জয়নগরে শিশুর নিখোঁজ হওয়াকে পাত্তাই দেয়নি পুলিশ! কেন বারবার এত গড়িমসি পুলিশের?
Jaynagar Child Death: প্রশ্ন উঠছে, একটি শিশুর নিখোঁজের খবর পুলিশ কি আর একটু গুরুত্ব দিয়ে দেখতে পারত না?
আরজি কর নিয়ে আন্দোলন চলছে। বিচার চেয়ে অনশন চলছে, রাত দখল চলছে, আর চলছে ধর্ষণ। লাগাতার, অবিরাম! তাহলে আদালত, পুলিশ, তদন্ত, এসবের ঢালাও খবর, সোশ্যাল মিডিয়া উপচে পড়া প্রতিবাদের কোনও প্রভাবই নেই সমাজে? কোচিং সেন্টার থেকে বাড়ি ফেরার পথে ন’বছরের এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ উঠেছে জয়নগরে। বাড়ির পাশের পুকুর থেকে শিশুর লাশ উদ্ধার হয়েছে। এই ঘটনায় এলাকার এক যুবককে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রীর মৃত্যু দেখল রাজ্য, ধর্ষণের তালিকায় নাম জুড়ল আরেকটি। আরজি করের আন্দোলন অনেকটা অস্তমিত। জয়নগরের আন্দোলন দানা বাঁধবার আগেই এসে গিয়েছে দুর্গোৎসব। আরজি কর হোক বা জয়নগর, দুই ক্ষেত্রেই একটি বিষয় সাধারণ। পুলিশের গা-ছাড়া মনোভাব! অভিযোগ, জয়নগরের এই শিশুর বিষয়টিকে পুলিশ আমল দেয়নি।
শিশুর পরিবার জানিয়েছে, প্রতিদিনের মতোই শুক্রবারও বাচ্চাটি টিউশন পড়তে গিয়েছিল। কাছেই বাজারে তার বাবার দোকান। টিউশন শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাবার সঙ্গে দেখা করে একাই বাড়ি ফিরছিল চতুর্থ শ্রেণির ওই শিশুটি। অভিযোগ, পথেই তাকে অপহরণ করা হয়। তারপর তাকে ধর্ষণ করে, খুন করে ফেলে দেওয়া হয় পুকুরে।
আরও পড়ুন- ওঁর দু’চোখ জোড়া স্বপ্ন রক্ত হয়ে ঝরতে দেখেছি: আরজি কর কাণ্ডে মৃতার মা-বাবা
মৃত শিশুর পরিবারের তরফে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয় জয়নগর থানায়। অভিযোগ, প্রথমে মহিষমারিতে অভিযোগ জানাতে গিয়েছিল মৃত বাচ্চাটির পরিবার। সেই থানা অভিযোগ নেয়নি। পরিবারটিকে জয়নগর থানায় যেতে বলা হয়। শিশুর পরিবারের অভিযোগ, পুলিশ প্রথমেই যদি বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখত, তাহলে হয়তো তাঁদের সন্তানকে বাঁচানো যেত। এই ঘটনা ঘটার পর স্থানীয় মানুষরা থানায় চড়াও হন, বিক্ষোভ দেখান, ভাঙচুর করেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, আরজি করের ঘটনা, পুলিশদের বদলি এতকিছুর পরেও কেন গড়িমসি পুলিশের? শুধু আরজি কর বা জয়নগর নয়, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির প্রশ্নে পুলিশের অসংবেদনশীলতা, গড়িমসির অভিযোগ নতুন নয়।
পার্কস্ট্রিট থানার মধ্যেই এক মহিলা সিভিক ভলান্টিয়ারকে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ উঠেছিল সাব-ইনস্পেক্টরের বিরুদ্ধে। অথচ এফআইআর দায়ের করা দূর অস্ত, কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার সামান্য জেনারেল ডায়েরি করতেও রাজি হননি বলে অভিযোগ। অভিযোগ, যৌন নিগ্রহের অভিযোগ আসার পরে প্রাথমিকভাবে মহিলার শারীরিক পরীক্ষা করানোর নিয়ম পালনের বদলে ওই পুলিশ আধিকারিক তাঁকে বুঝিয়েছেন, ‘‘এতে এত গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। নিজেরা কথা বলে মিটিয়ে নাও।’’
আরজি কর-কাণ্ডে তথ্যপ্রমাণ লোপাটের দায়ে কলকাতা পুলিশের এক ওসিই খোদ হাজতে। দেশের শীর্ষ আদালত বারবার প্রশ্ন তুলেছে, আরজি করে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় যে এফআইআর লেখা হয়েছে তাতে ভুল বয়ান তো আছেই, এফআইআর দাখিলের সময়টুকু অবধি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কেন রাতেই ময়নাতদন্ত সেরে তড়িঘড়ি নির্যাতিতার দেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়, সেই প্রশ্নও করেছে দেশের শীর্ষ আদালত। জয়নগরের ঘটনাতেও পুলিশের অত্যন্ত গা-ছাড়া মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। পার্কস্ট্রিটের মতো থানায় মহিলা সিভিক ভলান্টিয়ার নিজে নিরাপদ নন! এত ঘটনার পরেও পুলিশ কেন সংবেদনশীল নয়? কোনও বিশেষ নির্দেশের অপেক্ষায় তারা?
নাগরিকদের অনেকেই মনে করছেন, পুলিশ বরাবরই অসংবেদনশীল। বিশেষত, মহিলা পুলিশ আধিকারিকের অভাব থাকায় মহিলাদের হেনস্থা, নিগ্রহ বিষয়ক ঘটনায় মেয়েরা প্রাথমিক যে ভরসা পেতে চান প্রশাসনের কাছে, তা পান না। প্রাক্তন পুলিশকর্তাদেরও একাংশ মনে করেন, পুলিশকর্মীরা যে ক্ষমতা ভোগ করেন, তাতে ঔদ্ধত্য এবং ক্ষমতার দম্ভ বাড়ে। পাশাপাশি দুর্নীতির রমরমার মধ্যে এই ক্ষমতা ব্যবহার করে যে কোনও ঘটনা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার কথাও অবচেতনে থেকে যায়। বহু ক্ষেত্রেই পুলিশ ও পুরুষ এই ভূমিকার বাইরে গিয়ে একজন মানুষ হিসেবে অভিযোগকারিণী বা নিগৃহীতার সঙ্গে কথা বলছেন, এমন পুলিশ কমই।
আরও পড়ুন- ধর্ষণের আগে ধর্ষিতা পালাতে কেন পারেন না? বিজ্ঞান কী বলছে?
পার্কস্ট্রিট থানার ওই ঘটনায় অভিযোগকারিণীর বলেছিলেন, এই অভিজ্ঞতা তাঁর নতুন না। থানার মধ্যেই এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে তাঁর সঙ্গে। তাঁর অভিযোগ, গত ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি পার্কস্ট্রিট থানার কম্পিউটার রুমে কাজ করছিলেন। রাত দেড়টা নাগাদ সেখানে মত্ত অবস্থায় ঢুকে অভিযুক্ত এসআই অভিযোগকারিণীকে যৌন নিগ্রহ করেন। অথচ তাঁকে অভিযোগ দায়ের করতেই বাধা দেওয়া হয়। জয়নগরেও শিশুটি বাড়ি না ফেরায় পরিবারের লোকজন প্রথমেই থানায় গিয়েছিল কিন্তু পুলিশ কোনও গুরুত্বই দেয়নি। পুলিশের যখন টনক নড়ে তখন শিশুটি পাশবিক যন্ত্রণার শিকার হয়ে মৃত!
প্রশ্ন উঠছে, একটি শিশুর নিখোঁজের খবর পুলিশ কি আর একটু গুরুত্ব দিয়ে দেখতে পারত না? এত সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচার, পুলিশের দিকে এত গাফিলতির অভিযোগ, আদালতের নিন্দার পরেও পুলিশই যদি সাধারণ মানুষের পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে আমজনতা কেনই বা পুলিশ-প্রশাসনের উপর ভরসা রাখবে? এত আন্দোলনের পরেও কি সাধারণ স্তরে, পুলিশের উপর আস্থা বাড়বে মানুষের? নাকি ধীরে ধীরে আইন নিজের হাতে নেওয়ার দিকেই এগোতে বাধ্য হবে সমাজ?