হারাধনের চিতাদের নতুন ঠাঁই, ঘরছাড়া হবেন না তো কয়েক হাজার গ্রামবাসী?
Project Cheetah: আগামী জানুয়ারি মাসে আরও দশটি চিতা আনার পরিকল্পনা রয়েছে। যাদের প্রথম থেকেই রাখা হবে মধ্যপ্রদেশের নিমুচ ও মন্দসৌর জেলার সীমান্তে অবস্থিত গান্ধী সাগর অভয়ারণ্যে।
আজ থেকে বছর সত্তর আগে নাকি এই ভারতের বুকে দিব্যি ঘুরে বেড়াত চিতারা। ক্রমে কমতে কমতে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় দেশ থেকে। দেশের সেই হৃত গৌরব ফেরাতে সুদূর আফ্রিকা থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে উড়িয়ে আনা হয়েছিল আট-আটটি চিতা। রাখা হয়েছিল মধ্যপ্রদেশের কুনো ন্যাশনাল পার্কে। পরের বছর উড়িয়ে আনা হয় আরও ১২টি দক্ষিণ আফ্রিকান চিতা। মোট ৫০টি চিতা পাঁচ বছরে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং নামিবিয়া থেকে ভারতে নিয়ে আসার পরিকল্পনা নিয়েছিল মোদি সরকার। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এখনও পর্যন্ত ভারতে এসে গিয়েছে মোট ২০টি চিতা। তার পর যে কী থেকে কী হইয়া গেল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির স্বপ্নের চিতারা কমতে লাগল একের পর এক। এখনও পর্যন্ত টিকে রয়েছে মাত্র হারাধনের গোটা কয়েক চিতা। আপাতত তাদের বাঁচাতেই মরিয়া মোদি সরকার। কুনোয় এসে থেকে টিকে যাওয়ার তেমন কোনও সুখবর দিতে পারেনি চিতার দল। বরং ক্রমশ কমতে থাকা সংখ্য়াগুলো বিরোধীদের হাতে তুলে দিয়েছে একের পর এক অস্ত্র। ফলে এই পরিস্থিতিতে আশু কর্তব্য, চিতাদের বাসা পাল্টানো।
সেই মতোই বাসা বদল হতে চলেছে সুদূর আফ্রিকা থেকে উড়ে আসা চিতাবাহিনীর। না, রাজ্য পাল্টাচ্ছে না। কুনো থেকে আপাতত গান্ধী সাগর অভয়ারণ্যে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দেখা যাক, তাতে চিতা এবং ভারতের ভাগ্য ফেরে কিনা। ইতিমধ্যেই সারা হয়ে গিয়েছে সব প্রস্তুতি। ২০২২ সালে নিজের ৭২তম জন্মদিনে নিজেই নিজেকে উপহার দিয়ে বসলেন মোদি। সুদূর আফ্রিকা থেকে উড়ে এসে মধ্যপ্রদেশের শেওপুর জেলার কুনো ন্যাশনাল পার্কে জুড়ে বসল আটটি নামিবিয়ান চিতা। তার পরে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আরও ১২টি দক্ষিণ আফ্রিকান চিতা। কুনো ভরে উঠল চিতায়। তারপর! মার্চের শেষ সপ্তাহেই নামিবিয়া থেকে আনা চিতা সিয়া আবার চারটি শাবকের জন্ম দিলে। চিতার সংখ্যা বেড়ে হল ২৪। তবে তার কিছুদিন যেতে না যেতেই তিনটি শাবকের মৃত্যু হয়। ততদিনে মারা দিয়েছে পূর্ণবয়স্ক আরও ৬টি চিতা। আপাতত মেরেকেটে কুনো জাতীয় উদ্যানে ১৪টি চিতা ও একটি শাবক রয়েছে।
আরও পড়ুন: কোথায় গেল শেষ চিতা নির্ভা? কেন আফ্রিকা থেকে আনা একের পর এক চিতার মৃত্যু ঘটছে ভারতে?
এখনও পর্যন্ত আনা চিতাদের সামলাতে এবং প্রাণে বাঁচাতেই হিমশিম খাচ্ছে বনদফতর। এরই মধ্যে আবার আগামী জানুয়ারি মাসে আরও দশটি চিতা আনার পরিকল্পনা রয়েছে। যাদের প্রথম থেকেই রাখা হবে মধ্যপ্রদেশের নিমুচ ও মন্দসৌর জেলার সীমান্তে অবস্থিত গান্ধী সাগর অভয়ারণ্যে। ইতিমধ্যেই সারা হয়ে গিয়েছে সব প্রস্তুতি। প্রায় ৩০ কোটি টাকা খরচ করে ঘেরা হচ্ছে ৬৭ বর্গকিলোমিটারের একটি জায়গা। আগামী মাসের মধ্যেই সেই কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে চিতা আসার খবর যবে থেকে শুনেছেন, ঘুম উড়েছে গান্ধীসাগরের বাসিন্দাদের। গান্ধীসাগর অভয়ারণ্য লাগোয়া এলাকায় রয়েছে তিন-তিনটি গ্রাম। চইনপুরিয়া, রাভালিকুড়ি ও পাথর। সব মিলিয়ে প্রায় ৪৫২টি পরিবারের বাস সেই গ্রামপঞ্চায়েত এলাকায়। মোটামুটি আড়াই হাজার বাসিন্দা ধরা যেতে পারে, যাদের অধিকাংশরই জীবিকা কৃষিকাজ ও পশুপালন। গ্রামের প্রতি ঘরে ঘরে গবাদি পশুর খামার। মোটামুটি প্রতিটি গ্রামবাসীর কাছে ৭০-১০০টি করে গবাদি পশু তো রয়েইছে। বেশির ভাগই গোরু, বাদবাকি ছাগল ও মহিষ।
চিতা আসার খবরে আনন্দের চেয়ে দুশ্চিন্তাই চেপে ধরেছে ওই সব এলাকার মানুষদের। এমনিই গ্রামে কষ্টের শেষ নেই। পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ নেই। সেচের জলের অভাব, তার উপর জমির অধিকার নিয়ে সমস্যা লেগেই রয়েছে গ্রামে। এর মধ্য়ে আবার গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিতে চলেছে চিতারা। হ্যাঁ, গবাদি পশুর উপর চিতার হামলার সম্ভাবনা তো রয়েইছে। পাশাপাশি দুগ্ধচাষীদের অভিযোগ,যে জায়গাটিকে পাথরের দেওয়াল ও তারের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে, সেখানেই গরু, ছাগল চড়াতে যেতেন তাঁরা। জঙ্গলে গবাদি পশু চড়ানোর ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রায় প্রতিটি জঙ্গলেই আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারা পশু চড়াতে যান। জঙ্গলে বাঘ থাকলেও, বাঘের গতিবিধি বাসিন্দা ও বনকর্মীদের জানা। খুব অঘটন না ঘটলে নিজেদের চেনা রাস্তাতেই যাতায়াত করতে পছন্দ করে বাঘ। কিন্তু এই আফ্রিকান চিতাদের গতিবিধি বা ধরনধারন কিছুই জানেন না গ্রামবাসীরা। ফলে সেটা তাদের জন্য একটা নতুন দুশ্চিন্তা।
সরকার অবশ্য সে ব্যাপারটি নিয়েও ভেবে রেখেছে। তারা ইতিমধ্যেই গরুপালনের জন্য একটি নতুন আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে। প্রতিটি গ্রামপঞ্চায়েতেই তাদের জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রকল্প। তবে শুধু তো গরু নিয়ে তো আর কারবার নয়। অথচ ছাগল বা মহিষ নিয়ে তেমন ভাবিত নয়। অথচ ওই সব গ্রামের অজস্র পরিবারের প্রধান জীবিকা দুগ্ধবিক্রয়। সুধা বাই নামে এক দুগ্ধবিক্রেতার পরিবার জানান, আমাদের ৫৫টি গরু রয়েছে। বাদবাকি ২৫টি ছাগল ও মহিষ। চিতার দৌলতে খাবারের অভাবে তাদের প্রাণসংশয় হওয়ার আতঙ্কে বাঁচছেন এখন ওই সব গ্রামের মানুষ।
আরও পড়ুন: ফের চিতা মৃত্যুর ঘটনা কুনোয়, অসুস্থতা নাকি অন্য কিছু, কেন অকালে মারা যেতে হল স্ত্রী চিতাটিকে?
গান্ধী সাগর অভয়ারণ্যের উপর এমন ভয় নতুন নয়। বছর পঞ্চাশ আগে গান্ধী সাগর বাঁধ তৈরির সময় সমস্ত কিছু ছেড়ে যেতে হয়েছিল গ্রামের মানুষকে। জমিজিরেত বাড়িঘর ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল মানুষকে। সেখান থেকে আজকের এই কৃষি ও পশুপালনের ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহের জায়গায় পৌঁছেছেন মানুষ। এখন সরকার যদি ফের গবাদি পশু চড়ানোর অধিকার থেকে তাঁদের বঞ্চিত করে, ফের নতুন করে জায়গা খুঁজতে হবে মানুষকে। ফলে গান্ধীসাগরের মানুষের কাছে এই চিতার আগমন যেন ফের বিপদের মেঘ। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানকে চিঠি লিখে নিজেদের সমস্যার কথা জানিয়েছেন তাঁরা। স্থানীয় জেলাশাসকের কাছেও দরবার করা হয়েছে। প্রতিবাদ, আবেদন, স্মারকলিপি- সব কিছুর শেষেও কি মিটবে গ্রামবাসীদের সমস্যা। ভারতের গর্বের চিতা কি কেড়ে নেবে স্থানীয় গ্রামবাসীদের জীবিকাটুকু, তাদের গবাদি পশুর চারণভূমিটুকু! সেই প্রশ্নটাই এখন ঘুরপাক খায় গান্ধীসাগরের ওই সব গ্রামের হাওয়ায়।