'মাই নেম ইজ গওহরজান', চিৎকার করে বলতেন যে নিঃসঙ্গ অপরাজিতা...
উস্তাদ ফৈয়জ খাঁ সাহেবের সঙ্গে একবার জোহরা বাঈ আগ্রেওয়ালির তুলনা করেছিলেন কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। মুখে মৃদু হাসি নিয়ে তিনি বলেছিলেন, 'ফৈয়জ খাঁ যদি হন ফতেপুর সিকরির বুলন্দ দরওয়াজা, জোহরা বাঈ তাহলে সাক্ষাৎ তাজমহল'। আগ্রা ঘরানার এই বিদুষীর গৌড় সারঙের রেকর্ডে সত্যিই যেন এসে মিলছে তাজমহলের প্রণয়-বিষাদ। কী অপূর্ব তার গোলা বারুদের মতো তান ফেরতা। আর শুধু জোহরা বাঈ কেন, এমন কত অপরূপ রাজেশ্বরীর কণ্ঠস্বর যে সে সময় শ্রোতার বৈঠকখানা আলো করে থাকত, তার তালিকা দিয়ে শেষ করা যাবে না। যেমন ধরা যাক গওহরজান। শোনা যায়, এই গ্রামোফোন সম্রাজ্ঞীর কণ্ঠস্বরের মধ্যে দিয়েই শাস্ত্রীয় সংগীতের ডিস্ক-যুগের আগমন। আরবি ভাষায় যোগিয়া রাগের ঠুমরি গেয়ে তিনি যে নতুন ধারার সূচনা করলেন, তার জের চলেছিল এক দীর্ঘ সময় জুড়ে। রেকর্ডিং যুগের ইতিহাস ঘাঁটলে আজও মিলবে সেই সুরেলা গলার মাধুর্য। যে মহাজীবনের সুরের এমন আশ্চর্য তাসীর, তাঁর যাত্রাপথও ছিল বর্ণময়। আজমগড় থেকে কলকাতা, মাত্র ৫৬ বছরের জীবনে তাঁকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল নানান কিসসা কাহিনি।
১৮৭৩ সালে উত্তর ভারতের আজমগড়ে জন্ম হল এক শিশুকন্যার। বাবা-মা ভালোবেসে তার নাম রাখলেন এলিন এঞ্জেলিনা ইওয়ার্ড। শৈশব থেকেই এলিনের মধ্যে ঘটেছিল তিন সংস্কৃতির মিশেল কারন তার ঠাকুমা ছিলেন হিন্দু, ঠাকুরদা ছিলেন ব্রিটিশ এবং বাবা আর্মেনিয়ান। এলিনের বয়স যখন ছ বছর তখন তার বাবা মা'র মধ্যে শুরু হল দাম্পত্য কলহ। অল্পদিনের মধ্যেই তাঁদের বিয়ে ভেঙে গেল। একমাত্র কন্যাসন্তানকে নিয়ে এলিনের মা ভিক্টোরিয়া হেমিংস পড়লেন বিপদে। কী করবেন, কোথায় যাবেন কিছুই জানেন না। এ অবস্থায় খুরশিদ নামক এক পরিচিতের সঙ্গে তিনি মেয়েকে নিয়ে এসে বারাণসী পৌঁছলেন। শিল্প সংস্কৃতির শহর কাশী। অল্পদিনের চেষ্টাতেই ভিক্টোরিয়া সেখানে তওয়ায়েফের কাজ জুটিয়ে নিলেন, সন্তান--সহ ধর্মান্তরিত হলেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর তাঁর নামকরণ হল বড়ি মলকাজান এবং তাঁর মেয়ে এলিন হয়ে উঠলেন গওহরজান।
আরও পড়ুন-৩২৫ রকম কায়দায় শাড়ি পরাতে পারেন! বলিউড তারকারাও কুর্নিশ করেন ডলিকে
গানবাজনার শখ গওহরের শৈশবকাল থেকেই ছিল, কিন্তু প্রথাগত তালিম তিনি পেলেন কলকাতা শহরে এসে। তাঁর জন্মের তিন দশক আগে ইংরেজদের বিচারে লখনউ থেকে নির্বাসিত হয়ে কলকাতায় ঘাঁটি গেড়েছিলেন আওয়াধের শেষ নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ। মেটিয়াবুরুজে তাঁর প্রাসাদে তখন প্রত্যেকদিন চাঁদের হাট বসে। অষ্টপ্রহর নামকরা শায়েরদের আনাগোনা তো লোগেই থাকে, এ ছাড়াও আসেন ভারতবিখ্যাত সমস্ত বাঈজীরা। ঠিক এমন এক সময় মা'কে নিয়ে গওহর জান সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। গানবাজনার তালিম পেতে লাগলেন হিন্দুস্থানের সেরা তওয়ায়েফদের কাছে। অল্পবয়স থেকে তিনি মা'কে দেখেছেন কোঠিতে সুর আর লয়ের ঝড় তুলতে, ফলত সংগীত তাঁর রক্তে ছিলই। খাঁটি তালিমের গুণে প্রতিষ্ঠিত হতে বেশিদিন সময় লাগল না গওহরের।
১৮৮৭ সালে দারভাঙ্গার রাজদরবারে প্রথম জনসমক্ষে গাইলেন তিনি, সে গান শুনে আসরে হইহই। তারপর ১৮৯৬ থেকে কলকাতায় তাঁকে ঘিরে জলসা লেগেই থাকত। গওহরজান যখন নিছক একজন তওয়ায়েফ থেকে পরিণত হচ্ছেন খ্যাতনামা হস্তিতে, তখন মার্কিন মুলুকে ওয়াশিংটন ডিসিতে ঘটছে আরেক কাণ্ড। ১৮৮৭ সালে এমিল বার্লিনার নামক এক ভদ্রলোক আবিষ্কার করলেন ফ্ল্যাট ডিস্ক। সমস্ত রকম রেকর্ডিংয়ের ক্ষেত্রে এর আগে ব্যবহার করা হত সিলিন্ডার। ফ্ল্যাট ডিস্কের আবির্ভাবের ফলে তার প্রভাব কমে গেল। ১৮৯৭ সালে বার্লিনার তৈরি করলেন 'দ্য গ্রামোফোন কোম্পানি' নামক একটা সংস্থা, তারপর তাঁর এজেন্ট ফ্রেডরিক গাইসবার্গ ভারত ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লেন, রেকর্ডিংয়ের জন্য 'নেটিভ ভয়েস' খুঁজতে। গওহরজানের নাম তখন ভারতবর্ষে বেশ ছড়িয়ে পড়েছে, এমন সময় গাইসবার্গ তাঁকে গ্রামোফোন কোম্পানির জন্য গাইতে প্রস্তাব দিলেন। তাঁর সাফ কথা, 'গাইব নিশ্চয়ই, কিন্তু তিনটি হাজার টাকার কমে নয়'। বিশ শতকের তখন সবে শুরু। 'দুবছরও কাটেনি। এ সময় তিন হাজার টাকার হিসেব আজকের দিনে কত দাঁড়াবে কল্পনাও করা যায় না। গাইসবার্গের বাধ্য ছেলের মতো রাজি হওয়া ছাড়া আর উপায় ছিল না। বাঈজীদের দেমাক কী জিনিস এবং তাঁদের চটালে তার ফল কী হতে পারে তা তিনি জানতেন।
সালটা ১৯০২, বঙ্গভঙ্গের তখনও তিন বছর দেরি। শুরু হল গওহরের রেকর্ডিংয়ের প্রস্তুতি। টেকনিশিয়ানদের নির্দেশে গানের শেষে তিনি চেঁচিয়ে ঘোষণা করলেন 'My name is Gauhar Jaan' । এই ঘোষণা শুনেই তাঁর রেকর্ডের উপর সাদা কালো ছবিতে বসবে নামের লেবেল। গওহরের রেকর্ড প্রকাশিত হওয়ার পর ভারতীয় মার্গ সংগীতের এক অন্য অধ্যায় শুরু হল। অচিরেই রাজা পঞ্চম জর্জের সামনে গাইবার জন্য তিনি ডাক পেলেন দিল্লির দরবারে। গওহরের তখন বৈভবের দিনকাল। দু'হাতে টাকা ওড়ান তিনি। কারণে অকারণে দাওয়াত দিয়ে নিমন্ত্রণ করেন কলকাতার গণ্য মান্য ব্যক্তিদের। এ সময় বেড়ালের বাচ্চা হলে সেই উপলক্ষে তাঁর এক পার্টিতে খরচ হত কুড়ি হাজার টাকা। চার ঘোড়ার ফিটন চেপে সারা কলকাতা ঘুরে বেড়ানো গওহর তখন অক্ষরিক অর্থে মধ্য গগনের সূর্য। এমনই তাঁর খ্যাতি যে অস্ট্রিয়ার দেশলাই বাক্সর উপরেও তাঁর ছবি দেখা যায়। একদিন গাইসবার্গ 'ফাউস্ট' অপেরার একটা গান শুনিয়ে তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানালেন। এমন একটা গান গেয়ে শোনাতে হবে যাতে একবারের জন্য দম ফেলার ফাঁক পড়বে না। গওহর হাসিমুখে ধরলেন সুর মল্লারের একটা বন্দিশ। এক নিঃশ্বাসে গেয়ে চললেন অনবরত। সেই শুনে গাইসবার্গের চক্ষু ছানাবড়া। দশটি ভাষায় ৬০০-র বেশি গান রেকর্ড করেছিল গওহরজান।
আলোকোজ্জ্বল বৈভবের বিপরীতেও অন্ধকার থাকে। খালি চোখে তাকে দেখা যায় না সবসময়। গওহরের ঐশ্বর্যের আড়ালে এই অন্ধকার ই তাঁকে তিলে তিলে শেষ করছিল। একের পর এক সম্পর্কে জড়াচ্ছিলেন তিনি এবং শিকার হচ্ছিলেন বিশ্বাসঘাতকতার। অবশেষে নিজের সেক্রেটারি আব্বাসের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় কিন্তু সে সম্পর্কও বেশিদিন টেকেনি। অল্পদিনের মধ্যেই গওহর আব্বাসের নামে কোর্টে ফোরজারির অভিযোগ আনেন। কেস চলে দীর্ঘদিন ধরে। সে কেস তিনি জিতেও যান, কিন্তু তাঁর সমস্ত টাকা খরচ হয়ে যায় জলের মতো। একসময় মর্জি মতো নিয়ম ভেঙে ইংরেজ সরকারকে ফাইন দিতে যাঁর দৈনিক খরচ হত এক হাজার টাকা, তাঁর জীবনে নেমে আসে চরম দারিদ্র। গওহরজানকে ভিখিরির দশাও দেখতে হয়েছে। এই কষ্ট অবশ্য তাঁকে খুব বেশিদিন ভোগ করতে হয়নি। ১৯৩০ সালে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে মহীশূরের কে.আর. হাসপাতালে তিনি ভগ্ন শরীরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ভৈরবীর 'রসকে ভরি তোরি ন্যান' গেয়ে শ্রোতাদের কাঁদিয়ে গওহর জান চলে গেলেন না ফেরার দেশে। এভাবেই মহাকাব্য ফুরোয়, ট্র্যাজেডির স্তব্ধতা নিয়ে। যেমনটা দেখা যায় মেহেদী হাসানের শেষ সাক্ষাৎকরে। সমস্ত জীবন যিনি উৎসর্গ করেছেন সংগীতকে তাঁর কণ্ঠস্বর তখন বুজে এসেছে। হাজার চেষ্টাতেও গলায় ফুটছেনা সুর।অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ক্যামেরার দিকে। চোখ দিয়ে একটু একটু করে জল গড়িয়ে পড়ছে।