পুজো পরিক্রমা
Gig workers during Kolkata Durgapujo: কোম্পানি বলেছে, কম কথায় সারতে, বচসায় না জড়াতে। রিপোর্ট করলে কাজ যাবে। তাই পঞ্চমীর সন্ধ্যায় চুপ করে নেমে আসেন ডেলিভারি কর্মীটি।
পঞ্চমীর বিকেল
হাঁটতে বেরোচ্ছি কারণ ডাক্তার বলেছেন ওজন কমাতে। লিফটে নীচে নেমে দেখলাম, এক ডেলিভারি পার্টনার অস্থির ভাবে পায়চারি করছেন। ফোনে কাউকে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। আমাকে দেখে যেন প্রাণে জল এল তাঁর। কাকুতিমিনতি করে গেটটা খুলে দিতে বললেন। গেট খুললেই আমি আমার গন্তব্যে, উনি ওঁর। মাঝে সময় বড়জোর এক মিনিট। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আগে যেটুকু জানা গেল তার অস্ত্যর্থ- আমার কোনো প্রতিবেশীকে উনি খাবার দিতে এসেছিলেন। বেল বাজানোয় বিরক্ত হয়ে তিনি কথা শোনাতে থাকেন। কোম্পানি বলেছে, কম কথায় সারতে, বচসায় না জড়াতে। রিপোর্ট করলে কাজ যাবে। তাই তিনি চুপ করে নেমে এসেছেন। 'ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না তাই বেল বাজিয়েছি', এ কথাটা বলেননি। এখন নীচে নেমে পড়েছেন অকুলপাথারে, মূল গেটের তালা বন্ধ। যাকে খাবার দিতে এসেছিলেন তাঁর ফোনও অধরা। এদিকে পরের অর্ডার দিতে যাওয়ার তাড়া আছে। কার পক্ষ নেব আমি? প্রতিবেশীর নাকি এই ডেলিভারি পার্টনারের?
ষষ্ঠীর সকাল
বেরোচ্ছি বাজারে। গেটের সামনে দেখলাম বিরাট একটা কুরিয়ারের ব্যাগ কাঁধে একটা কমবয়সি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে গেটের কাছে। সামনের দিকে ঝুঁকে। হাতে পার্সেল। আমার প্রতিবেশী এসে পার্সেলটা নিয়ে চলে গেলেন। আমি গতি কমিয়ে এনেছি নিজের। চোখে চোখ পড়তেই জিজ্ঞেস করলাম,
- কী, কাল থেকে ছুটি তো?
এক কথায় উত্তর, '৬ নভেম্বরের আগে কোনও ছুটি হবে না। বলে দিয়েছে।'
আমি প্রশ্ন করি, 'শরীর খারাপ হলে?'
এবার উত্তর আসে,' ছুটি হয়ে যাবে একদম পুরোপুরি।'
আমি এগিয়ে যাই। পুজোর ছুটিটা উপভোগ করব। আগেভাগে বাজারটা সেরে রাখতে হবে।
আরও পড়ুন: দুর্গাদর্শক সবাই, দুর্গাদ্রষ্টা আছেন কেউ?
সপ্তমীর দুপুর
বাড়িতে জন্মদিন উপলক্ষ্যে কোনও শুভানুধ্যায়ী বই পাঠিয়েছেন। যিনি নিয়ে এসেছেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করি, 'এখন তো অর্ডার একটু বেশি কী বলেন?'
উত্তর আসে, 'হ্যাঁ অর্ডার বেশি, ক্যানসেলও বেশি। এক বাড়িতে চারবার গিয়েছি জিনিস দিতে, চারবার গিয়েছি তা ফেরত আনতে। এর জন্য তো আলাদা টাকা পাব না! লোকে জিনিস এনে পরে দেখে ফেরত দিয়ে দেয়। অনেকে আবার ভাবে জিনিস ফেরত দিলে টাকাটা আমিই ফেরত দেব। বোঝাতে বোঝাতে হয়রান হয়ে যাই।' হয়রান লোকটার পিঠে হাত রাখি। উনি হেসে চলে যান। যাওয়ার আগে রেটিং চেয়ে যান।
সপ্তমীর সন্ধে
কাজের চাপ আজ কম। ফিশফ্রাই অর্ডার করেছি। মা আর আমি ফিশফ্রাই ভক্ত। বাইকার আসছে দোরগোড়ায়। মাঝেসাঝেই দেখছি, আর কতদূর। সাতটা বেজে গিয়েছে। ১ মিনিট দূরে আছেন উনি, দেখেই লিফটে চড়ে নীচে নেমে এলাম। খাবার হাতে নিয়ে বললাম, 'কাল থেকে তো ছুটি নেবেন নাকি?'
উত্তরে উনি বললেন, 'এ ক'টা দিন ইনসেনটিভ আছে। কাজ করতেই হবে।'
আমি: কত টাকা ইনসেনটিভ?
ডেলিভারি পার্সন: অর্ডারপিছু ৩৫।
আমি: বাহ, তাহলে তো ভালোই। দশটা পর্যন্ত করে বাড়ি চলে যান। রাতে ঠাকুর দেখুন।
উত্তরে লোকটি হাসেন। যাওয়ার আগে বলে যান, 'দু'টোর আগে লগ আউট করলে একটাও ইনসেন্টিভ পাব না। কাল শেষ অর্ডার এসেছে দু'টো বাজতে দশে। বাড়ি ঢুকেছি তিনটে নাগাদ।'
অষ্টমী
মা অঞ্জলি দেবে। তাই আগে থেকে বলে রেখেছে, যেন খাবার আনিয়ে নিই। সকাল ন'টা অর্ডার করেছি রাধাবল্লভি- জিলিপি। খাবার এল ৪৫ মিনিট পরে। প্রবীণ ডেলিভারি কর্মীকে জিজ্ঞেস করলাম,
-এখন তো একটু বেশি পাচ্ছেন নাকি?
বললেন, 'রাতে করলে ৩৫। দিনে করলে অর্ডারপিছু ২০ টাকা বেশি। কিন্তু শর্ত লগইন করতে হবে ৬টার আগে। আমার প্রায় ৫৭ বছর বয়স। ৬টায় লগইন করতে পারি না। ইনসেনটিভ পাই না একদিনও। আর ইনসেনটিভটা একটা ভাঁওতা। আমাদের ছেলেরা আন্দোলন করছে৷ প্রতি অর্ডারে কুড়ি টাকা বেশি পাওয়া যাবে। কিন্তু মোট অর্ডারের সংখ্যা কমে যাবে।'
ওঁর আর কথা বলার সময় নেই। আমারও কচুরি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। উপরে উঠে আসি।
আরও পড়ুন:নিকষ আঁধারে ওরা হাঁটছে…
দশমীর বিকেল
আবার কেউ বই পাঠিয়েছে। পুজোর উপহার। যে ছেলেটি সাইকেল চালিয়ে এসেছে তার সদ্য গোঁফের রেখা গজিয়েছে। আমি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করি, 'ভাই,তুমি আমার বোনের থেকেও ছোট, তোমায় তুমি বলি? তুমি পড়াশোনা করো?'
উত্তর আসে, ' আরে হ্যাঁ, তুমি বলতে পারেন, পড়াশোনা করি'।
'কোথায় পড়ো?'
-বিদ্যাসাগর কলেজ।
-বলছ কী! কোন বিভাগ? ও কলেজে আমিও পড়তাম।
-ভূগোল।
-কলেজ যাও না? অ্যাটেন্ডেন্সের কড়াকড়ি তো এখন?
- দাদাকে বলা আছে। যেতে হয় না। অ্যাটেন্ডেন্স দিয়ে দেয়।
-কিন্তু কত ভালো শিক্ষক আছেন। তুমি তো পড়ার সুযোগ পাচ্ছ না?
-পড়ে কী হবে দাদা?
-তাহলে? তুমি এই কাজই করবে?
-না, এটা কিছু দিনের জন্য করছি। ক্যাশ লাগবে তাই।
-কী করবে ক্যাশ দিয়ে?
-ব্যবসা করব।
-কীসের ব্যবসা?
- বাইক কিনব।
-তারপর?
-র্যাপিডো চালাব। অথবা সুইগিতে ঢুকে যাব...