হিমশিম খেয়েছে বিজ্ঞানও! মৃতের 'আত্মা'ই ধরিয়ে দিলেন নিজের খুনিকে, কীভাবে সম্ভব?

Ghost Solves Murder: মাটিতে অদ্ভুতভাবে কিছু আসবাব পত্র ও একটি সোফার গদি জড়ো করে রাখা আছে আর তাতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। উপস্থিত দমকল কর্মীরা ওই স্থানের আগুন নেভাতে ছুটে যান।

যেকোনও জটিল খুনের রহস্য সমাধান করার সময় যখন নাস্তানাবুদ হয়ে যান গোয়েন্দারা, যখন দেখা যায় আসল অপরাধী পুলিশের কান ঘেঁষে বেরিয়ে যাচ্ছে, মনে হতেই তো পারে মৃত ব্যক্তিই একমাত্র খুনিকে ধরিয়ে দিতে পারে! মৃতের 'আত্মা' যদি এসে সবটা বলে দেয় তাহলেই তো ল্যাটা চুকে যায়! বাস্তব এতটা কল্পনার ভাণ্ডার নয়। হাজার সমস্যা হলেও তদন্তকারীদের মগজাস্ত্রই খুঁজে বের করে আসল অপরাধীকে। যেখানে তদন্তকারীদের হিসাবের গণ্ডগোল হয় সেখানেই অধরা থেকে যায় রহস্য ও খুনি। কিন্তু ১৯৭৭ সালে শিকাগো শহরের ঘটনাটি বদলে দিয়েছিল বাস্তব ও ভূত ভবিষ্যতের সমীকরণ। নিজের মৃত্যুর বদলা নিতে ফিরে এসেছিলেন 'মৃত' ব্যাক্তি, সমাধান করেছিলেন নিজেরই খুনের রহস্য!

মৃত্যুর পর নিজের খুনিকে ধরতে নাকি ফিরে এসেছিল মৃত তেরেসিটার 'আত্মা'। ১৯৭৭ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে একটি অ্যাপার্টমেন্টে খুন হওয়া তেরেসিটা ছয় মাস বাদে ফিরে আসেন নিজের খুনিকে ধরতে, স্বাভাবিকভাবেই ঘোল খেয়ে যান তদন্তকারীরা। তেরেসিটার ঘটনার হিসাব মেলানো সত্যিই কঠিন। তেরেসিটা বাসার জন্ম ১৯২৯ সালে ফিলিপাইন্সে। ফিলিপাইন্সের স্বচ্ছল ঘরে জন্মানো তেরেসিটার ছোট থেকেই স্বপ্ন ছিল নিজের খেয়াল খুশি মতো জীবন কাটানোর। মেডিক্যালের ছাত্রী তেরেসিটা বরাবরই ছিল চুপচাপ, মেধাবী। বন্ধু মহলেও সবার সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক। নিজের খেয়ালে চলা তেরেসিটা একদিন বুঝতে পারে, তার জীবনে কোনও রহস্য নেই, নেই কোনও 'থ্রিল'। নয়া অ্যাডভেঞ্চারের নেশাতেই ৩৫ বছর বয়সে তেরেসিটা পাড়ি জমায় আমেরিকার শিকাগো শহরে। ১৯৬০-এর দশকে তেরেসিটা সঙ্গীত নিয়ে পড়ার নেশায় চলে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং শুরু করে নতুন জীবন। ফিলিপাইন্স থেকে আসা তেরেসিটার প্রথম দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে মানিয়ে নিতে একটু সমস্যাই হচ্ছিল। যতটা নতুন মজা পেতে আসা, ততটা স্বাভাবিকভাবেই মিলছিল না। ক্রমে ক্রমে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর প্রচেষ্টায় নিজেকে মাতিয়ে তোলে তেরেসিটা। কিন্তু ব্যর্থ হয়। শিকাগো শহরে সেইভাবে বন্ধু বান্ধব বা পরিচিতির সংখ্যাও বাড়েনি তেরেসিটার। কিন্তু নিজের চেনা গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে এসে অচেনা দেশে একা থাকার এই জেদই তাকে অন্যন্য করে তুলেছিল।

শিকাগোয় কয়েক বছর থাকার পর তেরেসিটা সেখানকার স্থানীয় এডগেওয়াটার হাসপাতালে শ্বাসযন্ত্র বিশেষজ্ঞ হিসাবে যোগদান করেন। তেরেসিটা শিকাগোর ২৭৪০ নর্থ পাইন গ্রোভ অ্যাভিনিউয়ের ১৫বি নম্বর ফ্ল্যাটের বাসিন্দা ছিলেন। ঘটনাটি ঘটে ১৯৭৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। হঠাৎ করেই স্থানীয় দমকলের কাছে ফোন আসে যে ২৭৪০ নর্থ পাইন গ্রোভ অ্যাভিনিউয়ের একটি ফ্ল্যাটে আগুন লেগেছে। দমকল কর্মীরা ফ্ল্যাটের বাকি আগুন নিভিয়ে তেরেসিটার ফ্ল্যাটের সামনে এলে বুঝতে পারে আগুনের উৎস হল এই ফ্ল্যাটটিই। কোনও রকমে বাইরের আগুন নিভিয়ে ভেতর থেকে বন্ধ দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকেন কর্মীরা। কিন্তু ভেতরে ঢুকে তারা হকচকিয়ে যান, ভেতর থেকে বন্ধ ফ্ল্যাটের ভেতরে কেউ নেই কেন? দমকল কর্মীরা যখন ঘরের ভেতরে আগুন নেভাতে ব্যস্ত ঠিক তখনই এক কর্মীর চোখে পড়ে, পাশের ঘরের মাটিতে অদ্ভুতভাবে কিছু আসবাব পত্র ও একটি সোফার গদি জড়ো করে রাখা আছে আর তাতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। উপস্থিত দমকল কর্মীরা ওই স্থানের আগুন নেভাতে ছুটে যান। উপরের আসবাব সরিয়ে নীচের গদি সরাতেই চক্ষু চড়কগাছ! গদির নীচে চাপা দেওয়া একটি মহিলার দেহ, এত আসবাবের নীচে চাপা পড়ায় আগুনের লেলিহান শিখা তখনও তাকে সেভাবে ছুঁতে পারেনি। কর্মীরা তড়িঘড়ি তেরেসিটার দেহ ওই স্থান থেকে বার করে নিয়ে আসার সময় বুঝতে পারেন যে তেরেসিটার দেহ পুরোই উলঙ্গ, এক টুকরো কাপড়ও তার দেহে নেই। বুকে একটি ছুরি সোজা করে গাঁথা। কোনওক্রমে দমকল কর্মীরা তেরেসিটার দেহ উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যাবস্থা করেন।

আরও পড়ুন- বাংলার বীভৎসতম হত্যা! টিকিট কেটে ১৮৭৩ সালের পরকীয়া মামলার শুনানি দেখেছিল মানুষ

নগ্ন দেহে বাসার মৃতদেহকে দেখে এবং বুকের মধ্যে ছুরি বেঁধানো দেখে প্রথমে চিকিৎসকদের সন্দেহ হয় ঘটনাটি কোনও যৌন অপরাধ ঘটিত হয়তো। কিন্তু ময়নাতদন্তের রিপোর্টে তেমন কিছু তো দূর তার শরীরে কোনও যৌন আঘাতের চিহ্ন পর্যন্ত মেলেনি। অবাক হন তদন্তকারীরা। ঘটনার বাকি দিক নিয়ে শুরু হয় তদন্ত। কিন্তু অপরাধী সম্পর্কে ধোঁয়াশা কাটার পরিবর্তে আরও জট পাকাতে শুরু করে। তদন্তকারীরা এমন কোনও সুত্র খুঁজে পাচ্ছিলেন না যা থেকে বোঝা যায় যে কেন বা কে কী কারণে খুন করেছে তেরেসিটা বাসাকে। তেরেসিটার ব্যাক্তিগত জীবনও তেমন অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। গুটিকতক যে বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে তার আলাপ ছিল প্রত্যেকের সঙ্গেই তেরেসিটার সম্পর্ক ছিল ভালোই। হাসপাতালের রোগীদের কাছেও তেরেসিটা ছিলেন পছন্দের। এমন এক শত্রুহীন ব্যক্তিকে খুন করল কে? তদন্তকারীরা তেরেসিটার ডায়েরি থেকে একটি লেখা পান। ডায়েরিতে লেখা ছিল, ‘এস সি’ নামে এক ব্যাক্তির জন্য থিয়েটারের টিকিট কাটতে হবে এবং গোয়েন্দারা আরও জানতে পারেন মৃত্যুর আগে তেরেসিটা শেষ ফোনটা করে রুথ লোব নামে একজনকে। রুথ লোবকে ডেকে তদন্তকারীরা জানতে চান তেরেসিটা মৃত্যুর আগে শেষ ফোনে সন্দেহজনক কিছু বলেছিল কিনা। রুথ জানান, তেরেসিটা শুধু বলেছিল তার বাড়িতে একজনের আসার কথা। কিন্তু সে কে? সেটা রুথ জিজ্ঞাসা করেননি। ফলে সেই ব্যক্তিই জনৈক ‘এস সি’ কিনা তা নিয়ে তৈরি হয় সন্দেহ।

ছয় মাস কেটে গেলেও খুনির কোনও দেখা নেই। এমনকী এস সি নামের ব্যক্তিরও হদিশ মেলেনি। গোয়েন্দারা ধরেই নিয়েছিলেন এও এক অমীমাংসিত তদন্ত হয়েই রয়ে যাবে। কিন্তু তদন্তকারীদের মধ্যে গোয়েন্দা স্ট্যানচুলার মনে করতেন সুত্র আছে হাতের কাছেই, স্রেফ ধরা যাচ্ছে না। হঠাৎই একদিন স্ট্যানচুলার কাছে একটি ফোন আসে। ফোনের ওপারের ব্যক্তি জানান তার কাছে তেরেসিটার মৃত্যুর ব্যাপারে সম্পূর্ণ তথ্য আছে। কিন্তু তিনি যা বলবেন তা স্ট্যানচুলাকে বিশ্বাস করতে হবে। স্ট্যানচুলা আশ্বাস দেন যে তিনি পুরোটা শুনবেন এবং বিশ্বাসও করবেন। এরপরই তেরেসিটার মৃত্যুর ব্যাপারে যা বলেন ওই ব্যক্তি শুনে হাঁ হয়ে যান স্ট্যানচুলা। ফোনটি করেছিলেন হোসে চুয়া। এর সঙ্গে তেরেসিটার সরাসরি কোনও যোগাযোগই ছিল না। তাহলে কীভাবে তিনি জানলেন তেরেসিটার মৃত্যুর ব্যাপারে?

আরও পড়ুন- পডকাস্ট শুনেই খুনের সমাধান! ৪০ বছর পুরনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তোলপাড় বিশ্ব

পেশায় চিকিৎসক হোসে চুয়ার স্ত্রী রেমি চুয়া ছিলেন তেরেসিটার সহকর্মী। তেরসিটার মতো রেমিও এডগেওয়াটার হাসপাতালে শ্বাসযন্ত্র বিশেষজ্ঞ ছিলেন, রেমিরও জন্ম হয়েছিল ফিলিপাইন্সে। জন্মগতভাবে একই দেশে জন্মানোর জন্যই হয়তো দু'জনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। হোসে স্ট্যানচুলাকে জানান, বেশ কয়েকদিন ধরেই তার স্ত্রী রেমি নাকি মৃত তেরেসিটার উপস্থিতি লক্ষ্য করছেন। প্রথমে এই বিষয়টিকে চুয়া দম্পতি বিশেষ পাত্তা না দিলেও যত দিন যেতে থাকে উদ্ভট সব কাণ্ডকারখানা ঘটার পরিমাণও বাড়তে থাকে। রেমি নাকি প্রায়ই তেরেসিটাকে দেখতে পান এবং গলার আওয়াজও শুনতে পান। সবথেকে আকর্ষণীয় যে তথ্যটি হোসে দেন তা হলো, তেরেসিটার আত্মা নাকি ভর করছে রেমির উপর! একদিন হঠাৎই নাকি মাঝরাতে রেমির উপর ভর করে তেরেসিটার আত্মা, তেরেসিটার গলায় কথা বলে ওঠে রেমি, হোসেকে জানায় কীভাবে খুন হয়েছিল সে। হোসে বলেন, ওই কণ্ঠস্বর নাকি নিজেকে তেরেসিটা বলে পরিচয় দেয়। তেরেসিটার কণ্ঠস্বর জানায়, খুন করেছিল তারই পরিচিত এক ব্যক্তি, অ্যালান সাওয়ারি। অ্যালান এডগেওয়াটার হাসপাতালের কর্মী ছিলেন। তেরেসিটার কণ্ঠস্বর আরও জানায়, অ্যালানের তেরেসিটার বাড়িতে ঘটনার দিন টিভি ঠিক করতে আসার কথা ছিল। অ্যালান আসেও কিন্তু কাজ করার সময় অ্যালান তেরেসিটার মুল্যবান গয়না দেখে নেয় এবং তেরেসিটার অনুপস্থিতে তা চুরি করতে যায়। ওই সময়ই তেরেসিটা ঘরে চলে এলে অ্যালানকে হাতে নাতে ধরে নেয়। শুরু হয় ঝামেলা আর তখনই নাকি অ্যালান খুন করে তেরেসিটাকে। তেরেসিটার কণ্ঠস্বরই নাকি হোসেকে বলে সবটা গোয়েন্দাদের জানাতে।

কিন্তু মুখ খোলেন না চুয়া দম্পতি, তাদের মনে হতে থাকে যে এই কথার প্রমাণ কী? কেউ কেন তাদের মুখের কথা বিশ্বাস করবেন? কয়েকদিন বাদে ফের রেমির উপর ভর করে তেরেসিটার 'আত্মা'। অসন্তুষ্ট হয়ে জানতে চায় কেন চুপ করে আছে চুয়া দম্পতি? প্রমাণের কথা উঠতেই তেরেসিটা জানান, অ্যালানের বান্ধবীর বাড়িতে খোঁজ নিলেই চুরি যাওয়া সব গয়না খুঁজে পাওয়া যাবে। কারা ওইসব গয়না তেরেসিটার বলে শনাক্ত করতে পারবে তাদের নামও বলে ওই কণ্ঠস্বর। এরপরই আর এক মুহূর্ত দেরি না করে হোসে সব জানান গোয়েন্দা স্ট্যানচুলাকে।

স্ট্যানচুলা অবশ্য প্রথমে এক বর্ণও বিশ্বাস করেননি, তবে হোসের কথা একেবারে ফেলতেও পারেননি। আবার গোড়া থেকে শুরু করেন তদন্ত। জেরা করা হয় অ্যালানকে, প্রথমে সে পুরোটা অস্বীকার করলেও ধীরে ধীরে দোষ কবুল করে। অ্যালান জানায়, তেরেসিটার বাড়িতে প্রথমে সে শুধু টিভি সারাতেই গিয়েছিল, চুরি বা খুনের অভিসন্ধি ছিল না। কিন্তু টিভি সারাতে গিয়েই তেরেসিটার ড্রয়ারে রাখা গয়নার খোঁজ পায় ব্যাস... ঘটনাটিকে যাতে যৌন অপরাধের মতো সাজান যায় তাই তেরেসিটার গা থেকে সব জামা খুলে নিয়েছিল অ্যালান। অ্যালানের প্রেমিকার বাড়ি থেকেও তেরেসিটার বলা প্রত্যেকটি চুরি যাওয়া গয়না খুঁজে পাওয়া যায়। প্রথমে মাত্র পাঁচ বছর, ১৪ বছরের জন্য জেল হয় অ্যালানের।

যে খুনের তদন্ত করতে গিয়ে ছয় মাস ধরে হিমশিম খেয়েছেন তদন্তকারীরা, সেই ঘটনা মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে সমাধান করতে সাহায্য করেছিল ‘গোয়েন্দা’ ভুত। বৈজ্ঞানিকভাবে আজও এই ঘটনার সমাধান করতে পারেনি কেউ। বাস্তবতা ও অবাস্তবতার জালে তেরেসিটা বাসার হত্যাকাণ্ড আজও রহস্যে মোড়া।

 

More Articles