কুকুরের কামড় লুকিয়ে রেখে মৃত্যু, জলাতঙ্ক কতটা ভয়ঙ্কর?
Rabies: পৃথিবীতে প্রতি বছর অন্তত ৫৯,০০০ জন এউ রোগে ভুগে মারা যান। আর তার মধ্যে সিংহভাগই শিশু ও কিশোর।
পোষ্য হিসেবে কুকুরের জনপ্রিয়তাকে মাত দেওয়া কঠিন। অনেকেই কুকুর প্রাণীটিকে এতটাই পছন্দ করেন, যে রাস্তার কুকুরেরাও তাঁদের সেই বাৎসল্যরস থেকে বঞ্চিত হয় না। তবে সব মানুষের মধ্যেই যেমন সৎ এবং অসৎ-এর বাস, তেমনই কুকুর রাজ্যেও। বহু কুকুরই আহ্লাদের বহর সহ্য না করতে পেরে বসিয়ে দেয় দাঁত। তবে সর্বদাই যে এই কামড়ের পিছনে মানুষের বাৎসল্য রসের অতিপ্রবাহই দায়ী, তা কিন্তু নয়। বরং বহু সময়ই মানুষের উপদ্রবের থেকে বাঁচতে এই দাঁত অস্ত্রটি ব্যবহার করে বসে সারমেয়কূল। আর কুকুর কামড়ানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় আশঙ্কা ও ক্ষতিকর পরিণতির জায়গাটি হল জলাতঙ্ক।
ছোটো থেকেই আমরা কমবেশি এই রোগ নিয়ে শুনে এসেছি। জলতেষ্টায় ছাতি ফাটবে, কিন্তু জল দেখলেই চেপে ধরবে ভয়ঙ্কর রকমের ভয়! তবে এই ব়্যাবিস বা জলাতঙ্ক মানে কি শুধু কি এটুকুই! নাকি আরও ভয়ানক এই রোগ? সাধারণ ভাবে কুকুরের কামড় থেকেই এই রোগ হয় বলে শোনা যায়। তবে কুকুরের পাশাপাশি বিড়াল কিংবা বানরের কামড় থেকেও ছড়াতে পারে এই অসুখ। আসলে এই রোগের জন্য দায়ী লাসা নামক এর ভাইরাস। যেসব প্রাণীর দেহে এই ভাইরাসটি রয়েছে, তাদের থেকেই ছড়াতে পারে এই রোগ। তবে শুধু কামড়ই নয়, পশুর ক্ষতস্থান বা চোখ থেকেও ছড়াতে পারে অসুখটি।
আরও পড়ুন: পশু চিকিৎসকরা ব্যর্থ! পোষ্য কুকুরের রোগ নির্ণয় করল চ্যাটজিপিটি
সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের গাজিবাদের একটি ঘটনায় ফের প্রশ্ন উঠেছে জলাতঙ্কের ভয়াবহতা নিয়ে। মাস দেড়েক আগে গাজিয়াবাদের এক ১৪ বছরের কিশোরকে কুকুর কামড়ায়। তবে সে কথা পরিবার বা অন্য কাউকেই জানায়নি সে। পাছে বকা খেতে হয়। আর সেটাই কাল হল। গত সোমবার জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ওই কিশোর। অবস্থা খারাপ হতে শুরু করেছিল বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। দেরি করে চিকিৎসা শুরু হওয়ায় বাঁচানো যায়নি অষ্টম শ্রেণির এই পড়ুয়াকে। স্বাভাবিক ভাবেই এই ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে দেশ জুড়ে। হয়তো একটু আগে থেকে চিকিৎসা শুরু হলে প্রাণ যেত না ওই খুদের। পাশাপাশি গাজিয়াবাদের ঘটনায় প্রমাণ হয়ে গিয়েছে, মোটেও হেলাফেলা করার বিষয় নয় কুকুর বা সমগোত্রীয় কোনও প্রাণীর কামড়। কারণ এই ব়্যাবিস বা জলাতঙ্ক রোগটি কিন্তু মোটেই সহজ অসুখ নয়। একটু উনিশ-বিশ হলেই গাজিয়াবাদের কিশোরের মতোই হতে পারে পরিণতি।
অনেকেই কুকুর, বিড়াল কামড়ালে ব্যপারটিকে তেমন গুরুত্ব দেন না। কিন্তু এই ঝুঁকি এড়ানোর সহজ উপায় রয়েছে আমাদের হাতের কাছেই। ১৯৮৫ সালে জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়। যার নেপথ্যে ছিলেন মাইক্রোবায়োলজিস্ট লুই পাস্তুর। ২৮ সেপ্টেম্বর, তাঁর মৃত্যুদিনটিকে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবেস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
কিন্তু পশুর কামড় মানেই কি জলাতঙ্ক? না, তা অবশ্য নয়। তবে কী দেখে বুঝবেন রোগী জলাতঙ্কের শিকার। চিকিৎসকেরা জানান, জলাতঙ্ক রোগের প্রাথমিক লক্ষণই হল অস্বাভাবিক রকমের ক্লান্তি। তার সঙ্গে মাথাব্যথা, গলা ব্যথা এবং জ্বর। আস্তে আস্তে শুরু হয় মাংসপেশিতে খিঁচুনি। অত্যাধিক লালা নিঃসরণ, গিলতে অসুবিধে, অকারণ উদ্বেগ, শারীরিক অস্বস্তি, ঘুম না হওয়া, এ সমস্ত কিছুই হতে পারে জলাতঙ্কের লক্ষণ। আস্তে আস্তে শুরু হয় মস্তিষ্কে এর প্রভাব। ক্রমশ মস্তিষ্কে ছড়িয়ে যায় ভাইরাসটি। পক্ষাঘাত বা কোমার মতো অবস্থাও তৈরি হতে পারে যা আস্তে আস্তে মানুষকে টেনে নিয়ে যাবে মৃত্যুর দিকে। জলাতঙ্ক রোগ নিয়ে একটি মিথ রয়েছে, যে জল দেখলে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে রোগীরা। তা সম্ভবত গলার নিদারুণ ব্যথার কারণেই। এমনকী অনেকেই শব্দ, আলো এমনকী হাওয়াতেও অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে। ফলে কুকুর বা ওই ধরনের কোনও পশু কামড়ালে সময় না নিয়ে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। নিতে হবে উপযুক্ত টিকাও।
আরও পড়ুন: নিজে হাতে খাওয়াচ্ছেন পথকুকুরকে? কুকুরকে আগ্রাসী করে তুলছেন নিজের অজান্তেই
একটি পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, পৃথিবীতে প্রতি বছর অন্তত ৫৯,০০০ জন এউ রোগে ভুগে মারা যান। আর তার মধ্যে সিংহভাগই শিশু ও কিশোর। সাধারণ ভাবে যে পশুর কামড় থেকে জলাতঙ্ক সংক্রমণ হয়েছে, সেই পশুটিকে আটক করা হয়। কারণ একাধিক মানুষকে জলাতঙ্কে আক্রান্ত করার ক্ষমতা রাখে সেই প্রাণীটি। ফলে সেটিকে কোয়ারান্টাইন করা অত্যন্ত জরুরি। বহু সংস্থাই দায়িত্ব নিয়ে সেই কাজটি করে থাকে। সময় মতো রোগ চিহ্নিত করা গেলে জলাতঙ্কের জীবাণুকে বশ করা সম্ভব বলেই জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। তার ভ্যাকসিন আমাদের হাতে রয়েছে। তবে সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা। বহু পোষ্য মাতা-পিতারাই এটা মানতে চান না যে তাঁদের প্রিয় পোষ্যদের থেকে রোগ ছড়াতে পারে। আর সেখানেই ঘটে যায় আসল সমস্যাটা। প্রতি বছরই জলাতঙ্ক দিবসে সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচী নেওয়া হয় দেশ জুড়ে। তা সত্ত্বেও রাশ টানা যাচ্ছে না জলাতঙ্কের অঙ্কে। আরও কারওর অবস্থা যাতে গাজিয়াবাদের ওই কিশোরের মতো না হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আদতে আমাদের সকলের।