কৃষ্ণপ্রেমকে রাধার চোখ দিয়ে দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
কেবলমাত্র ‘চিত্রাঙ্গদা’-ই নয়, ‘শ্যামা’, ‘চণ্ডালিকা’-র মতো নাটকেও লিঙ্গ ও যৌনতার নির্ধারণের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ইচ্ছেকেই গুরুত্ব দিয়েছেন।
ভারতীয় শিল্প-সাহিত্যে লিঙ্গচেতনার ছক ভাঙার শুরু সেই চৈতন্যের আমলেই। নারী-পুরুষের পরিচিতিকে সমাজ-নির্ধারিত খোপের বাইরে গিয়ে দেখার ক্ষেত্রে সেই অর্থে রবীন্দ্রনাথ চৈতন্যের সুযোগ্য উত্তরসাধক।ভারতীয় সমাজে প্রচলিত নারী-পুরুষ ভাবনাকে নস্যাৎ না করেও নিজের বিভিন্ন লেখায় লিঙ্গচেতনার নতুন ডিসকোর্স তৈরি করছেন রবীন্দ্রনাথ। শরীর, শ্রম, সময় এবং লিঙ্গের পারস্পরিক সম্পর্কের বুনটকে নতুনভাবে নির্মাণ করেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের নারী-পুরুষের ভাবনা এবং লিঙ্গের রাজনীতির অন্যতম সফল উপস্থাপনা ‘চিত্রাঙ্গদা’। মহাভারতে চিত্রাঙ্গদার ভূমিকা কেবল অর্জুনের স্ত্রী। যেখানে মহাভারতে চিত্রাঙ্গদার পরিচয় শেষ হয়, সেখান থেকেই যেন চিত্রাঙ্গদার নব-নির্মাণ শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর নাটকে চিত্রাঙ্গদা একদিকে মণিপুর রাজ্যের রাজকুমারী, যে রাজপরিবারের শিক্ষায় যোদ্ধার প্রশিক্ষণ পেয়েছে। যেখানে তাঁর মনন তৈরি হয়েছে পুরুষের ভূমিকাকে আপন করে নিতে। আবার সেই চিত্রাঙ্গদাই যখন অর্জুনের প্রণয়িনী, তখন নারীত্বের স্বাভাবিক ধর্মকে তার মধ্যে দেখাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। সেই চিত্রাঙ্গদা আর পাঁচজন নারীর মতোই তার প্রিয় পুরুষের সান্নিধ্য চায়। সেই ভূমিকায় তার যোদ্ধার কাঠিন্য খসে পড়ে। নারীর লালিত্য হয়ে ওঠে তখন চিত্রাঙ্গদার অলংকার।
এখানে সচেতনভাবেই রবীন্দ্রনাথ নারী ও পুরুষের লিঙ্গ-পরিচিতির বাইরে গিয়ে চিত্রাঙ্গদার চরিত্র তৈরি করেছেন। কোথাও গিয়ে নারী সত্তা ও পুরুষ সত্তা চিত্রাঙ্গদার মধ্য দিয়ে পরস্পরকে ছেদ করে গিয়েছে। বিশ্বভারতী থেকে ১৯৩৬-এ প্রকাশিত ‘চিত্রাঙ্গদা’- র বর্ণনায় সুরূপা এবং কুরূপাকে আলাদাভাবে বর্ণনা করছেন রবীন্দ্রনাথ। নাটকের মধ্য দিয়ে চিত্রাঙ্গদার লিঙ্গ নির্ধারণের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ কোনও স্পষ্ট ইঙ্গিত দেননি। ভাবনার দায় রেখেছেন পাঠকের ওপর। কিন্তু ‘চিত্রাঙ্গদা’-র ক্ষেত্রে লিঙ্গ নির্ধারণ কোনও সমাজ-নির্ধারিত ধারণায় আবদ্ধ থাকে না। নিজের ‘যৌনতা’ নির্ধারণে এখানে প্রামাণ্য হয়ে উঠেছে স্ব-ইচ্ছা। সুরূপা ও কুরূপার লিঙ্গ নির্ধারণের নেপথ্যে তাই চিত্রাঙ্গদার ইচ্ছেই বাস্তবতা পেয়েছে। কেবলমাত্র ‘চিত্রাঙ্গদা’-ই নয়, ‘শ্যামা’, ‘চণ্ডালিকা’-র মতো নাটকেও লিঙ্গ ও যৌনতার নির্ধারণের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ইচ্ছেকেই গুরুত্ব দিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের লেখায় অনেকক্ষেত্রেই ‘সে’ সর্বনামের ব্যবহার বেশি। বাংলা সর্বনাম হিসেবে 'সে’-র নির্দিষ্ট কোনও লিঙ্গ-পরিচিতি নেই। বিভিন্ন লেখায় প্রথম পুরুষ ‘সে’ সর্বনামের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সচেতনভাবেই রবীন্দ্রনাথ নারী-পুরুষ লিঙ্গের ভেদাভেদকে অস্বীকার করেছেন।
আরও পড়ুন: এই সমুদ্রতীরে কাদম্বরীর সঙ্গে শেষ ভ্রমণ রবীন্দ্রনাথের
আবার 'ভানুসিংহের পদাবলী'-ও রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের ভাবনার পরতে পরতে জড়িয়ে। বৈষ্ণব পদাবলিতে রসতত্ত্বর নিরিখে রাধাকৃষ্ণের যে দোলাচল, তাকে বিনির্মাণ করছেন রবীন্দ্রনাথ। এক্ষেত্রেও নারী-পুরুষের যৌনতার নির্ধারণে দুঃসাহসী রবীন্দ্রনাথ। আবার এই বৈষ্ণব ভাবনারই ছায়া দেখতে পাই ‘কড়ি ও কোমল’-এর অনেকগুলি কবিতায়। যেখানে ‘মথুরায়’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ কৃষ্ণের বিরহ-যন্ত্রণাকে প্রকাশ করেছেন। যেখানে কৃষ্ণ বিরহে রাধাকে ডাকছেন,
বাঁশরি বাজাতে চাহি বাঁশরি বাজিল কই?
এবার রাধে রাধে ডাক বাঁশি মনোসাধে ,
আজি এ মধুর চাঁদে মধুর যামিনী ভায়’।
আবার ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের ‘ একাল ও সেকাল’ কবিতায় রাধার বিরহভাবকে নিয়ে লিখছেন,
আজ ও আছে বৃন্দাবন মানবের মনে।
শরতের পূর্ণিমায়
শ্রবণের বরিষায়
উঠে বিরহের গাথা বনে উপবনে।
এখন যে বাঁশি বাজে যমুনার তীরে।
এখনো প্রেমের খেলা
সারাদিন, সারা বেলা
এখনো কাঁদিছে রাধা হৃদয় কুটিরে।
যে রবীন্দ্রনাথ কৃষ্ণের বিরহকে ফুটিয়ে তুলছেন পুরুষের স্বাভাবিক মনস্তত্ত্ব থেকে, সেই রবীন্দ্রনাথই আবার অনায়াসে বর্ণনা করছেন কৃষ্ণপ্রেমে কাতর বিরহী রাধার মনকে। এই যে নারী-পুরুষের মন থেকে মনে যাতায়াতের ক্ষেত্রে ও লিঙ্গের ভেদাভেদকে মুছে দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। গান থেকে কবিতা- রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির গলিঘুঁজি দর্শন করলেই এই উভকামী সত্তা ধরা পড়বে।
আবার নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথ যখন নিজে তৈরি করছেন লাবণ্য, দামিনী, চিত্রাঙ্গদার মতো চরিত্র, সেই রবীন্দ্রনাথই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সব নিয়মকে এড়াতে পারছেন না। নিজের তিন মেয়ের বিবাহ দিচ্ছেন অল্প বয়সে, মেয়েদের ভালোর জন্য নির্ভর করছেন ‘সৎ পাত্র’-র ওপর। আবার এরই উলটপুরাণ করছেন নিজেই। অকাল-বিধবা প্রতিমা দেবীর সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছেন পুত্র রথীন্দ্রনাথের। এমনকী, শান্তিনিকেতনের আশ্রম জীবনে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও ক্ষমতায়নের চেষ্টা করে গিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন খেলা থেকে আশ্রমে পিকনিক, মেয়েদের হোস্টেল থেকে পেশাগত ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের হয়ে সওয়াল করেছেন রবীন্দ্রনাথ।
নিজের লিঙ্গচেতনা নিয়ে নিজের দ্বান্দ্বিক অবস্থানকে কখনওই অস্বীকার করেননি রবীন্দ্রনাথ। স্ববিরোধকে নিয়েই লিঙ্গ-রাজনীতির পথ দেখিয়েছেন তিনি।