হাসপাতাল থেকে আর কখনও ফিরবে বাবা? গাজায় পথ চেয়ে একরত্তি মেয়ে
Israel-Gaza War: গত সাত দিনে অন্তত পাঁচশো শিশুর মৃত্যু হয়েছে গাজায়। বাবা-মা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, তাঁদের সন্তানকে চারপাশের পরিস্থিতি থেকে, অসংখ্য মৃত্যুমিছিলের অভিশাপ থেকে বাঁচানোর। কিন্তু তেমনটা ঘটছে না আদপেই।
যুদ্ধের আঁচে ছাড়খার গাজার শৈশব। হঠাৎ করেই লেগে গেল যুদ্ধটা। ইজরায়েলের সঙ্গে প্যালেস্টাইনের সংঘাত আজকের নয়। সেই সংঘাতকে উস্কেই অতর্কিতে ইজরালের বুকে আঘাত হেনেছিল হামাস জঙ্গিবাহিনী। আর তার পরেই প্রত্যুত্তর দেওয়ার জন্য সমস্ত শক্তি লাগিয়ে দিয়েছিল ইজরায়েল। হামাসের শেষ না দেখে ছাড়বে না তারা।
তার পর থেকে মুহূর্মুহু গাজায় আক্রমণ শানিয়েছে ইজরায়েল। ধেয়ে এসেছে রকেট। এমনকী একদিন আগেই ইজরায়েলের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে উত্তর গাজা থেকে সাধারণ নাগরিকদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল ইজরায়েল। যে কোনও মুহূর্তে গাজার বুকে নেমে আসতে পারে সর্বগ্রাসী বোমা। সেই আতঙ্কেই কাঁপছে গাজার জনজীবন। ২০২২ সালের একটি রিপোর্ট জানাচ্ছে, গাজার প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে চারজন শিশু মানসিক অবসাদ, আতঙ্ক এবং ভয়ের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে। সেভ দ্য চিলড্রেন নামে একটি সংস্থা।
জানা গিয়েছে, জীবনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ অংশই তারা কাটিয়ে দেয় সেই ট্রমা নিয়ে। তাদের মধ্যে অনেকের মধ্যেই তৈরি হয় আত্মহত্যার প্রবণতা। হবে না-ই বা কেন! প্রিয়জনদের মৃত্যু, আশপাশের শিশুদের মৃত্যু তাদের ঠেলে দেয় এক চিরকালীন নৈরাশ্যের দিকে। যার ফলে ডকে ওঠে শৈশব। এখনও পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী,গত সাত দিনে অন্তত পাঁচশো শিশুর মৃত্যু হয়েছে গাজায়। বাবা-মা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, তাঁদের সন্তানকে চারপাশের পরিস্থিতি থেকে, অসংখ্য মৃত্যুমিছিলের অভিশাপ থেকে বাঁচানোর। কিন্তু তেমনটা ঘটছে না আদপেই। সাম্প্রতিক এই যুদ্ধপরিস্থিতিতে অন্তত ১,৫০০ প্যালেস্টাইনির মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে পাঁচশোই শিশু। আর এ তথ্য দিয়েছে খোদ প্যালেস্টাইনের স্বাস্থ্যমন্ত্রক।
আরও পড়ুন: গাজার পাশে দাঁড়াবে সৌদি? সারা বিশ্বের নজর এক ফোনালাপে
প্যালেস্টাইনের গাজা শহরের বাসিন্দা ৩৫ বছরের সামাহা জাবর। সামাহ নিজে একজন মা। আপাতত নিজের বাঁচার থেকেও তাঁর সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার জায়গা তাঁর ছেলে ক্যাসি। আজকাল কেমন যেন হয়ে গিয়েছে বছর তেরোর ছেলেটা। সামান্যতম শব্দে লাফিয়ে উঠছে। জোরদার কোনও শব্দই সহ্য করতে পারছে না সে। সামাহা ছেলেকে প্রতিনিয়ত বোঝাচ্ছেন, খুব শিগগিরই এই যুদ্ধের শেষ হবে। ছেলেকে যতটা পারেন বুকে জড়িয়ে থাকেন সামাহা। শক্তি জোগানোর চেষ্টা করেন। তা-ও ছেলে কুঁকড়ে থাকে ভয়ে। ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। একেকটা বিস্ফোরণ নাম, আর সেই ভয়ঙ্কর শব্দে কেঁপে ওঠে বাড়ির প্রতিটা ইঁট।
রাফা শহরের বাসিন্দা আহলাম ওয়াদিরও পরিস্থিতি একই। দশ বছরের ছেলে ওমরকে কাছছাড়া করেন না আলহাম। ছোট্ট ওমর যখন ঘুমোয় ছোট্ট দুটো হাতে চেপে রাখে কান। নানা ভাবে ছেলের মন অন্যদিকে রাখার চেষ্টা করছেন আলহাম ও তাঁর স্বামী। নিজেদের ছোটবেলার গল্প শোনাচ্ছেন, অথচ ওমরের মন থেকে সরানো যাচ্ছে যুদ্ধের ভয়ঙ্কর প্রভাবকে। আলহামের ছোট ছেলে সায়েদকেও তিনি সাহস জোগাচ্ছেন। বাড়িতে রয়েছে বয়স্করাও। মুহূর্মুহূ গুলি, বোমা যুদ্ধের শব্দে তাঁদের অবস্থা শোচনীয়।
ছ'বছরের খুদে মেই। মেইয়ের বাবা সালেম আল-শিফা হাসপাতালের ইমার্জেন্সি রুমের দায়িত্বে। হাসপাতালে ক্রমশ বাড়ছে যুদ্ধক্রান্ত অসুস্থদের ভিড়। সেই চাপ সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলি। প্রতিরাতে বাড়ি ফেরা হয় না সালেমের। ইজরায়েল থেকে ছুটে আসা মিসাইলের আঘাতে যে কোনও মুহূর্তে নেই হয়ে যেতে পারে সালিম, সে কথা ভেবে ঘুম আসে না খুদে মেয়েটির। ছোট্ট মেই জেগে থাকে বাবার অপেক্ষায়। যুদ্ধের শব্দ, বোমা-বিস্ফোরণের শব্দ পেরিয়ে সকাল হবে বলে। সালেম একরত্তি মেয়েকে বোঝান রোজ রোজ। শক্তি দেন, সাহস জোগান। ফোনে কথা বলেন সুযোগ পেলেই। কিন্তু নিজেই কি জানেন সালেম? কী অপেক্ষা করছে ঠিক তাঁদের জন্য। সত্যিই কি তাঁর ঘরে ফেরা হবে! নাকি ঘরে ফিরে বাড়ির সকলকে দেখতে পাবেন আগের মতো। সেই আতঙ্ক বুকে নিয়েই নিজের কাজ করে চলেন সালেম।
যে বয়স খেলাধুলোর, পড়াশোনার, সে বয়সে যুদ্ধের মাটিতে প্রতিদিন বেঁচে থাকার দিন গুনতে হচ্ছে গাজার প্রতিটি শিশুকে। খান ইউনিসের বাসিন্দা রাওয়ান্দ খালাফ নিজের পাঁচ শিশুর মন যুদ্ধ থেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন সবসময়ে। নিজেদের খেলনাগুলো বুকে জড়িয়ে ঘরের এক কোণায় সিঁটিয়ে থাকে ছোটো ছোটো শিশুগুলি। চারপাশে মৃতদেহের ভিড়। মোবাইল খুললেই ক্ষতবিক্ষত দেহের ছবি। সেসব সন্তানদের থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু ওই যুদ্ধের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে তা আর কতটাই বা সম্ভব।
মিসাইল, বোমার আঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন শিশুশরীরগুলো দেখতে দেখতে ক্লান্ত গাজার বাতাসে একটাই প্রশ্ন ক্লান্ত হয়ে ঘোরে কেবল। গাজার শিশুদের জন্য কি রাখা রয়েছে এই যুদ্ধের অন্ধকারটুকুই। তাদের বাঁচার ন্যূনতম অধিকারটুকুও নেই সেখানে এখন। পালাতে পালাতে ক্লান্ত গাজিবাসী। কোথাও মায়ের হাত থেকে ছিটকে যাচ্ছে শিশু। মাঝরাতে উঠে এককাপড়ে এক শহর থেকে অন্য শহরে ছুটছেন মানুষ। পিছনে পড়ে থাকছে আজীবনের ভিটেমাটি, ঘরবাড়ি, আজীবনের সঞ্চয় সব। সব ছেড়ে পালাচ্ছেন মানুষ।
এতদিন পর্যন্ত মা-বাবা তাঁদের সন্তানকে বুঝিয়েছেন, বাড়ির থেকে সুরক্ষিত জায়গা পৃথিবীতে আর কিছুই নেই। আর আজ এই যুদ্ধের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শিশুদের এটা বোঝাতে বাধ্য বচ্ছেন বাবা-মায়েরা, যে সেই চিরসুরক্ষিত জায়গাটা এখন বধ্যভূমি। যে কোনও মুহূর্তে ইজরায়েলের হানায় গুঁড়িয়ে যেতে পারে গোটা শহর। প্রাণ বাঁচাতে এক কাপড়ে পালাচ্ছেন মানুষ। আর এটাই যেন গাজার মানুষের ভবিতব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরও পড়ুন:২৪ ঘণ্টায় শহর খালি করার নির্দেশ! ইজরায়েল ঠিক কী করতে চলেছে গাজায়?
ইউএন রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিস (UNRWA) চালিক স্কুলগুলিতে গিয়ে মাথা গুঁজেছেন গাজার অসংখ্য বাসিন্দা। প্রায় প্রতিটা যুদ্ধের সময়ই রাষ্ট্রপুঞ্জের স্কুলগুলিতে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন গাজার মানুষ। তবে তাতেও যে তাঁরকা খুব সুরক্ষিত, তা-ও বলা যায় না এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে। যে কোনও সময় ধেয়ে আসতে পারে রকেট। বাড়িঘর, প্রিয় শহর ছেড়ে আসতে বাধ্য হচ্ছেন মানুষ, শুধু নিজেকে এবং প্রিয় মানুষদের বাঁচানোর জন্য জন্য। অন্ধকার বুকে নিয়ে দৌড়োচ্ছেন গাজাবাসী। কবে কাটবে এই আঁধার, কবে বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকু ফিরে পাবে গাজার শিশুরা? সেটুই মৌলিক প্রশ্ন এখন প্যালেস্টাইনে।