সিরিয়া থেকে ইউক্রেন – একুশ আসলে শরণার্থীর শতক

এ শতক উদ্বাস্তুর শতক। যদিও উদ্বাস্তু সমস্যাকে কোনও এক শতকে মেপে ফেলা সম্ভব নয়। সভ্যতার হিংস্রতম নখ দাঁত মানুষকে চিরে চিরে ফালাফালা করেছে এর আগেও। গত শতকের দুই বিশ্বযুদ্ধ তার প্রমাণ। সঙ্গে ছিল দেশভাগ। সেই রিফিউজি সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে পৃথিবীতে এমন কোনও দেশ ছিল না। একাত্তরের যুদ্ধে আবার রিফিউজি দেখেছে বাংলা। বারে বারে ব্যক্তির ঘরের নিরাপত্তা গুঁড়িয়ে দিয়েছে রাষ্ট্র। মানুষ প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে অপেক্ষাকৃত নিরাপদের কাছে। নিশ্চয়তা নেই। আজ যে আশ্রয় দিচ্ছে কাল সে কেড়ে দিতে পারে যাবতীয় বাঁচার অধিকার। সেই পরম্পরাই যেন ফুলেফেঁপে উঠেছে এই শতকেও। মায়ানমার, সিরিয়া, আফগানিস্তানের পরে এবার ইউক্রেন।

এ শতকে বিশ্বের বৃহত্তম উদ্বাস্তু-সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু হল সিরিয়া। ২০১১ সালের মার্চ নাগাদ সিরিয়ার দারা শহরে একদল কিশোরকে গ্রেফতার করে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে তারা সরকারবিরোধী গ্রাফিতি এঁকেছে। এই গ্রেফতারের বিরুদ্ধের কিশোরদের সমর্থনে বিরাট একটি প্রদর্শন আয়োজিত হয়। সেখানে যাবতীয় শক্তি নিয়ে আক্রমণ চালায় সরকার। দীর্ঘদিন ধরেই সরকারী নিরাপত্তা বাহিনীর অত্যাচারে সিরিয়ার মানুষজন ক্ষেপে গিয়েছিল। এই আক্রমণে সমস্ত সিরিয়া ক্রোধে ফেটে পড়ে। মুহুর্মুহু আন্দোলন ক্রমে বাড়তে বাড়তে গৃহযুদ্ধের আকার নেয়। লক্ষ লক্ষ পরিবার গৃহহীন হয়। এ ঘটনার বছর দশেক পরেও সিরিয়ার উদ্বাস্তু সংখ্যা বিন্দুমাত্র কমেনি। এখনও বেশ বড় সংখ্যায় লোকজন দেশ ছেড়ে পালিয়ে প্রতি বছর ইউরোপে আশ্রয় নিচ্ছে। এ পর্যন্ত ১ কোটি ৩০ লক্ষেরও বেশি রিফিউজির আশ্রয় প্রয়োজন, যাদের মধ্যে ৬০ লক্ষের সাহায্যের আশু প্রয়োজন। ২০১৯ এর ডিসেম্বর থেকে ২০২০র ফেব্রুয়ারিতে আবার যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে নতুন করে উদ্বাস্তু হয়েছে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ। এদের মধ্যে ৮০ শতাংশ মহিলা ও শিশু।

মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গারা অপরায়নের শিকার হয়ে এসেছেন গত কয়েক দশক ধরেই। নাগরিকত্ব তাদের দেওয়া হয়নি, যখন তখন নির্মম ভাবে অত্যাচার চালান হয়েছে তাদের ওপর। একের পর এক এইসব হিংসাত্মক আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে রোহিঙ্গা মহিলা, শিশু এবং পুরুষেরা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় খুঁজছে দীর্ঘদিন ধরেই। বিশেষত ১৯৭৮, ১৯৯১-১৯৯২ থেকে ২০১৬–প্রত্যেকটি বছর রোহিঙ্গাদের উপর এই আক্রমণের সংখ্যা বিপজ্জনক ভাবে বেড়েছে। ২০১৭র অগাস্টে তা চরম সীমায় পৌঁছলে বাংলাদেশের নিরিখে সবথেকে কম সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক উদ্বাস্তু মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসে। সেসময় থেকেই সাত লক্ষ ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা কক্স বাজারে বস্তি করে বাস করে। এদের মধ্যে ৪ লক্ষ শিশুও রয়েছে। মায়ানমারে এদের গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরিবারের সদস্যরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পালাতে গিয়ে। মেয়েদের দল বেঁধে ধর্ষণ করে আক্রমণকারীরা। বেশিরভাগ উদ্বাস্তুই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এই বীভৎসতা প্রত্যক্ষ করে। কক্স বাজারের ক্ষণিক আশ্রয়ে গড়ে ওঠে বিশ্বের বৃহত্তম রিফিউজি-ক্যাম্পটি। ২০১৯ সালে ৯ লাখ ৯ হাজারেরও বেশি উদ্বাস্তু উখিয়া এবং তেকনাফ উপজেলায় আশ্রয় নেয়। কুতুপালং-বালুখালি অঞ্চলে প্রায় ৬ লাখ ২৬ হাজার ৫০০ উদ্বাস্তু আশ্রয় নিয়েছিলেন।

গত বছর অগাস্ট মাস নাগাদ আমরা দেখেছি আফগানিস্তানে তালিবানের আক্রমণ, এবং সরকার দখল। সে সময় একটি প্লেনের ছবি ভাইরাল হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। বিমানের পা ধরে ঝুলে রয়েছেন লোকজন। এবং চলতি বিমান থেকে পড়ে মৃত্যু হচ্ছে মানুষের এমন খবরও উঠে এসেছিল সামনে। কতদূর ভয়ভীত হলে মানুষ এমন কাজ করতে পারে। সে সময় হাজারে হাজারে মানুষ প্রতিবেশী দেশগুলিতে পালিয়ে এসেছিল। সেই সব দেশে গত বছর চল্লিশেক ধরে চলতে থাকা টালবাহানায় ২২ লাখ উদ্বাস্তু আফগানের বসবাস গড়ে উঠেছিল ইতিমধ্যে। এবারের ঘটনায় গৃহহীন হলেন আরও ৩৫ লাখ মানুষ।

এই একই অবস্থা বর্তমানের ইউক্রেনের। ইউ এনের রিপোর্ট অনুযায়ী ১ লাখ মানুষ এ পর্যন্ত উদ্বাস্তু হয়েছেন। এবং তারা আশঙ্কা করছে সংখ্যাটা ৪০ লক্ষে গিয়েও ঠেকতে পারে। প্রথম প্রথম উদ্বাস্তুরা গিয়ে উঠছে রোমানিয়া, হাঙ্গারি এবং পোল্যান্ডে। তাদের অনেকেই পোল্যান্ডের রেল স্টেশনে রাত কাটিয়েছেন। সেখানেই রিসেপশন সেন্টার তৈরি হয়েছে। কিয়েভ থেকে পশ্চিম ইউক্রেনের দিকে আরো মানুষ পালাতে শুরু করেছেন। এবং তাঁরা হাতের কাছে যা পাচ্ছেন, সেই টুকু নিয়েই প্রাণভয়ে পালিয়ে আসছেন বলে খবর। ডিডব্লিউ অ্যাকাডেমির একজন উপদেষ্টা ডিমা খিলচেঙ্কো নিজের পরিবারকে কিয়েভের বাইরে পশ্চিম ইউক্রেনে নিরাপদ ভাবে পৌঁছে দিতে পেরেছেন। নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন ডিমা, “গতকাল যে কী গেছে বলে বোঝান যাবে না। ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ একটা প্রচণ্ড বিষ্ফোরণের শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। শব্দটা খুব চেনা। ঘুম ভেনেগেই বুঝতে পারলাম যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে।” তাঁর বয়ান অনুসারে তাঁর দুই সন্তানকে নিয়ে কিয়েভ থেকে দেশের বাড়ির নিরাপদ সীমায় পৌঁছতে লেগেছিল ঘন্টা দশেক। সাধারণত তিন ঘন্টায় যে পথ পেরিয়ে আসা যায়। “বিরাট ট্রাফিক জ্যাম, দিগন্ত জ্বলছে, সেখানকার বড় বড় বিল্ডিংগুলো জ্বলছে। রীতিমতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।” বলেন তিনি।

ইউরোপের বিভিন্ন দেশগুলি অর্থনৈতিকভাবে ইউক্রেনের পাশে থাকবে বলে জানিয়েছে। ইউক্রেনের রিফিউজিদের আশ্রয় দেবে তারাই। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়। মানুষের সারা জীবনের তিলতিল সঞ্চয়ে গড়ে তোলা ঘর, পরিবার, নিজস্ব পরিমণ্ডল থেকে এভাবে একটানে উপড়ে ফেলার অধিকার রাষ্ট্রপ্রধানদের দিল কে? রোহিঙ্গাদের সম্পূর্ণ কয়েকটা প্রজন্ম স্বাভাবিক জীবন যাপন থেকে বঞ্চিত। সমস্ত উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রেই তা সত্যি। জীবনের যা কিছু সঞ্চয় সমস্ত মুহূর্তে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেলে তারা দাঁড়াবে কোথায়? ওপার থেকে আসা লাখো লাখো বাঙালি উদ্বাস্তুর কী দীর্ঘকালীন সময় লেগেছে ঘুরে দাঁড়াতে তা সে সব বাঙালি পরিবার হাড়ে হাড়ে জানে। উদ্বাস্তু কলোনির বীভৎসতা, বস্তির সেই নারকীয় পরিবেশ বাংলাও খুব কাছ থেকে দেখেছে। দেখেছে মারিচঝাঁপির উদ্বাস্তুদের পরিণতি। রাজার খেয়ালে সাধারণের এই মৃত্যু মিছিলের শেষ কোথায়? মানুষই বোধহয় সেই একমাত্র প্রাণী যে মানুষেরই ক্ষমতালোভে প্রাণে না মরেও একটি জীবনে কয়েক হাজারবার চুপিচুপি মরে যায়। অন্তত যতবার মনুষ্যত্ব মরেছে।

More Articles