জি-২০-এর অতিথিদের মোদির উপহার সিন্দুক, ভিতরে কোন খাজানা?
G20 India Summit: জি ২০ সম্মেলনের দেশি বিদেশি অতিথিদের বিশেষ উপহার তুলে দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কাঠের সিন্দুকের ভিতর রকমারি উপহার। সুন্দরবনের মধু থেকে কাশ্মীরের পশমিনা, কন্নৌজের সুগন্ধী, কী নেই গিফ্ট বক্সে!
জি-২০ শেষে দেশ বিদেশের অতিথিরা ব্যাগ ভরতি করে উপহার নিয়ে ফিরলেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশের সেরা পণ্যসম্ভারে ভরে দিলেন জো-বাইডেন, ঋষি সুনক, শেখ হাসিনাদের গিফট-বক্স। কী নেই তাতে। এক টুকরো ভারতই যেন জায়গা করে নিয়েছে উপহারের তালিকায়। যাতে রয়েছে বাংলার সুন্দরবন, তামিলনাড়ুর নীলগিরি পাহাড়, ভূ-স্বর্গ কাশ্মীরের অপার সৌন্দর্য্য। রয়েছে দাক্ষিণাত্যের মনোরম আরাকু উপত্যকার তরজাতা ঘ্রাণ। তবে এত কিছুর মধ্যে অতিথিদের পছন্দের তালিকায় সেরা গঙ্গাপাড়ের শহর কন্নৌজের আভিজাত্য।
এক দেশ, এক ভোট, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে যখন এত জোর তর্ক-বিতর্ক, উপহার বাছার ক্ষেত্রে কিন্তু সে পথে হাঁটেননি নরেন্দ্র মোদি। বরং তালিকা দেখলে বোঝা যায় ভারত যে বহু বৈচিত্র, রং, সংস্কৃতি এবং দর্শনের দেশ, তা বোঝাতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বলতে চেয়েছেন বসুধৈব কুটুম্বকম।
সিন্দুক শব্দটি বাংলা তো বটেই ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাতেই ব্যবহৃত হয়। হিন্দিতেও। সিন্দুক যার মধ্যে ধনসম্পত্তি সুরক্ষিত থাকে। ধনীরা তো আগে টাকা-পয়সা, গয়না, জহরত, দলিল সব সিন্দুকেই রাখতেন। নরেন্দ্র মোদির উপহারের তালিকায় প্রথমেই একটি সিন্দুক। শীশম কাঠের তৈরি, সঙ্গে খাঁটি পিতলের পাত বসানো। পাতের উপর ভারতীয় নকশার কারুকাজ। শীশম কাঠ কেন? কেননা এই কাঠ অত্যন্ত মজবুত আর টেকসই। বছরের পর বছর ঘুন ধরে না। অনেকে শীশম কাঠকে গোলাপকাঠ বলে থাকে। এর সুগন্ধের জন্য। কাঠের রং হয় উজ্জ্বল এবং আকর্ষণীয়। আর সিন্দুক খুলতেই চিঁচিং ফাঁক। যেন আলিবাবার গুহা।
আরও পড়ুন : ‘মন কি বাত’ শুনেই জন্ম উত্তরীয়র? জি২০ অতিথিদের এই বিশেষ ‘অঙ্গবস্ত্র’ আসলে কী?
সিন্দুকের ভিতর আরও একটি ছোট কাঠের-বাক্স। ক্লিপ আঁটা। আবার সেটা খুলতেই ভিতরে দেশের সেরা, উৎকৃষ্ট মানের চা-পাতার আলাদা আলাদা দু'টি টিনের বাক্স। একটা তামিলনাড়ু, কেরলের নীলগিরি পাহাড়ের চা। অন্যটি, হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন,দার্জিলিংয়ের। চা-চর্চা যখন হচ্ছে, তখন কফিই বা বাদ যাবে কেন। সিন্দুকে রয়েছে দু'রকমের কফি। বিশ্বের অন্যতম সেরা অন্ধ্রপ্রদেশের আরাকু উপত্যকার কফি। সম্পূর্ণ জৈবিক উপায়ে চাষ করা হয় আরাকুর কফি। কফির বীজে লেগে থাকে উপত্যকার মাটি আর জলবাতাসের গন্ধ। আরাকুর কফি চাষ হয় ছোট ছোট বাগানে। কৃষকেরা প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত রেখে কফি উৎপাদন করে থাকেন। কোনও রকম রাসায়নিক বা কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। এমনকি কফিবীজ বোনা বা সংগ্রহের সময় কোনও যন্ত্রকেও ব্যবহার করেন না আরাকুর কৃষকেরা। এই জন্য বিশ্ৱের বাজারে আরাকু উপত্যকার কফির এত কদর। যেমন তার গন্ধ তেমনই স্বাদ।

অতিথিদের হাতে মোদির উপহার কাঠের সিন্দুক। তার উপরে পিতলের কারুকাজ
আরাকু উপত্যকা থেকে বাংলার ম্যানগ্রোভ অরণ্য। সুন্দরবন। যে গহীন অরণ্যের খাঁড়িতে এসে মিলেছে গঙ্গা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র। খলিশা, সুন্দরী, গরান গাছের ছায়াঘেরা পরিবেশ। আর গাছের গায়ে মৌমাছিদের সংসার। সুন্দরবনে যাঁরা শীতকালে খেজুর রস সংগ্রহে যান তাঁদের বলে শিউলি। আর যাঁরা মধু সংগ্রহে, তাঁদের মউলি। যুগ যুগ ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম মউলিরা গিয়েছেন সুন্দরবনের গভীরে খাঁটি মধু সংগ্রহে। খালিশার যে ফুল, গরানের ফুল তা থেকে মৌমাছিদের সংগ্রহ করা যে মধু, তা সুন্দরবনকে দিয়েছে সেরার সম্মান। অতিথিদের দেওয়া সিন্দুকের ভিতর তাই সুন্দরবনের খাঁটি মধু দিতেও ভারতের ভুল হয়নি। আর মধুর যে কত গুণ, তা লিখে শেষ করা যায় না।
উপহারে ছিল কাশ্মীরের দুই অকৃত্রিম সম্ভার। পশমিনা আর জাফরান। জাফরান ফারসি বা পার্শি শব্দ। হিন্দিতে যা কেশর। পৃথিবীর সভ্যতায় বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সংস্কৃতিতে জাফরানের এক আলাদা আসন। রন্ধনশিল্পে জাফরান যেমন এক কুলীন মশলা। তেমনই জাফরানের ওষধি গুণও প্রাচীন কাল থেকে সমাদৃত। সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থায় জাফরান বা কেশর উৎকণ্ঠা, বিষাদ তাড়ায়। শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ সরবরাহ করে। রক্ত সঞ্চালন ঠিক রাখে। প্রদাহ, ব্যথায় উপশম দেয়। কাশ্মীরের জাফরান সেই অর্থে এক কথায় এক্সক্লুসিভ। যেমন তার রং, তেমনই তার সুগন্ধ। কাশ্মীরের জলহাওয়া, মাটি এখানকার জাফরানকে এত সমৃদ্ধ করেছে।
সমুদ্রপিঠ থেকে একমাত্র ১৪ হাজার ফিটের উপর যে সমস্ত ছাংথাংগি ছাগল, তাদের লোম দিয়েই তৈরি হয় পশমিনা। পশম কথাটি ফারসি বা পার্শি থেকে এসেছে। পশম মানে উল। ছাংথাংগি ছাগল বিশ্বে 'ক্যাশমেয়ার গোট' হিসেবে খ্যাত। লোম সংগ্রহের পর স্থানীয় শিল্পীরা তাঁদের চিরাচরিত পদ্ধতিতে একেবারে হালকা, নরম এই শাল তৈরি করে থাকেন। যুগান্তর পেরিয়ে এসেছে তাঁদের এই হস্তশিল্প। প্রাচীন ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে রাজ দরবারে বা আইনসভায় বিশেষ মর্যাদা রয়েছে এমন চরিত্রের শরীরে পশমিনা জড়িয়ে থাকত। পশমিনা আভিজাত্যের প্রতীক।
আরও পড়ুন : দ্রৌপদীর ডিনারে নিরামিষ ‘ভারত’, শেষপাতে ‘মধুরিমা’
কন্নৌজকে বলা হয়ে থাকে সুগন্ধের রাজধানী। জি-২০-এর অতিথিদের উপহার-বাক্সে সেই সুগন্ধ পৌঁছে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। যে সুগন্ধের মাদকতা ইর্ষনীয়। মোহগ্রস্ত, নেশাতুর করে তোলে মুহূর্তে। স্মৃতিসুখ নিয়ে সঙ্গে থেকে যায় দীর্ঘ দিন। জিঘরানা ইত্তর বা আতর। আতর অর্থাৎ সুগন্ধ। কন্নৌজ শহরের ট্রেডমার্ক। কী কী উপাদান রয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই সুগন্ধে? জ্ঞানী, প্রাজ্ঞ সুগন্ধী প্রস্তুতকারকেরা বলেন, আতর হচ্ছে ধৈর্য্য, সংযম আর পরিমাপের এক অর্কেস্ট্রা। খুব ভোরে সূর্যের আলো যখন অনেক নরম, তখন এর উপকরণ সংগৃহীত হয়। ফুলের পাপড়ি সংগ্রহ করেন সুগন্ধী প্রস্তুতকারকেরা। যে পাপড়িতে হয়ত তখনও লেগে থাকে শিশির, শবনমের খুশবু। সেই পাপড়ি থেকেই পাতন পদ্ধতিতে বের করা হয় সুগন্ধের নির্যাস। তারপর সেই সুগন্ধী তেলকে দীর্ঘদিন ধরে পরিচর্যা করা হয়। স্তরে স্তরে ফুটে ওঠে সুগন্ধ। সিন্দুকে করে সেই সুগন্ধ সঙ্গে নিয়ে সাত সাগর পাড়ি দিয়েছেন জি-২০-এর অতিথিরা।