রেলের ঘোষক থেকে বলিউডের ভয়েস আর্টিস্ট! অপমানের যোগ্য জবাব দিয়ে সাফল্যের শিখরে এক 'মহিলাকণ্ঠী'
'যাত্রীগন, অনুগ্রহ করে শুনবেন', আপনারা যারা নিয়মিত রেলযাত্রা করেন অথবা জীবনে একবার না একবার কোন একটি রেলস্টেশনে গিয়েছেন, তারা অবশ্যই প্ল্যাটফর্মে দাড়িয়ে মহিলাকণ্ঠে এরকম একটি ঘোষণা শুনেইছেন। ঘোষণাটি শুনে সকলেই মনে মনে বিশ্বাস করে নেন, মেট্রোরেলে যে রকম মধুমন্তী মৈত্রর গলার আওয়াজ রেকর্ড করে তা চালানো হয়, সেরকমই এখানেও একটি রেকর্ডেড অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে। তবে, সব ক্ষেত্রে এরকমটা নয়। মহারাষ্ট্রের পরলি বিজয়নাথ রেলওয়ে স্টেশনে এই ঘোষণাটি করে থাকেন একজন পুরুষ। শুনতে অবাক লাগলেও, এটাই সত্যি। দীর্ঘ বেশ কয়েক বছর ধরে মহারাষ্ট্রের এই স্টেশনে এরকম মহিলা কন্ঠে ট্রেন আসার এবং যাওয়ার ঘোষণা করে গিয়েছেন এক ব্যক্তি।
হ্যাঁ তবে সব সময় নয়, এমনিতে রেলের ইলেকট্রনিক ভয়েস কন্ট্রোল সিস্টেমের মাধ্যমেই এই ঘোষণা করা হয়ে থাকে, এবং সেখানে আদতেই একজন মহিলা কথা বলেন। তবে সমস্যাটা হয়ে যায় যখন, রেলের ওই অফিসে লোডশেডিং হয়ে যায়। সেই সময় অটোমেটেড মেশিন কাজ না করায় যিনি ওই স্টেশনের দায়িত্বে রয়েছেন তাকেই ওই ঘোষণা করতে হয়। আর এখানেই সাধারনের মাঝে অসাধারন হয়ে উঠেছেন শ্রবণ আদোদে।
একটি ছোট্ট সাক্ষাৎকারে শ্রবণ বলছেন, "আমি দীর্ঘ বহু বছর ধরে মহারাষ্ট্রের পারলি বিজয়নাথ স্টেশনে কাজ করেছি। আমি যখন ভারতীয় রেলে কাজ করতাম তখন আমাদের স্টেশন ডিউটি থাকতো। একদিন এমন হলো, হঠাৎ করেই পারলি বিজয়নাথ স্টেশনে লোডশেডিং হয়ে গেল, এবং তৎক্ষণাৎ সিস্টেমটি হ্যাং করে গেলো। কিন্তু এরকম অবস্থায় এটাকে ফেলে তো রাখা যাবে না, কারণ যদি ঠিকঠাক ঘোষণা না করা হয়, তাহলে যে কোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ভারতীয় রেলওয়েতে, এরকম ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। সেই সময় অটোমেটিক ভয়েস সার্ভিসের পরিবর্তে স্টেশন ডিউটিতে থাকা কোন একজনকে ওই কাজ করতে হয়। সাধারণত আমাদের এই সমস্ত সাধারণ স্টেশনে পুরুষ কর্মীর সংখ্যা অনেক বেশি। তাই কোন একজন পুরুষকেই ওই সময় সামাল দিতে হতো।"
"তবে সেখানে একটা সমস্যা রয়েছে, মহিলাকণ্ঠ যতটা তীক্ষ্ণ এবং স্পষ্টভাবে শোনা যায়, পুরুষ কন্ঠ মাইকে ততটা স্পষ্ট শোনা যায় না। ভারিক্কি আওয়াজের জন্য অনেকেই ঘোষণা বুঝতে পারেন না। এই সমস্ত ক্ষেত্রে যাত্রীদের অসুবিধা হয় প্রচুর। তাই একদিন আমি সাহস করে এগিয়ে গেলাম ওই ঘোষণা করতে। আমার গলার আওয়াজ ওই অটোমেটিক ভয়েস মেসেজের মতো করার চেষ্টা করলাম। মহিলা কন্ঠে করে ফেললাম ঘোষণা। এবং সবথেকে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, কেউ বুঝতে পর্যন্ত পারল না, ওই ঘোষণা কোন মহিলা, কিংবা কোনো অটোমেটিক ভয়েস থেকে হয়নি, করেছেন একজন পুরুষ," বলছেন শ্রবণ।
আরও পড়ুন-স্মৃতির ভিতর যে স্বাদের নিরন্তর চলাচল
ছোট থেকেই ভারতীয় রেলওয়ে প্রতি একটা আলাদা ভালোবাসা ছিল তার মনে। তিনি যখন স্কুলজীবনে ছিলেন, সেই সময় থেকেই ট্রেন বিষয়টি তার কাছে অমোঘ আকর্ষণের একটি বিষয়বস্তু ছিল। ভারতীয় রেল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে শ্রবণ বলছেন, "যখন আমি স্কুলে পড়তাম সেই সময় ভারতীয় রেলওয়ে এবং রেলের ঘোষণার প্রতি আমার একটা আলাদা আকর্ষণ ছিল। আমি যখনই ট্রেনে করে কোথাও যেতাম, তখন প্রত্যেকটি স্টেশনে আমি রেলওয়ে ঘোষণা শুনতাম। আমি প্রথমে মনে করতাম, সেই ঘোষণা করছেন কোন একজন মহিলা। আসলে আগে এরকম অটোমেটিক ভয়েস এর প্রচলন ছিল না। আগে কোন একজন মহিলা এই ঘোষণা করতেন। তাই আমি যখনই ট্রেন থেকে নেমে কিছুটা ফাঁকা সময় পেতাম, তখনই আমি রেলের ওই ঘোষণা মুখস্ত করতাম। ওই ঘোষণা মুখস্ত করতে করতেই, আমি ধীরে ধীরে সাবলীল হয়ে উঠি।"
দেশের বিভিন্ন স্টেশনে এবং বিভিন্ন রেলওয়ে অনুষ্ঠানে শ্রবণ নিজের এই অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন ঘটিয়েছেন বিগত কয়েক বছরে। সেখানে প্রশংসা কুড়িয়েছেন প্রচুর। তবে তার এই যাত্রাপথ খুব একটা সুগম কখনোই ছিল না। স্কুল এবং কলেজ জীবনে তাঁকে বহুবার নিজের গলার আওয়াজ এর জন্য অপমানিত হতে হয়েছে। তারই প্রতিভাকে খুব একটা লোকে মেনে নিতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। শ্রবণ বলছেন, "আমি যখন কলেজে ছিলাম, তখন কয়েকজন ছাত্র আমাকে আমার গলার আওয়াজের জন্য অপমান করেছিল। আমি বিভিন্ন ধরনের আওয়াজ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতাম। বিভিন্ন গায়িকাদের গলার স্বর নকল করে গান গাইতাম। পুরুষ এবং মহিলা দু'রকম কণ্ঠেই আমি সমানভাবে কথা বলা অধ্যায়ন করতাম। কিন্তু, এই বিষয়টি অনেকের চক্ষুশূল হয়ে ওঠে। আমার কলেজ জীবনের বন্ধুরা আমাকে বিভিন্ন ধরনের অপমানজনক বিশেষণে সম্বোধন করতো। অনেকে আমাকে ট্রান্সজেন্ডার পর্যন্ত মনে করতো। এমনকী সমাজেও আমাকে নিয়ে নানান রকমের কথা চলতই। আমি বুঝতে পারতাম সবই, কিন্তু সেসব নিয়ে আমি কোনোদিন তেমন মাথাব্যথা করিনি। মানসিকতার বদল আনা সহজ না, তাই আমি এসবকে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে নিজের কাজের ওপরেই জোর দিতাম।"
সেখান থেকেই শ্রবণের যাত্রা শুরু। তারপরে পূর্ব এবং দক্ষিণ ভারতের বেশকিছু স্টেশনে প্রয়োজনের সময় নিজের মহিলাকণ্ঠ ব্যবহার করে ঘোষকের কাজ করেছেন শ্রবণ। ভারতীয় রেলের অফিশিয়াল ফেইসবুক পেজ থেকেও তার এই অসাধারণ কীর্তির ভিডিও শেয়ার করা হয়েছে। বিভিন্ন ভারতীয় রেলের অনুষ্ঠানেও তাকে একাধিকবার দেখা গিয়েছে তার স্পেশাল পারফরম্যান্স করতে। বর্তমানে তিনি আর ভারতীয় রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত নেই। এখন তিনি একজন রেডিও জকি, এবং একজন সফল ভয়েসওভার আর্টিস্ট। শ্রেয়া ঘোষাল সহ একাধিক মহিলা কন্ঠে তিনি গান করেন। এছাড়াও, ডাবিং এবং বাচিক শিল্পী হিসেবেও তার জনপ্রিয়তা রয়েছে। ভয়েস ওভার ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি একজন অত্যন্ত পরিচিত মুখ। বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতেও কিছু ছবিতে ভয়েস ওভার এবং ব্যাকগ্রাউন্ড ভয়েস আর্টিস্টের কাজ পেতে শুরু করেছেন। ভারতীয় রেলের একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে কাজ করতে করতেই একদিন সাফল্যের শিখরে পৌঁছে গেলেন শ্রবণ। আর এই সাফল্য এলো শুধুমাত্র তার গলার স্বরের জন্য, যার কারণে একদিন তাঁকে হাজারো অপমান সহ্য করতে হয়েছিল।