এই মৃত্যু যেন আপনার ঘুম কেড়ে নেয়...

Israel Gaza Conflict : প্রিয় পোষ্য, বাসনপত্র, পরিবার সব একসঙ্গে নিয়ে একটাই ঘোড়ার গাড়িতে চেপে পালাচ্ছেন। সেই গাড়ির চালকও পালাচ্ছেন।

এত অসহায় কখনও লাগেনি! এত হিংস্রও মনে হয়নি নিজেকে কখনও। নিজের চোখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমাদের জীবনের কোনও মূল্য নেই। এক সপ্তাহ হয়ে গেল। প্রতিটা দিন বোমার আওয়াজে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসছি। ইজরায়েলের থেকে নির্দেশ এসেছে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খালি করে দিতে হবে গাজার উত্তর এলাকা। এখানে নাকি সাধারণ মানুষের বাড়ির নীচে নীচে হামাসের জঙ্গিরা আশ্রয় নিয়ে রয়েছে। জঙ্গিদের শেষ করতে হলে ধ্বংস করে দিতে হবে সব। মানুষ পালাচ্ছে, কোথায় যে পালাচ্ছে কে জানে! কীভাবে পালানো সম্ভব সব ছেড়ে? এখানে হাসপাতালগুলো পর্যন্ত বোম মেরে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে! অবশ্য হাসপাতাল থেকেই বা কী? জরুরি কোনও পরিষেবা, ওষুধ, রক্ত কিছুই তো পাওয়া যাচ্ছে না সেখানে। ওষুধ নেই, জল নেই, বিদ্যুৎ নেই, খাবার নেই। এই নেই রাজ্যে ক'দিনই বা বাঁচবে মানুষ?

আমরা কিছুক্ষণ আগে পৌঁছেছি আমাদের এক বন্ধুর বাড়িতে। এখানে সামান্য খাবার জল এখনও রয়েছে। আমি ২৪ ঘণ্টা কোনও খবর দেখিনি, আমি জানি না আমার আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে কারা বেঁচে আছেন এখনও। আমাদের কাছে এখন একটাই প্রত্যাদেশ। বাঁচতে হলে গাজা স্ট্রিপ ছাড়তে হবে আর গাজায় থাকলে কোনও অস্তিত্বই রইবে না। আমাদের আশা ক্রমেই নিভে আসছে, ফোনে চার্জও বেশিক্ষণ রইবে না জানি। একটু বাদেই আমি সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব। এমন দিন যে আসতে পারে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। গোট বিশ্ব দেখুক, আমাদের সঙ্গে কী অন্যায় হচ্ছে। আমাদের কোনও আত্মীয় যদি এখন মরতে বসেন, তাঁকে হাসপাতালেও পাঠানো যাবে না। তিলে তিলে মরতে দেখতে হবে, কারণ হাসপাতালে না আছেন ডাক্তার, না আছেন কোনও কর্মী, না আছে পর্যাপ্ত ওষুধ!

আরও পড়ুন- হাসপাতাল থেকে আর কখনও ফিরবে বাবা? গাজায় পথ চেয়ে একরত্তি মেয়ে

অনেকক্ষণ কোনও ইন্টারনেট ছিল না, সামান্যক্ষণ হলো নেটওয়ার্ক পেয়েছি। তাই লিখতে পারছি। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে আমার। আবার নেটওয়ার্ক চলে যাবে জানি। এখানে কী চলছে, গাজার মানুষ কীভাবে দিন কাটাচ্ছে কেউ বুঝতেই পারবেন না হয়তো! মৃত্যুর ভয়, পরিবারের দায়িত্ব, নিজের প্রাণ, সন্তানের যত্ন, সমস্ত মাথায় নিয়ে অনিশ্চিত জীবন কাটানো কাকে বলে আমরা বুঝছি। আসলে গাজা জুড়ে এথনিক ক্লিনজিং চলছে, সারা বিশ্বের সামনে প্রকাশ্যে নির্মূল করার কাজ চলছে। একটি সভ্য বিশ্বে এই ঘটনা ঘটছে। ২০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটতে চলেছে বিশ্বের চোখের সামনে। এই হচ্ছে বাস্তবতা, এই হচ্ছে গাজার মানুষদের এই মুহূর্তের অবস্থা। গাজা পৃথিবীর অন্যতম ঘন বসতিপূর্ণ অঞ্চল, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে পৃথিবীর মধ্যে তৃতীয় সর্বাধিক ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল এটিই। এখানে কী ঘটতে পারে অনুমান করতেও কি পারবেন আপনারা?

সবাই ভাবছেন, ইজরায়েল আগে থেকে জানান দিয়ে, এই মানুষদের উত্তর গাজা থেকে দক্ষিণে সরে যেতে বলে প্রাণ বাঁচাতে চাইছে নিরস্ত্র মানুষদের। আসলে কী চলছে জানেন? যে সব মানুষদের দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে, যারা বিদেশি রয়েছেন এখানে, কেবল তাঁদেরই সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমাদের মতো বাকিরা, তাঁদের কোনও মূল্য নেই। আমাদের কথা কে ভাববে? আমরা কোথায় যাব? কোথায় নিরাপদে জল পাব, খাবার পাব? কেউ ভাবছেন না। ভাববেনই বা কেন, এভাবেই তো সারা পৃথিবী চলে। গাজা কি কোনও ব্যাতিক্রম নাকি!

আরও পড়ুন- হুইলচেয়ারে বসেই পাথর ছুড়ে প্রতিবাদ! বিশ্বকে ধাক্কা দেয় প্যালেস্তাইনের যে লড়াই

গাজা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। একে একে করে সমস্ত পাড়া গুঁড়িয়ে যাচ্ছে দেখছি, প্রতিবেশীদের চিৎকার, কান্না শুনছি। মনে হচ্ছে, চুপচাপ, সমস্ত আশা জলাঞ্জলি দিয়ে বসে আছি কখন আমার ঠিক পাশে বোমা পড়বে, ছিন্নভিন্ন হয়ে যাব সবাই। আশ্চর্য দিন কাটছে, আশ্চর্যতম রাত। যাঁদের নিজস্ব গাড়ি আছে তাঁরা সেই গাড়িতে, কেউ ঘোড়ায় টানা গাড়িতে, যাঁদের সামর্থ্য নেই তাঁরা পায়ে হেঁটেই পালাতে চাইছেন, ছুটছেন রুদ্ধশ্বাস। সকলে শহর ফাঁকা করে প্রাণ বাঁচাতে চাইছেন। প্রিয় পোষ্য, বাসনপত্র, পরিবার সব একসঙ্গে নিয়ে একটাই ঘোড়ার গাড়িতে চেপে পালাচ্ছেন। সেই গাড়ির চালকও পালাচ্ছেন। তিনিও কিন্তু আর সওয়ারি তুলতে ফিরে আসবেন না। একই ঘটনা ঘটানো হয়েছিল ইরাকের সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে এই অন্যায় করে যাওয়ার মাশুল দিতে হবেই। একদিন গোটা বিশ্বের সামনে নতজানু হয়ে ক্ষমা চাইতে হবে।

আমি জানি আমি প্রচণ্ড বিধ্বস্ত হয়ে আছি। মৃত্যুর এত কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বোধহয় সংযম রাখা যায় না। এত কাছ থেকে মানুষকে নিশ্চিহ্ন হতে দেখলে, শিশুদের শেষ হয়ে যেতে দেখলে, নিজের সমস্ত আশা, ভালোবাসাকে গণকবরে যেতে দেখলে বোধহয় খুব গুছিয়ে কথা বলা যায় না। আমি এই মুহূর্তে চাইছি, এই যে আপনাদের মোবাইলে, টিভির পর্দায় আমাদের মৃত্যুর, আমাদের ধ্বংসের ছবি প্রতিনিয়ত ভেসে উঠছে, তা যেন আজীবন আপনাদের জ্বালিয়ে মারে, আজীবন শান্তিতে জিরোতে না দেয়।

More Articles