোয়ার বিধানসভায় নির্বাচনেও

আঞ্চলিক থেকে জাতীয়। এক রাজ্য থেকে গোটা ভারত। মাত্র এক দশকেই অসাধ্যসাধন করলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল (Arvind Kejriwal)। তাঁর তৈরি আম আদমি দল (AAP), যা এতদিন ছিল একটি, আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল- গুজরাত নির্বাচনের (Gujarat Election Result) ফল প্রকাশের পরেই পরিবর্তিত হল জাতীয় দলে। এবার থেকে আর আঞ্চলিকতা নয়, এবার দেশ জুড়ে অস্তিত্ব পাকা করে ফেললেন কেজরিওয়ালরা।

জাতীয় দল 'আপ'

গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে প্রায় ১৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে আম আদমি পার্টি। ১৮২ আসনের গুজরাত বিধানসভায় তাদের ঝুলিতে এসেছে ৫ আসন। প্রথমবার লড়াইয়ে নেমেই রাজ্যে তৃতীয় শক্তি হিসেবে উঠে এসেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা। আর এখানেই শুরু হয়েছে আলোচনা। স্বয়ং কেজরিওয়াল জানিয়ে দিয়েছেন, ''আমরা এখন জাতীয় দল। গুজরাতের মানুষকে ধন্যবাদ এই তকমা লাভ করানোর জন্য। আগামীতে লড়াই আরও বাড়বে। আমরা ফের জিতব।'' যদিও নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের রাজ্যে বিজেপি রেকর্ড ভেঙেছে ফের। ২৭ বছর পর  ১৫৬ আসনে জিতেছে কোনও একটি দল। এদিকে হিমাচলপ্রদেশে তেমন একটা সুবিধা করতে পারেননি জেপি নাড্ডারা। সেখানে ক্ষমতায় বসতে চলেছে কংগ্রেস। যদিও বিজেপির বিরুদ্ধে 'ঘোড়া কেনাবেচা'র অভিযোগ উঠছে এখন থেকেই।

মমতা না কেজরিওয়াল?

গুজরাত বিধানসভা নির্বাচন এবং সামগ্রিকভাবে জাতীয় দল কংগ্রেসের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ফের। অনেকেই বলছেন, অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে রাহুল গান্ধীর দল। ক্রমশ তলানিতে যাচ্ছে এই দলের ইতিহাস। অবনমন ঘটছে প্রভাবের। আর এই সুযোগেই উঠে আসছেন একাধিক আঞ্চলিক নেতারা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এমকে স্ট্যালিন, নীতিশ কুমার, অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা সামনের সারিতে আসছেন বারবার। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি-বিরোধী মুখ হিসেবে জায়গা করে নিচ্ছেন আঞ্চলিক দলের এই সমস্ত জনপ্রিয় নেতারা।

এবার সেই জায়গাতেই থাবা বসাতে পারেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং তাঁর আম আদমি পার্টি। রাজনৈতিক মহলের একাংশের দাবি, এর কারণ আসলে জাতীয় দল হয়ে ওঠা। বলা হচ্ছে, দেশজুড়ে একাধিক রাজনৈতিক দলের মধ্যে দেশের নবম জাতীয় দল হিসেবে নথিভুক্ত হতে চলেছে আম আদমি পার্টি, যা মোদি-বিরোধী মুখ হওয়ার ক্ষেত্রে খানিকটা স্বস্তি দিতে পারে কেজরিওয়ালকে। আর এখানেই মমতা বা অন্যান্য নেতা ছাড়িয়ে প্রধান বিরোধী মুখ হিসেবে উঠে আসতে পারে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নাম।

আরও পড়ুন- আপই কি নয়া ‘কংগ্রেস’? গুজরাত নির্বাচন যে প্রশ্ন তুলে ধরছে বারবার

আঞ্চলিক থেকে জাতীয়

ভারতবর্ষের সংবিধান অনুযায়ী, কোনও রাজনৈতিক দল যদি কমপক্ষে ৪টি রাজ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ ভোট পেয়ে রাজ্যের দল হিসেবে যোগ্যতা অর্জন করতে পারে, তাহলে দেশের নির্বাচন কমিশনের তরফে সেই দলের মাথায় জোটে জাতীয় দলের তকমা। অর্থাৎ একই প্রতীকে দেশের যে কোনও রাজ্যে লড়াইয়ে নামতে অসুবিধা থাকে না আর। এমনকী প্রতীকের টানাপড়েন থেকে শুরু করে সংগঠন, দেশ জুড়ে সমস্ত কিছুর বিস্তারেও সমস্যা অনেক কমে।

এই শর্ত ইতিমধ্যেই পূরণ করেছে 'আপ'। গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে ৫ আসন এবং ১২.৯ শতাংশ ভোট পেয়েছে আম আদমির দল। এর সঙ্গেই ৬ শতাংশের বেশি ভোট জুটেছে গোয়ার বিধানসভায় নির্বাচনেও, যা কয়েকমাস আগেই অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও ২ টি বিধানসভা আসনে জিতেছেন আপ প্রার্থীরা। পাশপাশি, দিল্লিতে তৃতীয় বারের জন্য সরকার গঠন করেছে আপ। আবার সম্প্রতি পঞ্জাবেও ৬০ এর বেশি বিধানসভা আসনে জিতে রাজ্যের ক্ষমতা দখল করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল-ভগবন্ত মানের দল। অর্থাৎ দিল্লি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হলেও প্রথম একটি পূর্ণ ক্ষমতার সরকার পঞ্জাবে গঠন করেছে আপ। এর সঙ্গেই আগে থেকেই অস্তিত্ব বজায় ছিল গোয়ায়। এবার আম আদমি পার্টির প্রভাব বিস্তার হয়েছে গুজরাতে, সেখানেও যাবতীয় শর্ত পালন করেছে এই দল। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে জাতীয় দলে পরিণতি হতে চলেছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি।

ভারতের জাতীয় দল

সম্প্রতি ভারতে ৮টি রাজনৈতিক দলকে জাতীয় দলের তকমা দিয়েছে দেশের নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে রয়েছে, ভারতীয় জনতা পার্টি অর্থাৎ বিজেপি, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস, ন্যাশনাল কনফারেন্স দল, ভারতের মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট দল, ভারতের কমিউনিস্ট দল, জাতীয় জনতা দল, বহুজন সমাজবাদী পার্টি। এর সঙ্গেই এবার যোগ হতে চলেছে আম আদমি পার্টি।

আরও পড়ুন- হাই ভোল্টেজ প্রচারও ব্যর্থ! মোদির ম্যাজিকে কেন আস্থা নেই হিমাচল প্রদেশের?

আম আদমি পার্টির ইতিহাস

২০১০ সাল। দেশজুড়ে দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুখ হিসেবে উঠে আসা প্রাক্তন আমলা অরবিন্দ কেজরিওয়াল যোগ দিলেন আন্না হাজারের আন্দোলনে। 'জন লোকপাল বিল'-এর দাবিতে, দেশে দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনরত আন্না হাজারের সঙ্গেই শোরগোল ফেললেন কেজরিওয়ালও। ২০১১ জুড়ে এই আন্দোলন বিপুল সাড়া ফেলল দেশে। চাপে পড়ল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন মনমোহন সিংয়ের সরকার। উত্তাল হল দিল্লি। রামলীলা ময়দান মুখরিত হল আন্না-বাণীতে।

১০ বছর আগের এক নভেম্বরে নতুন উদ্যোগে লড়াইয়ে নামলেন দিল্লির 'মাফলার ম্যান'। আন্না-সঙ্গ ত্যাগের বিতর্ক নিয়েই ২৬ নভেম্বর, ২০১২-তে তৈরি করলেন নতুন রাজনৈতিক দল। প্রতীক হিসেবে বেছে নিলেন ঝাঁটা।

প্রথম অবস্থায় অরবিন্দের উদ্যোগের পাশে বেশি লোক আসেননি। অল্প কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়েই জীবনের বড় 'রিস্ক' নিয়ে ফেললেন কেজরিওয়াল। দিল্লি জুড়ে শুরু করলেন প্রচার।

২০১৩। দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী দিলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। লক্ষ্য, কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতের শাসনের অবসান। নির্বাচন হল। অপ্রত্যাশিতভাবে ৭০ আসনের দিল্লি বিধানসভায় ২৮ আসনে, প্রথমবারেই জয় ছিনিয়ে নিল আম আদমি পার্টি। ত্রিশঙ্কু হল বিধানসভা। দায়িত্ব পড়ল অরবিন্দ কেজরিওয়ালের উপরে। তিনিই সাধারণ নেতা থেকে হয়ে গেলেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু নড়বড়ে সরকার! বাইরে থেকে সমর্থন নিয়ে এগোতে হচ্ছে তাঁকে।

মাত্র ৪৯ দিনেই মোহভঙ্গ। 'জন লোকপাল বিল' থেকে শুরু করে, একাধিক ক্ষেত্রে শুরু হল মতবিরোধ। পদত্যাগ করলেন কেজরিওয়াল। ফের দিলেন লড়াইয়ের বার্তা। তখনও দিল্লিতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে 'আপ'।

২০১৪-র মোদি-ঝড়ের রেশ কাটতে কাটতেই দিল্লির বিধানসভা নির্বাচন। ২০১৫-র নির্বাচনে ফের রুখে দাঁড়ালেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। এবার বিপুল জয়। বিজেপি-কংগ্রেসকে উড়িয়ে ৬৭ আসনে জয়ী হলেন আম আদমি পার্টির প্রার্থীরা। সরকারে বসলেন অরবিন্দ। দ্বিতীয় বারের জন্য দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হলেন তিনি। একাধিক জনমুখী প্রকল্পের ঘোষণা, বিনামূল্যের আবহের মধ্যেই ক্রমশ বাড়ছিল আপ। কেজরিওয়াল বিস্তার লাভ করতে শুরু করলেন দিল্লির পাশের রাজ্যগুলোতে। ফের নির্বাচন। আবার জয়। তৃতীয় বার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। এর সঙ্গেই গোয়ায় ঢুকল আম আদমি পার্টি। বহু দিনের লড়াই, দুর্বল সংগঠনকে তাজা করে একে একে একাধিক জয় হাসিল করলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল।

পঞ্জাব থেকে লোকসভা আসনে জয়। এরপর ফের লড়াই। কংগ্রেস আর বিজেপি এবং শিরোমণি আকালি দলের মিথ ভেঙে পঞ্জাবে ঝড় তুললেন তিনি। গড়লেন 'আপ' সরকার। এর সঙ্গেই চলে গোয়ার লড়াই। সেখানেও প্রথম বারেই জয় পেলেন দুই আসনে।

২০২২। কেজরিওয়ালের লক্ষ্যে উঠে এল গুজরাত। মোদির রাজ্যের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন নিজের দলকে। ভারতীয় টাকায় লক্ষ্মী, গণেশের ছবি থেকে শুরু করে বিলকিস বানো নিয়ে কোনও মন্তব্য না করা। একের পর এক কৌশলে খানিকটা প্রভাব বিস্তার শুরু করল আম আদমি পার্টি। আর সেই প্রভাবেই প্রায় ১৩ শতাংশ ভোট নিজেদের ঝুলিতে ভরে 'আপ'।

আর এখানেই একদা দিল্লির দুর্বল দল থেকে মাত্র এক দশকের লড়াইয়েই নজির স্থাপন করল আম আদমি পার্টি। আঞ্চলিক থেকে হয়ে গেল জাতীয়। নাছোড়বান্দা মনোভাব এবং একাধিক প্রতিবন্ধকতা কাটানোর উপায় বাতলে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কৌশল, এই অস্ত্রেই সাফল্য অর্জন করেছে আপ, বলছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও।

More Articles