শরৎচন্দ্র থেকে গান্ধীজি, সকলেই শিকার হয়েছিলেন রসিকতার, আসলে কেমন মানুষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ?

Rabindranath Tagore : রবীন্দ্রনাথের রসিকতা নিয়ে রয়েছে অজস্র মজার গল্প, জানেন আসলে কেমন মানুষ ছিলেন কবিগুরু?

ভরপুর আসর। একধিক গুণীজনের সঙ্গে সেখানে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ওই একই আসরে আমন্ত্রণ ছিল কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়েরও। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এসে পড়লেন তিনি। কিন্তু একি! জুতো জোড়া পায়ের বদলে বগলে করে আসরে প্রবেশ করছেন শরৎবাবু। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলো রসিক রবীন্দ্রনাথের প্রতিচ্ছবি। শরৎচন্দ্রকে প্রশ্ন করে বসলেন, তোমার বগলে ওটা কি ‘পাদুকাপূরাণ’? রবীন্দ্রনাথের এই তাৎক্ষণিক রসিকতায় সভার সবাই হেসে লুটিয়ে পড়েন। আসলে এর আগের দিন কোনও এক আসরে জুতো জোড়া চুরি হয়ে গিয়েছিল শরৎচন্দ্রের। তাই এদিন আর ঝুঁকি না নিয়ে অতিরিক্ত একজোড়া জুতো কাগজে মুড়িয়ে বগলদাবা করে নিয়ে আসেন। কিন্তু রসিক রবি তো মোটেই এই সুযোগ হাতছাড়া করবেন না, কাগজে মোড়া পুঁথি পুরাণের সঙ্গে মিলিয়ে পাদুকার অমন ব্যাখ্যা না করে ছাড়লেন না!

কেবল গল্প, উপন্যাসই নয় বাস্তব জীবনেও ঠিক এমন রসিক মানুষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জীবনকে তিনি প্রতিটি পলে পলে উপভোগ করতে চেয়েছিলেন। খারাপের ঠিক পাশে ভালো, কান্নার পাশে হাসি অথবা মৃত্যুর পাশে জীবনকে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন। যিনি লিখছেন নিজের ঘরের সুসভ্যতার আলোটুকু নিভিয়ে দেওয়ার কথা তিনিই আবার অন্য জায়গায় জুতো আবিষ্কারের মতো চটুল লেখা লিখছেন। এ কেবল কলমের আঁচড়ে সম্ভব ছিল না, নিজের জীবনের পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার বদলে ষোলো আনাই তিনি রেখে গিয়েছেন ছত্রে ছত্রে। সেটা কবিতার হোক অথবা জীবনের।

আরও পড়ুন - রবীন্দ্রনাথের নামে ডাইনোসর রয়েছে খাস কলকাতায়! দেখে আসতে পারেন স্বচক্ষে

একদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিসর্জন নাটকের মহড়া চলছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। নাটকে রঘুপতির ভূমিকায় ছিলেন দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইপো), আর জয়সিংহ সেজেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। একটা দৃশ্য ছিল এমন, জয়সিংহের মৃতদেহের ওপর আছড়ে পড়বেন শোকার্ত রঘুপতি। কিন্তু স্থূলকায় চেহারার দিনুর বারবার রবীন্দ্রনাথের ওপর আছড়ে পড়ায় একসময় রবীন্দ্রনাথ কেঁকিয়ে উঠে বললেন, “ওহে দিনু, মনে করিসনে আমি সত্যি সত্যিই মারা গেছি!” এমনটাই ছিলেন কবিগুরু। যেকোনো পরিস্থিতিতে তিনি হাসির উপাদান খুঁজে পেতেন।

যদিও এই রসবোধটুকুই জীবনের রসদ জুগিয়েছে কবিগুরুকে। এত এত স্বজন হারানোর শোক নাহলে পর করে আসা হয়তো তাঁর পক্ষেও অসম্ভব ছিল। এই রসবোধের প্রসঙ্গে আরও একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করতেই হয়। শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক বিধুশেখর শাস্ত্রীকে রবীন্দ্রনাথ একবার লিখে পাঠালেন, “আজকাল আপনি কাজে অত্যন্ত ভুল করছেন। এটা খুবই গর্হিত অপরাধ। এজন্য আগামীকাল বিকেলে আমি আপনাকে দণ্ড দিব।” বার্তা পাওয়া মাত্রই তো রীতিমত শঙ্কায় পড়ে গেলেন অধ্যাপক। গুরুদেব স্বয়ং এসে দণ্ড দেবেন বলেছেন যখন নিশ্চয়ই বড়সড় কিছু অপরাধ হবে। পরের দিন তড়িঘড়ি বিধুশেখরবাবু উপস্থিত হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। দেখলেন রবীন্দ্রনাথ বসে রয়েছেন, হাতে একটা বড় মোটা গোছের লাঠি। বিধুশেখরবাবু সেই দেখে আরও ভয় পেয়ে গেলেন, তবে কি এই বয়সে গুরুদেবের হাতে লাঠির বাড়ি খেতে হবে নাকি তাঁকে! কিন্তু এই সব ভয়, উৎকণ্ঠার মাঝে জল ঢেলে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। খুব শান্তভাবে ওই লাঠিটি তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “এই নিন আপনার ‘দণ্ড’! সেদিন যে এখানে ফেলে গেছেন, তা একদম ভুলে গেছেন আপনি!” ‘দণ্ড’ অর্থাৎ যার প্রতিশব্দ লাঠি। রসিকতার এমন বহরে তখন হাসবেন নাকি কাঁদবেন তা বোঝা রীতিমতো দায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল অধ্যাপক বিধুশেখর শাস্ত্রীর।

বহুমাত্রিক সাহিত্য প্রতিভার অধিকারী দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ বাস্তব জীবনে মোটেই গুরুগম্ভীর রাশভারী মানুষ ছিলেন না। তাঁর লেখনী দেখে অবশ্য এমনটা ধারণা করে নেওয়া যে তিনি ব্যক্তি জীবনেও হাসি এবং কান্নার মধ্যে যথার্থ ব্যালেন্স করতে পারতেন। খুব সিরিয়াস মানুষের নেপথ্যে লুকিয়ে থাকা রসবোধটুকু তিনি বারবার জনমানসে সামনে এনেছেন। সবার সঙ্গে সহজ, সরল ছিল তাঁর ব্যবহার। কবিগুরুর ব্যক্তিগত জীবন ঘাঁটলে তাই উঠে আসে অজস্র মজার মজার ঘটনা।

শান্তিনিকেতনে ওই ঘটনাটা ছাড়াও আরও একটা বিশেষ ঘটনা উল্লেখ করতেই হয়। একদিন শান্তিনিকেতনের ছেলেদের সঙ্গে অন্য এক প্রতিষ্ঠানের ছেলেদের ফুটবল খেলা। খেলা শেষে শান্তিনিকেতনের ছেলেরা তো বেজায় খুশি। প্রতিপক্ষকে এক্কেবারে ঘায়েল করে এসেছে তারা। ফলাফল আট-শূন্য। কিন্তু এই জয়ল্লাসের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করে বসলেন “জিতেছে ভালো, তা বলে আট গোল দিতে হবে? ভদ্রতা বলেও তো একটা কথা আছে!” ভরপুর রসবোধ ছাড়া এমন তাৎক্ষণিক অভিব্যক্তি কি সত্যিই সম্ভব?

আরেকবার স্বনামধন্য সাহিত্যিক ‘বনফুল’ তথা বলাইচাঁদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক ছোট ভাই বিশ্বভারতীতে পড়াশোনা করা জন্য গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তখন বেশ বৃদ্ধ। তাই তিনি কানাঘুষো শুনেছিলেন কবিগুরু নাকি কানে খানিক কম শুনছেন। তাই প্রথম সাক্ষাতে যখন কবিগুরু তাঁকে জিজ্ঞেস করেন “কী হে, তুমি কি বলাইয়ের ভাই কানাই নাকি?” তখন বলাইচাঁদের ভাই রীতিমতো চিৎকার করে জবাব দেন, “আজ্ঞে না, আমি অরবিন্দ।” রবীন্দ্রনাথ তখন দুম করে বলেন, “না কানাই নয়, এ যে দেখছি একেবারে সানাই!” আর এর থেকেই বোঝা যায় বয়সের ভারেও রসিকতায় কোনওরকম ঘাটতি পড়েনি কবিগুরুর।

আরও পড়ুন - বিমলাকে ‘শিক্ষা’ দিলেন না নিখিলেশ, পদাবলির বিরহকে ঘরে-বাইরে মিশিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ এবং মহাত্মা গান্ধীর লুচি খাওয়ার গল্প অবশ্য অনেকেই জানেন। একবার সাক্ষাতে রবীন্দ্রনাথ গুছিয়ে লুচি তরকারি খাচ্ছেন, আর গান্ধীজি সেখানে স্বাস্থ্যের দোহাই দিয়ে কিনা খাচ্ছেন ওটস! গান্ধীজী তাই দেখে বলে উঠেন, “গুরুদেব, তুমি জানো না যে তুমি বিষ খাচ্ছ।” ডুবো তেলে ভাজা লুচি, সে তো বিষই বটে, অন্তত আজকের ডায়েট যুগে দাঁড়িয়ে এ কথা অনেকেই মেনে চলেন, অনেকে আবার বাধ্য হন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ মানবেন কেন! খেতে যে তিনি ভীষণ ভালোবাসতেন। শুধু রসিক নন, তিনি খাদ্যরসিকও ছিলেন ভরপুর। তাই উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “বিষই হবে; তবে এর অ্যাকশন খুব ধীরে। কারণ, আমি বিগত ষাট বছর যাবৎ এই বিষ খেয়েই বেঁচে আছি!”

কথায় কথায় এমন রসিকতার প্রসঙ্গ বারবার টেনে আনতেন রবি ঠাকুর। এ যেন তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিংবা হয়তো জীবনের দুঃখ ভোলবার, দুঃখকে উপেক্ষা করা সহজ পথ্য। তাই হয়তো ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে…. ওগো বিদেশিনী’র মতো গানটিকেও এক সাহেবের কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন চিনি অর্থাৎ সুগার হিসেবে। মরিস সাহেব তাই বলেন, প্রবল মিষ্টি গান লিখেছেন কবিগুরু! জীবনের ওঠাপড়ায় সবকিছুকে এমনটাই সহজ করে দেখতে চেয়েছেন তিনি। তাই হয়তো অত সহজে ব্যাখ্যা করতে পেরেছিলেন মৃত্যুকেও। কজন বলতে পারেন, “আমি মৃত্যুর চেয়ে বড়”। রবিঠাকুর পেরেছিলেন। আর তাই তিনি আজও আমাদের জীবনের সবটুকুতে এমন আস্টেপৃষ্ঠে থেকে গেছেন। থেকে যাবেন।

More Articles